Sunday, April 19, 2009

একটি অপরিণত গল্প

দেওয়ানহাট ওভারব্রীজের টাইগারপাসের অংশে পশ্চিম রেলিংটার নির্দিষ্ট একটা অংশে প্রতিদিন একটা কালো প্যান্ট পড়া খালি গা উস্কোখুস্কো মানুষকে বসে থাকতে দেখি। কোনদিন দেখি বসে আছে, কোনদিন শুয়ে বা ঘুমিয়ে, কোনদিন আবার রেলিংটা দুহাতে জড়িয়ে ধরে ব্রীজের বাইরের দিকে ঝুলে আছে। অদ্ভুত লাগতো। পাগল কিসিমের মানুষ, হয়তো পুরোপুরি পাগলই। কিন্তু এরকম অদ্ভুত জায়গায় কেন আস্তানা গেড়েছে, তা নিয়ে আমার ভেতরে একটা ব্যাপক কৌতুহল তোলপাড় করছিল অনেকদিন। মানুষকে জানার কৌতুহল আমার। কিন্তু পাগলের সাথে কথা বলা বিপজ্জনক। সাহস হয় না।

তবু একদিন কৌতুহল বিজয়ী হলো। অফিস থেকে ফেরার পথে গাড়ী থেকে নেমে পড়লাম ব্রীজের ওই জায়গাটায়। পাগলটা যথারীতি বসে আছে পা ঝুলিয়ে। আমি পাশে গিয়ে রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। সিগারেট ধরিয়ে আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম লোকটা কতটা পাগল। পুরো পাগল হলে বাতচিত করা দুষ্কর হবে। লোকটার চেহারা মলিন হলেও চোখটা তীক্ষ্ণ। আমার দিকে চেয়ে ব্যাঙ্গের হাসি হাসলো। তারপর আমাকে পুরো চমকে দিয়ে অত্যন্ত শুদ্ধ উচ্চারনে বরে উঠলো, "এক্সকিউজ মি- ভাইজানকে চেনা চেনা লাগছে। সিগ্রেট হবে নাকি একটা?"

আমি চমকটা সামলে নিয়ে পকেট থেকে সিগারেট বের করে এগিয়ে দিলাম। সে ফস করে দিয়াশলাই জ্বালিয়ে সিগারেট ধরিয়ে বললো, "থ্যাংক্যু"।

তারপর চুপচাপ। আমি কিছুক্ষন উসখুশ করে সংলাপ শুরু করলাম।
-নাম কী আপনার?
-আবুল হোসেন
-কী করেন?
-কিছু করি না
-কেন?
-সেটা দিয়া আপনার কী দরকার?
-না এমনি জানতে চাইলাম।
-আপনি বেনসন খান কেন?
-খাই, ভালোলাগে
-সিগারেট খুব খারাপ, আপনার ফুসফুসে ক্যানসার হবে
-জানি।
-জানেন তবু খান। আপনে একটা পাগলা হে হে হে....
-আপনার জীবনের গল্প বলেন
-নাই।
-নাই?
-না।
-আছে, যেটুকু পারেন, বলেন।
-আরে বললাম তো নেই।
-আপনাকে তো শিক্ষিত লোক মনে হয়।
-আমি এমএ পাশ।
-বলেন কী, আপনাকে দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল আপনি শিক্ষিত। আপনি বলেন, আমার শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে।
-তাইলে আরেকটা সিগ্রেট দেন। খিদা লাগছে। ওই চা ওয়ালা আসছে। চা-রুটি খাব।

আমি পাউরুটি আর চা নিলাম ভ্রাম্যমান চা-ওয়ালার কাছ থেকে। আবুল হোসেন তৃপ্তির সাথে আস্ত পাউরুটি খেয়ে ফেললো দুই কাপ চা দিয়ে। তারপর শুরু করলোঃ

"যোগ্যতা ছিল না ভালো রেজাল্ট করার। যোগ্যতা ছিল না সমাজে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বাঁচার। দারিদ্র ছিল প্রতি পদক্ষেপে। আশির দশকের শেষ থেকে নব্বই দশকের অনেকাংশ কেটেছে অভাবে অনটনে। ভার্সিটিতে যেতাম নামকা ওয়াস্তে। পড়াশোনার কোন বালাই ছিল না। ভালোছাত্র হবার কোন ইচ্ছে ছিলনা। যেতাম ঠিকই কিছু ক্লাস করতাম, বেশী আড্ডা দিতাম, বিনা পয়সার আড্ডা, ব্যর্থ টাংকিবাজি করতাম। কোন মেয়ে পাত্তা দিত না। মামাতো বোন চম্পাকে ভালোবাসতাম, সেও বোধহয় বাসতো। যদিও কখনো বলেনি, তবু সেটাই আমার একমাত্র সুখ ছিল সেইসব দিনে। আমাদের এত অভাবেও সে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। তাকে ভালোবাসতাম তার কাজল কালো চোখ দুটোর জন্য। আমি পাগল হয়ে যেতাম যখন সে গভীরভাবে তাকাতো আমার চোখে।

স্কুলে থাকতে ভালো করে অংক পারতাম না, গ্রামার বুঝতাম না। পড়াশোনায় পুরোদস্তুর ফাঁকিবাজি। আমার ভালো লাগতো না ক্লাসের পড়াশোনা। বাইরের বইয়ের প্রতি বেশী আকর্ষন ছিল। গল্প বই পড়তাম। জীবন নিয়ে হতাশায় ভুগতাম। পরিবারে একটা অশান্তির পরিবেশ ছিল। বাবা মা ভালো সম্পর্ক রাখতেন না পরস্পরের সাথে। গালিগালাজ ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকতো। সেরকম একটা পরিবারের সন্তান কখনো ভালো করবে সেটা কেউ আশা করতো না। আমার ভালো করার ইচ্ছেও ছিল না। বন্ধুদের মধ্যে, আত্মীয়দের মধ্যে আমার চেয়ে দরিদ্র আর কেউ ছিল না। আড্ডায় বন্ধুদের সাথে হো হো করে হেসে তাল মেলাতাম ঠিকই, কিন্তু জানতাম না তা ঘরে ফিরে কোন খাবার পাবো কি না। দৈনিক খাবারের মধ্যে ছিল ময়লা পুরনো গন্ধওয়ালা চালের ভাত, কচুর তরকারী, একটা ডিমভাজি যা ছয় টুকরা করা হতো। মেহমান আসলে তো বিপদেই পড়তাম। আমাদের নিয়মিত তরকারী ছিল মটর ডাল দিয়ে শুটকি ঝোল কিংবা কাঁচকলার ঝোল। ছয় টুকরার একটা ডিম মামলেট অবশ্য থাকতো। আহ কী অভাব। এমনকি ঈদের দিন কী খাবো তাও জানতাম না। কাপড়চোপড় কেনা তো বাহুল্য ছিল।

একবার ঈদের সময় ফুটপাত থেকে চল্লিশ টাকা দিয়ে একটা সাদা শার্ট কিনে ধুয়ে শুকোতে দিলাম ঈদের দিনের জন্য, কারন পাঞ্জাবী কেনার টাকা নেই। বন্ধুরা যখন আড়ং এর পাঞ্জাবী কিনতো, আমি দীর্ঘশ্বাস গোপন করতাম। লুকিয়ে একবার আড়ং গিয়ে সবচেয়ে সস্তা সুতীর পান্জাবীর দামটা দেখে আসলাম। ১৯৫ টাকা। আমার ভীষন ইচ্ছে করতো জীবনে একবার আড়ংএর পান্জাবী কেনার। দাম দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। দুশো টাকা কোথায় পাবো। মাকে বলেছিলাম অবশ্য আড়ংয়ের সবচেয়ে সস্তা পাঞ্জাবীটার দাম। হয়তো মা বাবাকে বলেছিল সে কথা। ঈদের আগের দিন আমার চল্লিশ টাকার শার্ট উঠোনে শুকাতে দেখে বাবা ভাবলেন আমি মন খারাপ করছি। তাই দুশো টাকা হাতে দিয়ে বললেন পান্জাবীটা কিনে আনতে। টাকাটা নিতে আমার ভয় লেগেছে, কারন ঈদের বাজার করার টাকাও বাবার নেই। ঈদের দিন কী খাবো জানি না। হয়তো মা কোন ব্যবস্থা করে ফেলবে। চটপটি বা সেমাই। তো সেই ২০০ টাকা হাতে নিয়ে চৌমুহনীতে আড়ংএর শো রুমে গেলাম। সেই পান্জাবীটা নেড়ে চেড়ে দেখলাম, কিন্তু কেন যেন সাহস হলো না। বাসে করে চলে গেলাম কোতোয়ালির খাদি ঘরে। ওখান থেকে ১২০ টাকা দিয়ে খাদি পান্জাবী কিনলাম। ৮০ টাকা বাঁচলো। সে টাকায় ঈদের দিনের খরচ চলবে।

অযোগ্য আমি মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করার পর একটা কোম্পানীতে যোগ দেই দুই হাজার টাকায়। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে রাত এগারটা পর্যন্ত কাজ করতে হয়, কোন সাপ্তাহিক ছুটি নেই। তিন মাসে একদিন ছুটি। মাসে একদিন ছুটি ঘোষনা করা হলে কী যে খুশী লেগেছিল! সেই আমি খারাপকে ভালো করে তুলতে লাগলাম। বাধ্য হয়ে কঠিন পরিশ্রম করা শুরু করলাম। বেতনের বেশীরভাগ চলে যেতো গাড়ীভাড়ায়। তবু মার হাতে এক হাজার টাকা দেই মাসে। সে টাকায় কী হয় তার খোঁজ রাখি না। কয়েক মাস পর বেতন একটু বাড়লো - ৩ হাজার। তখন বাবার হাতেও এক হাজার দেয়া শুরু করলাম। সেই টাকায়ই আমি খুশী। আমার মতো ছাত্র এর চেয়ে ভালো চাকরী পাবে না সেটা নিশ্চিত।

সেই আমি যখন চাকরীতে প্রমোশন পেয়ে ১০ হাজার টাকা বেতন পাওয়া শুরু করলাম তা আমার পরিবারের জন্য বিশাল একটা সুসংবাদ ছিল। প্রবল খরায় এক পশলা বৃষ্টি যেন। তারপর ধাপ ধাপ করে দ্রুত উন্নতির শিখরে পৌছালাম পাঁচ বছরের মধ্যে। গাড়ী কিনলাম, আধুনিক ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম। বিয়ে করলাম জাঁকজমকের সাথে। ফুটফুটে একটা কন্যার বাবা হলাম। এক বছর বয়স থেকেই আমার মেয়ে বাবা-মার মাঝখানে ঘুমানোর আরামটা শিখে ফেলে। কোনদিন এর ব্যতিক্রম হতে পারতো না। বয়স দুই বছর হবার পর নতুন বায়না। বাবার সাথে বাইরে যাবে, বাবার সাথে খেলবে, বাবার হাতে খাবে, বাবার বুকে ঘুমোবে। বাবা যেন ওর সব সুখ। বাবাও মেয়েকে ছাড়া একদন্ড থাকতে পারতো না। ছুটির দিনে কোথাও যেতো না মেয়েকে ছেড়ে। এত নেওটা ছিল বাবা-মেয়ে দুজন দুজনের। বছরে একবার সপরিবারে চলে যেতাম নেপাল, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর। অতীতের সব কষ্ট কখন মুছে গেছে। শুধু সুখ ছিল, আহা কত সুখ । আহা কত সুখ......আহা কত সুখ.......আহা কত সুখ......."

আবুল হোসেনের সুখ-দুখের গল্পে আমি এতই বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম যে দারুন চমকে উঠলাম যখন সে গল্পের মাঝখানে হঠাৎ 'এক্সকিউজ মি, জাষ্ট এ মোমেন্ট প্লীজ' বলে আমার দিকে পেছন পেছন ফিরে ব্রীজের রেলিংটা একহাতে ধরে প্যান্টের জিপার খুলে প্রাকৃতিক কর্ম শুরু করে দিল।

আমার অস্বস্তি লাগছিল হঠাৎ তার এরকম বেয়াড়া কান্ড দেখে। কিন্তু ওর গল্প শেষ হয়নি এখনো, যাই কী করে? প্রাকৃতিক কর্মটি শেষ করে আবুল হোসেন অস্তমিত সূর্যের পানে উদাস চোখ মেলে গুনগুন করতে লাগলো। আমি যে একজন পাশে আছি, আমার সাথে যে সে গল্প করছিল যেন ভুলেই গেছে। আমি কয়েকবার ডাকলাম, সে আমার দিকে কেমন অচেনা দৃষ্টিতে তাকালো। একটু আগের ঘটনা তার মনেই নেই বোধহয়। ঘটনার শেষটুকু জানতে না পেরে আমার ভেতরে একটা অতৃপ্তি কুটকট করতে লাগলো। কিন্তু সে আর আমার দিকে তাকালোই না। অন্য কোন ঘোর লাগা জগতে চলে গেছে। আমি আর পাগলকে ঘাটালাম না। অতৃপ্তি নিয়েই ফিরে এলাম ঘরে। ভাবলাম আরেকদিন গিয়ে খাতির করবো। ওর জন্য সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে যাবো একটা, কিছু খাবারও।

কিন্তু পরদিন থেকে আবুল হোসেনকে ওখানে দেখা গেল না আর। কী করে তার এমন পাগলদশা হলো, কেন সে ব্রীজের ঠিক সেই জায়গাটায় বসে থাকতো, কোন রহস্যের কিনারা হলো না। মানুষের জীবনের কত অদ্ভুত পরিণতিই না ঘটে!

No comments: