Sunday, April 19, 2009

একাত্তরের দিনগুলি - চোখে বর্ষা নামানো বইটি

সিনেমা-উপন্যাসের সকরুন বেদনার্ত দৃশ্যগুলো মেয়েদের চোখেই বান ডাকবে- ছেলেদের নয়। কৈশোর থেকেই এই ধারনায় অভ্যস্ত আমি 'ছুটির ঘন্টা' সিনেমাটা দেখার সময় হলের আলো আঁধারিতে চুপি চুপি চোখ ভিজিয়েছিলাম স্কুলের বাথরুমে আটকা পড়া সেই ছেলেটার জন্য। হলের ধুসর আঁধারে কেউ দেখেনি সেই জল। ক্লাস এইটে পড়ছি তখন। সিনেমায় একবার চোখের জল ডাকলেও বই পড়ে তেমন ঘটনা এই বইপোকার জীবনে ঘটেনি তখনো। জাহানারা ইমামের 'একাত্তরের দিনগুলি' যখন ধারাবাহিকভাবে সচিত্র সন্ধানীতে ছাপা হচ্ছিল তখন আমি বেশ ছোট। মামার বাসায় সন্ধানী রাখা হতো, কখনো সখনো চোখেও পড়েছে, কিন্তু নিয়মিত পত্রিকা পড়ার বয়স হয়নি বলে আগ্রহও হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দেবার পর একদিন বইটা কিনলাম। নতুন বই কেনার পর সাধারনতঃ শেষ না করে উঠতে পারি না। খাওয়া দাওয়ার সময়ও বইটা পাশে থাকে। ডাইনিং টেবিলে ভাতের প্লেট আর বই দুটো পাশাপাশি থাকতো। মা বলতো- 'পাতে আর পাতায় - দুই চোখ দুই জায়গায়'। তবে একাত্তরের দিনগুলি পড়ার সময় শেষের দিকে এসে ডাইনিং ছেড়ে নিজের ঘরে চলে আসতে হয়েছিল। কারন চোখটা কেন যেন অনাকাংখিতভাবে জ্বালা করতো যেটা সেই বয়সে বিব্রতকর। রুমে এসে দরজা বন্ধ করে বইটা যখন শেষ করলাম চোখে আমার আষাঢ়-শ্রাবন, জলের ধারা গাল বেয়ে নামছে। কী লজ্জার কথা! এত বড় দামড়া তরুন, বিশ্ববিদ্যালয়ে চড়ে বেড়ায়, তার চোখে জল! অবিশ্বাস্য!!

'একাত্তরের দিনগুলি' একমাত্র বই যেটি পড়ে আমি অঝোরে কেঁদেছিলাম। রুমীর বয়সী ছিলাম বলেই কী? ভেবেছি প্রথমবার পড়েছি বলেই খারাপ লেগেছে। কিছুদিন পর দ্বিতীয়বার পড়লাম, তাও একই কান্ড। এক বছর পর তৃতীয়বার পড়লাম। নাহ চোখের ভিজে ওঠা থামাতেই পারি না।

মাঝে মাঝে ভাবি, ১৯৭১ সালে যিনি স্বামী সন্তান হারিয়েছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন, এমন একটা জীবন্ত ডায়েরী জাতিকে উপহার দিয়েছেন, তাঁকে বাংলাদেশ কী দিয়েছে? অপমান, অবমাননা আর দেশদ্রোহীতার অভিযোগ ছাড়া কী পেয়েছেন তিনি শেষ জীবনে?

তাঁর সন্তান হারানোর বেদনার সাথে জাতীয় চেতনার সাজুয্য কোথায়? রুমী কী সমগ্র মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করে? ভূমিকায় এর খানিক উত্তর দেয়া আছে-

'বুকচেরা আর্তনাদ নয়, শোকবিহবল ফরিয়াদ নয়, তিনি গোলাপকুঁড়ির মতো মেলে ধরেছেন আপনকার নিভৃততম দুঃখ অনুভুতি। তার ব্যক্তিগত শোকস্মৃতি তাই মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় আমাদের সকলের টুকরো টুকরো অগণিত দুঃখবোধের অভিজ্ঞতার সঙ্গে, তাঁর আপনজনের গৌরবগাঁথা যুক্ত হয়ে যায় জাতির হাজারো বীরগাঁথার সঙ্গে।'

সত্যিই তাই নয় কী?

মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত চেতনা রক্ষাকারী অতীব প্রয়োজনীয় এই বইটা কী জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে অন্তর্ভূক্ত করা যায় না?

No comments: