'ফেলানন্দ' বলে কোন শব্দ বাংলা অভিধানে আছে কিনা জানা নেই। ব্যাপারটা সোনার পাথর বাটি ধরনের। পরীক্ষায় ফেল করে এক দঙ্গল ছোকরা আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে এরকম দৃশ্য খুব বাস্তব নয়। কিন্তু সেরকম একটা বিরল ঘটনার অংশীদার হয়েছিলাম ১৯৮৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর। এলাকার ১৫ জন পরীক্ষার্থী বন্ধুর প্রত্যেকের কোন না কোন পরীক্ষা খুব খারাপ হয়েছিল। সবগুলো পরীক্ষা ভালো হয়েছে এরকম একজনও ছিল না। পত্রিকায় রেজাল্ট প্রকাশের আগের দিন টুটুল খবর দিল আজ বিকেলে সিটি কলেজের নোটিশবোর্ডে ফলাফল টাঙানো হবে। দুজনেরই ম্যাথ পরীক্ষা চরম খারাপ হয়েছে। অতীব দয়ালু টিচার হলেও বড়জোর বিশ-বাইশ দিতে পারবে। তেত্রিশ ওঠার কোন সম্ভাবনাই নেই। বাকীদের অবস্থাও নানান বিষয়ে একই। কেউ ফিজিক্সে, কেউ কেমিষ্ট্রিতে, কেউ ম্যাথে।
টুটুল বললো -'কুছ পরোয়া নেহি - মনটা শক্ত কর। পরাজয়ে ডরে না বীর। ষ্টেশান রোডে নতুন 'ক্লিফটন' নামে একটা এসি রেষ্টুরেন্ট খুলছে । বিশাল মজার বিরানী। রেজাল্টে নাম না থাকলে আজকে ওইখানে রাতের দাওয়াত আমাদের।' কয় কী হারামজাদা। বিরানী দিয়ে ফেল উদযাপন? আমি অবাক হয়েও চমৎকৃত হলাম ওর বুদ্ধিতে। টুটুল বরাবরই রসিক। সৈয়দ মুজতবা আলীর সব রস কাহিনী ওর মুখস্থ। আশ্বস্ত হলাম।
ফেলানন্দের আধ্যাত্মিক যুক্তিও বের করা গেলো। পাশ-ফেল সব আল্লাহর ইচ্ছা। ফেল নিয়ে মন খারাপ করে আল্লার ইচ্ছার বিরোধিতা করবো নাকি? দুজনে পঞ্চাশ-পঞ্চাশ একশো টাকা পকেটে নিয়ে সন্ধ্যার মুখে কলেজে গেলাম। প্রচন্ড ভীড়। উঁকি ঝুঁকি মেরে যা বোঝার বুঝে গেলাম। থার্ড ক্লাস থেকে দেখা শুরু করে সেকেন্ড ক্লাস পর্যন্ত হালকা চোখ ঘুরিয়ে বের হয়ে এলাম। নেই। থাকলেই অবাক হতাম।
মন খারাপের ধার দিয়েও গেলাম না। সোজা হন্টন দিলাম ক্লিফটন পানে। তৃপ্তির সাথে পেটপুরে চিকেন বিরিয়ানী খেয়ে বোরহানির ঝাঁঝ ঢেকুর তুলতে তুলতে বাসায় ফিরলাম রাত নটার দিকে। মাকে বললাম- দাওয়াত ছিল, খেয়ে এসেছি। রেজাল্ট বিষয়ে টুঁ-শব্দ করলাম না। রাত দশটার দিকে বন্ধুদের আনাগোনা বাড়তে লাগলো। ছাদে বসে ফিসফাস করতে করতে যতটুকু জানলাম পারভেজ বাদে পাড়ায় আর কেউ সরস্বতীর আশীর্বাদ পায়নি।
সমবেত বন্ধুদের বিমর্ষভাব লক্ষ্য করে টুটুল আর আমি ঝেড়ে কাশলাম। সমাবেশকে আমাদের ফেল পরবর্তী বিরিয়ানী ভোজনের সংবাদ দিলাম। শুনে ফেলটু সমাজ যেন প্রান ফিরে পেল। তাই তো? পাশ-ফেল আল্লাহর ইচ্ছা। আমরা কী তার চেয়ে বেশী বুঝি। আল্লা যা করছে, ভালোর জন্যই করছে। একজন বললো- 'চল কাপ্তাই যাই কাল সকালে'। দি আইডিয়া- সাথে সাথে পরিকল্পনা হলো আগামীকাল সম্মিলিতভাবে ফেল উদযাপন করা হবে। কেউ দ্বিমত করলো না। কারন শহরের বাইরে কোথাও চলে গেলে অভিভাবক সমাজের কোপদৃষ্টি থেকেও রক্ষা পাওয়া যাবে।
পরদিন ভোরে ব্যস্ত হয়ে রওনা দিচ্ছি এমন সময় হকার পত্রিকা দিয়ে গেলো। প্রথম পাতায় ষ্ট্যান্ড করা নাদান ছেলেমেয়েদের হাসিখুশী মুখ, আমার ভেতরে কেমন গুড়গুড় করে উঠলো, অরুচি লাগলো তাকাতে। নিতান্ত অবহেলায় পত্রিকাটা সোফার তলায় ছুঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। বাবা তখনো ঘুমে - মাকে বলেছি পিকনিকে যাচ্ছি।
সারাদিন কাপ্তাই লেকে নৌকা নিয়ে ঘোরাঘুরি, পানিতে দাপাদাপি, রামের পাহাড়, সীতার ঘাট সবকিছু ঘুরে শিলছড়ি বাজারে এসে দুপুরের খাবার খেলাম শেষ বিকেলে। আহা কী স্বাধীনতা, কী আনন্দ। উচ্ছ্বাসের তোড় এত বেশী ছিল যে সীতার ঘাটে গোসল করার সময় সাঁতার না জানা আমি ঘাটের পাথরে পিছলা খেয়ে লেকের পানিতে পড়ে গেছি সেটা বুঝতে সবার মিনিট খানেক লেগেছিল। আমার মরন চিৎকারে মাঝি তৎক্ষনাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে উদ্ধার করে। ভাগ্যিস টের পেয়েছিল নইলে ভবলীলা ওখানেই সাঙ্গ হতো। সেই মাঝির কাছে আমি আজীবন ঋনী।
বিকেলের ফিরতি বাসে শহরমুখী যাত্রায়ও আনন্দের কমতি নেই পিকনিক ফেরত তরুন দলের। বাস থেকে নেমে রিকশায় ওঠার পরই আসল চিন্তা শুরু হলো। এলাকায় ইতিমধ্যে শোকের বন্যা বয়ে যাবার কথা। কলিজায় দুরু দুরু কম্পন। বাবার রাগী চেহারাটা কল্পনা করলাম।
বাসায় ঢুকতেই মা বললো - 'আজ তো রেজাল্ট দিছে।'
আমি আজলের মতো বললাম- 'তাই নাকি, কই দেখি?'
মা বললো - 'কী দেখবি, নেই তো।'
আমি যেন অবাক - 'নেই মানে?'
মা বললো - 'তোর রোল নেই।'
আমি আরো আজীব হলাম- 'মা তুমি এসব কী বলছো?'
মা মন খারাপ করে বললো - 'তোর নাম তো ওঠে নাই পেপারে। কী করে যে এমন হলো?'
শুনে আমি চেহারায় তীব্র হতাশা ও ক্রন্দনপূর্ন বিমর্ষভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম। কতটা পারলাম জানি না। কিন্তু মায়ের মন যে তাতে গলে গেল টের পেলাম পরবর্তী সংলাপে।
- 'মন খারাপ করিস না, বাবা। আরো কত ছেলেই তো ফেল করেছে। তুই একা না। তোর বাবা রাগ করেছে কিন্তু আমি তাকে বুঝিয়েছি। তুই আরো মন দিয়ে পড়, পরীক্ষা দিবি আবার।'
বাবাকে ম্যানেজ করা গেছে শুনে আমার বুকের ভেতর থেকে একটা বটগাছ নেমে গেল। পলিথিনের বালিমাখা ভেজা কাপড়গুলো খাটের নীচে চালান করে দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলাম।
পরদিন বিকেলে টুটুলকে নিয়ে একমাত্র পাশবন্ধু পারভেজের বাসায় গেলাম। ওর মা জানে না আমরা সবাই জামাতের সাথে ফেল করেছি। খালাম্মা আমাদের মিষ্টি খাইয়ে জানতে চাইলঃ
-'তোমাদের কী খবর বাবা?'
-'জী খালাম্মা মোটামুটি।'
-'রেজাল্ট কী?'
-'ভালো না।'
-'ফেল?'
-'না না ফেল হবে কেন, এই থার্ড আর কি।' খুব লজ্জায় কোনমতে বলতে পারলাম।
কিন্তু ওখান থেকে বেরিয়ে টুটুল আমার উপর হুপপা গরম।
-'গাধা!!!, তুই থার্ডক্লাস বললি কেন? মিথ্যে যখন বললি সেকেন্ডই বলতি। থার্ড তো ফেলের চাইতেও খারাপ। অনেকে ফার্স্ট ক্লাস মার্কস পেয়েও ফেল করে। কিন্তু থার্ডক্লাস তো জন্ম গাধা। তুই ডোবালি, খালাম্মার কাছে ইজ্জত রইলো না।'
ইজ্জত মারা যাবার ব্যাপারটা বুঝে আমি চুপ। চির হাঁটুবুদ্ধির আমি আসলে মিথ্যাটা হালকা করতে গিয়েই গুবলেট করে ফেলেছিলাম। ভেবেছিলাম থার্ড ক্লাসের পরেই ফেলের অবস্থান। সেকেন্ড বললে মিথ্যাটা একটু কঠিনই হয়ে যায় কিনা!
একটা দারুন শিক্ষা হলো। কোন কোন ফেল থার্ড ক্লাসের চেয়েও সম্মানজনক।
No comments:
Post a Comment