Tuesday, February 17, 2009

একটি স্মৃতিকথা কিংবা উপন্যাসের সারাংশ

সংশপ্তকের মালুর কথা মনে আছে? আর তার রানুদি? তিরিশ বছর আগে মালুর বয়সে আমারও একটা রানুদি ছিল। রানুদি তখন গ্রাম্য তরুনী কিন্তু শহুরে স্মার্টনেস আর সৌন্দর্য দুই মিলিয়ে অতুলনীয়। সুন্দরের ঐশ্বর্য কখনো সম্পদ কখনো বোঝা। রানুদির ক্ষেত্রে সেটা হয়েছিল বোঝা। সৌন্দর্যের অরক্ষনীয়তা বিপদের সামিল। তাই সমস্যা শুরু হবার আগেই রানুদিকে এসএসসি পরীক্ষার পরপর শহরে পাঠিয়ে দেয়া হয় ছোটখালার বাসায় মানে আমাদের বাসায়। গ্রামীন শ্বাপদের উপদ্রপ থেকে রক্ষা পায় রানুদি। সেই বয়সে আমি ছিলাম রানুদির হাতের লাঠি কিংবা দেহরক্ষী। সার্বক্ষনিক সঙ্গী। ছেলেবেলা থেকেই রানুদি ছিল আমাদের পরিবারের খুব আপন। নিজের বোনের চেয়েও বেশী প্রিয় আমার। রানুদি ছিল একটা জীবন্ত গল্পের ঝুড়ি। ফলে তাঁর আগমন খুব কাংখিত ছিল আমাদের জন্য। ছোটরা সবাই আনন্দে হি হি মেতে উঠলাম তাঁকে দেখে। এখানে থেকেই কলেজে পড়াশোনা করবে রানুদি।

আলোকমান সৌন্দর্য যেখানে যায় সেখানেই আলো ছড়ায়। একদিন আমাদের বাসায় এক সুদর্শন যুবকের আগমন ঘটলো। নাম সাজু। নম্র ভদ্র অমায়িক যুবক অল্পদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় পাশ চুকিয়ে একটা কলেজে শিক্ষকতার কাজ নিয়েছে। অবসরে সঙ্গীতচর্চা করে, খন্ডকালীন সঙ্গীত শিক্ষক। মামাতো বোন শাহীন আপাকে গান শেখাতে এসে একদিন রানুদিকে দেখে মামার বাসায়। প্রথম দেখাতেই ভালোলাগা, অতঃপর ভালোবাসা। রানুদিও সমানে সমান। সেই থেকে সাজুভাই প্রায়ই আমাদের বাসায় চলে আসতো নানান ছুতোয়। রানুদির সাথে গল্প করতো ঘন্টার পর ঘন্টা। একদিন বিয়ের প্রস্তাবও দিয়ে ফেলে। আমার বাবা-মা প্রথমে সায় না দিলেও রানুদির বাবা মানে খালুর কাছে খবর গেলে খালু সানন্দে রাজী হয়ে যায়। এমন মার্জিত উচ্চশিক্ষিত যোগ্য পাত্র কেউ হাতছাড়া করতে চায় না। তেমন কোন আয়োজন ছাড়া হুট করে বিয়েটা হয়ে যায় আমাদের বাসায়ই। কয়েকমাস পর আলাদা বাসা নেয় সাজুভাই। রানুদির এই সংসার যাত্রায় আমরা খুব আনন্দিত। বেড়ানোর একটা জায়গা হলো। বছর না ঘুরতেই রানুদির কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে একটা কন্যা সন্তান। নাম রাখা হয় সেতু।

সেতুর বয়স যখন এক বছরের মতো, হঠাৎ একদিন রানুদি হাঁপাতে হাঁপাতে বাসায় এলো। সাজুভাই নাকি সেতুকে নিয়ে বেড়াতে যাবার কথা বলে কোথাও চলে গেছে গতকাল। এখনো ফেরেনি। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা সবাই ছুটলাম। পরিচিত সব জায়গায় খোজ নিলাম। না, কোথাও পাওয়া গেল না। কান্নাকাটির রোল পড়ে গেল বাসায়। রানুদি পাগলিনী হয়ে গেল। বহু খোজ খবর গোয়েন্দাগিরি করে মামা খালুরা সেতুর খোঁজ পায় কদমতলীর এঁদোগলির একটা বাসায়। তারপর অনেক থানা পুলিশ আদালত করে সেতুকে উদ্ধার করা হলো। জানা গেল সাজু পালানোর সময় এই বাসায় এক মহিলার কাছে সেতুকে রেখে যায়।

সাজুর পালানোর রহস্যটা কী। রানুদি আস্তে আস্তে সব বললো। বিয়ের পর থেকেই সাজুর অন্য একটা চেহারা দেখা যায়। রানুদি কাউকে বলেনি কারন রানুদি সাজুভাইকে খুব ভালোবাসতো, চায়নি তার অমর্যাদা করতে। সাজু ছিল মদ্যপ, অগনিত মেয়ের প্রতি আসক্ত, চরিত্রহীন, লম্পট। কোথাও বেশীদিন চাকরী করতো না। কলেজের চাকুরীটা ছেড়ে দেয় বিয়ের পরপর। তারপর আরেকটা ধরে। তারপর আরেকটা। এরপর বেকার। তারপর যৌতুক দাবী করে খালুর কাছে ব্যবসা অথবা বিদেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য টাকা চায়। খালুর অত টাকা দেবার সামর্থ্য ছিল না। চাকরী না করে খালুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে সংসার চালাতো। রাতে কখনো বাসায় ফিরতো কখনো ফিরতো না। কোথায় কী করতো রানুদি জানতো না। তখন থেকেই সাজু রানুদিকে ছেড়ে পালানোর চিন্তা করে। এই ব্যাপারগুলো পরে যখন জানলাম তখন ঘৃনায় রি রি করে উঠলো সবার শরীর। কিন্তু ততদিনে দেরী হয়ে গেছে।

ডিভোর্স ইত্যাদি শেষ হবার পর রানুদি নতুন জীবন শুরু করে। কলেজে ভর্তি হয় পাশ করে এনজিওতে কাজ নেয়, নিজের পায়ে দাঁড়ায়। রানুদির দ্বিতীয় বিয়ে হয় কয়েক বছর পর। তখন থেকে সেতুকে নানা-নানীর কাছে রেখে মানুষ করা হয়। সেতু বড় হতে থাকে, তবে বাবার পরিচয় অজ্ঞাত থাকে। সে শুধু জানে বাবা চলে গেছে মাকে ছেড়ে, কিন্তু পুরো ঘটনা গোপন রাখা হয় ওর বড় হবার অপেক্ষায়। স্কুলের উপরের দিকের ক্লাসে পড়ার সময় একদিন সেতুকে আমাদের বাসায় এনে আস্তে আস্তে ওর বাবার সব কাহিনী বলে শোনানো হয়। শুনে সেতু কাঁদেনি, কিছু বলেনি, কিন্তু পাথর হয়ে থাকে। শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। শোকে নাকি অপমানে জানি না।

আমাদের খুব কষ্ট হতো সেতুর কষ্টে। পরে আমরা আর কখনোই ওর বাবার প্রসঙ্গে কথা বলতাম না ওর সামনে। সেতু দেখতে খুব সুন্দর হয়েছে, রানুদির চেয়েও সুন্দরী। এত সুন্দর অথচ এত শান্ত মেয়েটি। সেতুকে আমরা কেউ রাগতে দেখিনি। সবসময় হাসিখুশী উচ্ছ্বসিত। কিন্তু ওর হাসিখুশী চেহারার পেছনে কি একটা বিপুল বেদনা লুকিয়ে আছে কেউ কী ভাবতে পারবে? কোন কোন মানুষকে বোঝা খুব কঠিন। ভাবতে খারাপ লাগতো, মা-মেয়ে দুজনের জীবন কত সুন্দর হতো যদি সাজু এই প্রতারনাটা না করতো। আমি ওকে কখনোই ক্ষমা করবো না। এটা আমার ব্যক্তিগত ক্ষোভ ছিল। সাজু টিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিল। বিটিভিতে গান গাইতো মাঝে মাঝে, নজরুল গীতির অনুষ্ঠানে দেখতাম। দেখে ঘৃনা আরো উপচে পড়তো। যদি সারা দেশের মানুষের কাছে এই প্রতারকের মুখোশ খুলে দিতে পারতাম? সাজুর খোঁজ খবর নেয়ার একটা সুত্র ছিল আমাদের, সেই সুত্রে খবর পেতাম সাজু আরো অন্তত ৪ টা মেয়ের সর্বনাশ করেছে রানুদির মতো। ৪র্থ বার পালাতে পারেনি। কারন ৪ নম্বর বউ কঠিন ছিল। সাজুকে বেঁধে ফেলেছে। ততদিনে সাজু ঢাকায় স্থায়ী হয়েছে, টিএন্ডটির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। নামকরা লোক। তবে ভয়ে চট্টগ্রাম আসতো না। চেষ্টা করতো কখনো যাতে চট্টগ্রাম বদলি না করে।

সেতু একদিন ঠিকানা যোগাড় করে চিঠি লেখে বাবাকে। আসলে রানুদিই ঠিকানা যোগাড় করে দিয়েছিল। রানুদি চাইতো সেতুর সাথে যেন বাবার সাথে যোগাযোগটা থাকে। হাজার হলেও আসল বাবা তো! আমরাও বারন করি না। সাজু সেতুকে একবার গোপনে দেখে যায়। তার বর্তমান স্ত্রী সন্তানগন জানেনা সে আগে কয়টা বিয়ে করেছে। সাজু ভয়ে থাকতো জানাজানি হবার। যোগাযোগ সৃষ্টি হবার পর আমরা ভেবেছিলাম সে অন্ততঃ সেতুর জন্য কিছু একটা করবে। কিন্তু না, সাজু চরম স্বার্থপর। কিছুই করেনি সে। অভিনয় পারদর্শীতায় সাজু যে কোন থিয়েটার কর্মীকে হার মানাতে পারবে। যোগাযোগ হবার পর চোখের জলে সেতুকে বুঝিয়েছে রানুদিই নাকি সাজুকে ছেড়ে পালিয়েছিল সেতুকে নিয়ে। সেতু সম্ভবতঃ আংশিক বিশ্বাস করেছে। বাবাকে বিশ্বাস করতে ভালোবাসতো সে।

মাষ্টার্স শেষ করার পর একদিন সেতুরও বিয়ে হয়ে যায়। স্বামীর নিজের দোতলা বাড়ী আছে শহরে, ব্যবসা আছে। বছর ঘুরতে সেতুর একটা মেয়েও হয়। রানুদি তৃপ্ত হয়। আমরাও। কিন্তু সেতুর বাবাহীনতার সেই অতৃপ্তি রয়ে যায়। ঠিকানা পেয়েও সে কিছুতেই বাবার কাছে পৌঁছাতে পারে না। বাবা তার সাথে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করে ঠিকই। কিন্তু দুরত্ব রেখে। তাই বাবার শূন্যতা কিছুতেই পুরন হয় না তার। বাবার স্নেহ পাবার জন্য বুকের হাহাকার থামে না। বাবার সাথে যোগাযোগে এত নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও সে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা চালিয়ে যায়। এমনকি ঢাকায় গিয়ে স্বামীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় বাবাকে। কিন্তু বাবা সু-অভিনেতা। সুবাক্যে তুষ্ট করে বিদায় করে কন্যা ও জামাতাকে।

আমরা ভুলে থাকি ওদের বাবা মেয়ের আন্তঃসম্পর্কের ব্যাপারগুলো। কয়েকবছর কেটে গেছে তারপর। গত সপ্তাহে আমাদের বাসায় একটা ফোন আসে। সেতুকে দেবার জন্য একটা খবর। সেতুর বাবা মানে সাজু তিন মাস আগে ঢাকায় মারা গেছে। সেতু চাইলে বনানীতে গিয়ে কবর জিয়ারত করতে পারে। খবরটা এতদিন দেয়া হয়নি কেন? কেউ জানে না। সাজুর বর্তমান ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে এখন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে, তারা কোনভাবে সেতুর ব্যাপারটা জেনে গিয়েছিল। তারাই গোপন রেখেছে। সেতুর সাথে বাবার যোগাযোগ হয়নি মারা যাবার শেষ কয়েকমাসে। গত তিনমাসে সেতু অসংখ্যবার ফোন করেছে বাবার মোবাইলে, কিন্তু অজ্ঞাত কারনে লাইন কেটে দেয়া হতো বারবার। সৎভাইয়েরাই কেটে দিতো সেতুর নাম্বার দেখে।

রানুদি সেতুকে নিয়ে ঢাকায় গিয়ে বনানীতে কবর জিয়ারত করতে গেল। একবার ভাবলো বনানীর ফ্ল্যাটে সাজুর বর্তমান পরিবারের সাথে কুশল বিনিময় করে আসে। কিন্তু ফোন করলে ওরা অস্বীকার করলো সেতুর সম্পর্ককে। অস্বীকার করাটাই স্বাভাবিক। অপমানিত হবার ভয়, রানুদিকে বিরত রাখলো ওখানে যাওয়া থেকে। আর ওখানে গিয়েই বা কী হবে। সেতু তো বাবাকে হারিয়েছে ১ বছর বয়সে। নতুন করে হারানোর কী আছে?

কিন্তু সেতু? সেতুর অনুভূতি কী? সংসার জটিলতার এই পঙ্কিল ভূমিতে সেতুর খাঁ খাঁ অনুভূতি, বাবা থেকেও বাবাকে কোনদিন না পাবার শূন্যতার বেদনা বর্ননা করার কোন ভাষা আমার জানা নেই। বাবার মৃত্যু কি সেতুকে নতুন কোন শূন্যতায় ফেলেছে? আমার কখনো সাহস হবে না জানতে। সেতুর মুখোমুখি হতেও ভয় পাই আমরা। জীবন কারো কারো জন্য এমন বিদঘুটে হয়ে যায় কেন?

রানুদি আর সেতুর জীবনের ঘটনাগুলো বিস্তারিত লিখতে গেলে গোটা একটা উপন্যাস হয়ে যাবে। পাঠকেরও ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে। কোন একদিন হয়তো উপন্যাসটা লিখতে পারবো। আজ শুধু দুই জীবনের এক উপখ্যানের সারাংশটুকুই দিলাম।

No comments: