আমি শোষকের বংশধর, তাই চিরকালই শোষকের পক্ষে। জাতিসংঘের কোন অধিকার সনদ আমার জন্য প্রযোজ্য নয় কেননা আমি জন্মসুত্রে অধিকার প্রাপ্ত রক্তশোষক। আমার চৌদ্দ পুরুষ এমনকি চৌদ্দ লক্ষ কোটি পুরুষও রক্তশোষকই ছিল। আমাদের জাতিগত নিয়ম হলো - যেখানে জন্মাইবে সেখানকার সম্ভাব্য সকল প্রাণীর রক্ত শোষণ করিয়া মৃত্যুবরণ করিবে। জন্মের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আমাদেরকে সংক্ষিপ্ত শিক্ষা সফরে নিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হয় আমাদের অধিকারের সীমানা।
আমাদের বর্তমান সমাজটির বসবাস বিশাল এক প্রান্তর জুড়ে। ঘাসপাতা ছাড়া অন্য কোন গাছপালা নেই এদিকে। এলাকাটা নিরাপদ বলে বিবেচিত। তবে এদিকে খাদ্য সংকটও প্রবল। মানুষের রক্ত আমাদের প্রধান খাদ্য এবং সবচেয়ে প্রিয়। কিন্তু এই এলাকায় কোন মানুষ আমাদের ধারে কাছে ঘেঁষে না। আমরা কেবল দূর থেকে মানুষের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আমাদের বাসস্থানের খানিক দূর দিয়ে শক্ত পাথুরে মাঠের উপর দিয়ে বড় বড় দানবীয় কিছু পাখি গোঁ গোঁ করে আকাশে উড়ে কোথাও চলে যায়। সেই পাখিগুলোকে আমরা হিংসা করি। তাদের খাদ্য আস্ত জ্যান্ত মানুষ। একেকটা পাখি শত শত মানুষ গিলে উড়ে চলে যায় প্রতিদিন। পাখিগুলো প্রতিদিন এত মানুষ গিলে খায় তবু মানুষগুলো বোকার মতো আবারো লাইন ধরে পাখির পেটে ঢুকে পড়ে প্রতিদিন। ওই পাখি আকাশ থেকে নেমে আসতে দেখলে আমরা পালিয়ে বাঁচি না, অথচ মানুষগুলো কোন যাদুর বলে নিজে নিজে ঢুকে পড়ে পাখির পেটের ভেতর। মানুষেরা কী করে এত বোকা হয় আমরা ভেবে পাই না।
আমরা খুব বুদ্ধিমান। ওইসব দানব পাখিদের ধারে কাছেও যাই না। জঙ্গলের নিরাপদ আস্তানায় থেকে দিন কাটাই। মাঝে মাঝে মানুষের আস্তানায় হানা দিয়ে সামান্য রক্তশোষণ করে পালিয়ে আসি। বেশী লোভ করি না।
আমাদের ধর্মে প্রধান তিনটি নীতি -
১. লোভে পাপ, পাপে খতম, ২. কম খাও, বেশী বাঁচো, ৩. ঠাশ-ঠুশ থেকে দূরে থাকো।
আমরা কড়াকড়িভাবে তিনটা নিয়ম মেনে চলি।
সেদিন রাত হয়ে এলে হাজার খানেক ভাইবেরাদরকে নিয়ে কাছাকাছি বড় দালানটির নীচে গেলাম কিছু রক্তভোজন করতে। লোক বেশী ছিল না। কয়েকশো জনের ভাগে একটা করে মানুষ পড়লো। ঝাঁপিয়ে পড়ে যখন খেতে শুরু করেছি মানুষগুলো হাতপা কুঁদিয়ে এমন নাচন দিল সবাই হেসে বাঁচি না। মজা করে রক্তভোজ সেরে ফিরতে যাবো অমনি কোথা থেকে দশ দিগন্ত কাঁপিয়ে ঝেঁপে বৃষ্টি নামলো। এত বড় ফোঁটা যে যার গায়ে পড়ছে সেই চ্যাপটা হয়ে মাটিতে আছাড় খেয়ে পটল তুলছে। পাখাটাখা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে অনেকের। আমরা কোথায় লুকোবো পড়িমড়ি করে সামনে দাঁড়ানো একটা দানব পাখির পেটের খোলা গর্ত দিয়ে ঢুকে পড়লাম। সবাই পারলো না। কয়েকশোজন ঢোকার পরই যখন দড়াম করে দরোজা বন্ধ হয়ে গেল পেছন দিকে তখন ভীষণ কেঁপে উঠলাম। অবশেষে বোকা মানুষের মতো আমরাও ধরা পড়ে গেলাম?
ভেতরে হালকা বাতি জ্বলছে। কিন্তু মানুষজন কেউ নেই। আমরা বের হবার পথ খুঁজছি অমনি দেখা গেল দরজা খুলে গেছে এবং একদল মানুষ সারি বেঁধে ঢুকছে। ঘাপটি দিয়ে লুকিয়ে থাকলাম আমরা। আধপেটা খেয়ে তখন মন ভরে নি। একসাথে এতজনকে পেয়ে আবারো এক দফা রক্তভোজ করার জন্য শরীর চনমন করে উঠলো। মানুষগুলো সারি সারি আসনে বসে গেল সুন্দর করে। আমরা তাদের পায়ের দিকে নেমে খোলা জায়গা খুঁজতে লেগে গেলাম যুতসই কামড় দেবার জন্য। এরা খুব ভদ্রলোক, ঠাশ ঠুশ তেমন জানে না মনে হলো। শুধু একটু পা নাড়িয়েই চুপ হয়ে বসে থাকছে।
আরাম করে খেয়ে চোখে যেন ঘুম চলে আসছে। অমনি হঠাৎ দেখলাম দূর থেকে একট মানুষ হাতে ধোঁয়ার বন্দুক দিয়ে শো শো করে ব্রাশ ফায়ার করতে করতে এগিয়ে আসছে। ওরেব্বাস! এটার কথাই দাদার কাছে শুনেছিলাম। এই সুগন্ধ যে একবার নাকের ভেতর নিয়েছে তার জান খতম। এই সেই নিষিদ্ধ মরণ সুগন্ধী, যার কাছ থেকে সারাজীবন সতর্ক থাকার নির্দেশ আছে বংশপরম্পরায়।
বাকীদের সতর্ক করার সুযোগ পেলাম না। নিজে দম বন্ধ করে কাছাকাছি একটা ছোট্ট ফোকরের মতো জায়গা পেয়ে ঢুকে পড়লাম। অনেকক্ষণ নাকমুখ গুঁজে নিঃশ্বাস বন্ধ রেখে কান পেতে শুনলাম শোঁ শোঁ থেমে গেছে। উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে দেখলাম আমাদের প্রায় সবাই মারা পড়েছে এই আক্রমণে। বেঁচে আছি আমরা জনা পাঁচেক মাত্র। এখন যে কোন মূল্যে বের হতে হবে এখান থেকে। পথ খুঁজতে লাগলাম মরিয়া হয়ে। এবার ভুলেও কাউকে কামড় দিলাম না। ওরা জানে আমরা সব ফিনিশ হয়ে গেছি। মানুষগুলো এখন নিশ্চিন্তে খাবার গিলছে, গিলুক। পাখিটা ওদেরকে গিলেছে, আমাদেরকেও গিলেছে। বোকার দল এখনো বুঝতে পারছে না বলে মজা করে খাবার গিলছে, ঢেকুর তুলছে বিশ্রীরকম। দেখে গা জ্বলে যায় আমাদের।
থাক, যা খুশী করুক তারা। আমাদের যে কোন উপায়ে বের হতে হবে এই পাখিটার পেট থেকে। বুদ্ধি খেলাবার চেষ্টা করছি।
গোলগোল কতগুলো জানালার মতোন আছে, কিন্তু সেদিকে বের হবার পথ বন্ধ। আরো খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম একটা জায়গা। চেনা লাগলো কেমন, এদিকেই তো আমরা ঢুকেছি। এই তো সেই দরোজা। এদিক দিয়েই পথ আছে নিশ্চয়ই। সবগুলো ফাঁক চেক করলাম, কোন পথ পাওয়া গেল না। আমাদের একটা ঠ্যাং ঢুকবে তেমন কোন ছিদ্রও নেই কোথাও। হতাশ হয়ে বসে পড়লাম পাঁচজনেই। বাঁচার কোন আশাই নাই এবার।
আমার চার সঙ্গী বয়সে আমার চেয়ে আধা দিনের ছোট বলে আমার উপর অনেকখানি নির্ভর করে আছে। ওরা ভাবে আমি খুব বুদ্ধিমান। এটা ঠিক আমি তাদের চেয়ে খানিক শিক্ষিত। মানুষের কাছ থেকে পূর্বপুরুষেরা কিছু জ্ঞান অর্জন করেছিল বংশপরম্পরায় সেই জ্ঞানগুলো আমরা কেউ কেউ আহরণ করেছি। তবে সেই জ্ঞান আত্মরক্ষা বাদে কোন কাজে লাগে নাই আমাদের।
ভাবতে ভাবতে একটা ধাক্কামতন লাগলো হঠাৎ। পাখিটা গড়গড় করে কাঁপছে। রাগ করেছে হয়তো। অথবা খাবারে পেট ভরেনি। কিছু একটা গোলমাল লাগার আশংকায় পাঁচজনই সতর্ক অবস্থানে গিয়ে একটা পর্দার আড়ালে আশ্রয় নিলাম। বরাবর দেখেছি এমন নরোম তন্তুর আড়ালই আমাদের রক্ষা করে। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে পাচ্ছি আমরা যে গর্ত দিয়ে এই পাখির পেটের ভেতর ঢুকেছিলাম সেই গর্তের মুখটা আবার খুলে গেছে। সেখান দিয়ে বাইরের আলো দেখা যাচ্ছে। সূর্যের আলো। মানুষের দল লাইন ধরে বের হয়ে যাচ্ছে। আমরা ইশারায় ঠিক করলাম এক ফাঁকে উড়াল দিতে হবে।
যেই বলা সেই কাজ। শেষ মানুষটা বের হবার আগে আমরা পাঁচজন একসাথে ভোঁ করে উড়াল দিয়ে বাইরে চলে এলাম। ছুটে বেরিয়ে দিশেহারা লাগলো। এই জায়গাটা একদম অচেনা, আগের আস্তানার চেয়ে অন্যরকম। বুকটা কেঁপে উঠলো ভয়ে। কাছাকাছি খোলা মাঠ বা জঙ্গল খুঁজলাম, কিন্তু এটা তো আরেকটা বিশাল ঘর, চারদিকে জানালা বন্ধ। বন্ধ জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ধূ ধূ প্রান্তর। তার উপর একের পর এক দানবীয় পাখি উঠছে নামছে।
আমরা দিশেহারা হয়ে ঘুরছি। কী বিপদের মধ্যে এসে পড়লাম। সঙ্গীসাথী নিয়ে মারা পড়তে হবে। উড়তে উড়তে মানুষের বাথরুমের মতো একটা ঘর দেখা গেল, এই তো এখানে নিরাপদ আশ্রয় মিলতে পারে।
উড়ে গিয়ে ঢুকে পড়লাম সেই ঘরে। সেখানে নীল শার্ট পরা একজনকে দেখে খিদে জেগে গেল। সে কোনায় বসে ঝিমাচ্ছিল। আমি চার সাগরেদকে নিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ত খেতে শুরু করলাম।
বেশ আরাম করেই খাচ্ছিলাম চেনা স্বাদের রক্ত। হঠাৎ করে লোকটা জেগে উঠে চটাশ করে হাতের তালু দিয়ে পায়ের উপর চড় দিয়ে খিঁচিয়ে উঠলো, 'শালার মালয়েশিয়া এসেও মশার উৎপাত থেকে রক্ষা নাই। দাঁড়া এখনি স্প্রে করতেছি'।
সর্বনাশ!! এই ভাষা তো আমাদের চেনা!! আমরা যেখান থেকে এসেছি সেখানকার ভাষা।
এই চেনা ভাষায় কথা শুনেই আমরা পাঁচজন বাইরের অজানায় উড়াল দিলাম ঝামেলা না বাড়িয়ে। যে কোন মূল্যে বাঁচতে হবে আরেকটি ব্রাশফায়ার থেকে। দূরে জঙ্গল আছে নিশ্চয়ই, উড়তে উড়তে বের হবার রাস্তা পেয়ে গেলাম অবশেষে। খোলা আকাশের দেখা পেয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম পাঁচজনে। এখানে আমাদের নিরাপদ আশ্রয় মিলবেই।
[বি.দ্র: সেদিন কোন পত্রিকায় আসেনি যে ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে কয়েকশো মশা মালয়েশিয়া গামী বিমানে উঠে ইনসেক্ট স্প্রের আঘাতে নিহত হয়েছিল। বেঁচে চাওয়া পাঁচটি জেদী মশা এয়ারপোর্টের বাথরুমে বাঙালী ক্লিনারের স্প্রের আঘাত থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়ে কুয়ালালামপুরের পাম বাগিচায় আশ্রয় নিয়েছে। পত্রিকায় না আসলেও মালয়েশিয়াগামী যাত্রী ও এয়ারলাইন্সের ক্রুরা এটা জানে যে প্রতিদিন কয়েকশো মশা নিয়মিত ভাবে ঢাকা থেকে বিনা টিকেটে মালয়েশিয়া যাবার অপচেষ্টা করে। তাদের জন্য মালয়েশিয়াগামী ফ্লাইটে মশা নিরোধক স্প্রে মজুদ রাখতে হয়।]
No comments:
Post a Comment