Sunday, April 19, 2009

জানিদুস্ত

পুটুল বা পুটলা আমার বাল্যকালের জানিদুস্ত। ক্লাস থ্রী থেকে শুরু । প্রথমে সাধারন ক্লাসমেট, তারপর জানিদুস্ত। দোস্তামি গাঢ় হবার একটা ঘটনা আছে।

একদিন বাংলা ও অংক ক্লাসের বিরতিতে ছেলেমেয়েরা ক্লাসে বাঁদরামির রিহার্সাল দিচ্ছিল। পুটুল হঠাৎ একটা চিরকুটে কি জানি লিখে আমার সামনে দিল। খুলে দেখি লেখা আছে 'হাসান+শামী'। শামী আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে শান্ত ভদ্র সুন্দর মেয়েটা। আমি তো চরম হাবা, তাই ব্যাপার কিছু বুঝি নাই। কিন্তু নব্য চোট্টামি বুদ্ধিতে মনে হলো এর একখান পাল্টা জবাব দেয়া দরকার। কিছু না বুঝেই লিখলাম 'পুটুল+লাভলী'। লাভলী আমাদের ক্লাসের ফার্স্টগার্ল এবং সবচেয়ে লম্বা মেয়ে। লিখেই বুঝলাম যথাযোগ্য উত্তর হয়েছে। কারন পুটলা লাভলীর নাম দেখে মজা পেল। হাসাহাসি করে চিরকুট দুটো ক্লাসের বাইরে ফেলে দিয়ে আসলাম দুজনে।

টিফিন পিরিয়ডে দফতরী এসে বললো, 'হেডস্যারে বুলায়'। আমার পেটে কী একটা ভয়ানক পাক দিল। স্যার মানে যম, আর এখন ডাক দিয়েছে হেডস্যার। না গিয়ে উপায় নেই। দুজনেই গেলাম এবং দেখলাম হেডস্যার চোখ লাল করে বসে আছে, হাতে আমাদের সেই চিরকুট দুটো। কেউ হেডস্যারকে কাগজ দুটো কুড়িয়ে এনে দিয়েছে। ঘটনা বুঝলাম, তবে অপরাধটা ঠিক মালুম হলো না। অংক খাতায় একের সাথে দুই যোগ করা যায়, কিন্তু মানুষের সাথে মানুষের নাম যোগ-বিয়োগ করলে অসুবিধা কোথায়।

আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ না দিয়ে গমগমে গলায় হুকুম এলো, 'স্কুল ছুটি না হওয়া পর্যন্ত দুজন দুজনের কান ধরে এখানে দাঁড়িয়ে থাক।'

বিমর্ষমুখে দুজন দুজনের কান ধরে দাড়িয়ে আছি। চোখাচোখি হতেও লজ্জা লাগছে। হঠাৎ মৃদু আলোড়নের শব্দ এলো বাইরে থেকে। তাকিয়ে দেখি কয়েক ডজন বিনোদন পিয়াসী বালক- বালিকা হেডস্যারের জানালায় ভীড় করে দাড়িয়ে আছে, পর্দা ফাঁক করে সিনেমা দেখছে। তাদের চাপা হাসির শব্দই ভেসে আসছিল। এরকম একটা দৃশ্যের জন্য বহুকাল যেন অপেক্ষায় ছিল তারা। লাভলীকেও দেখা গেল ভীড়ের মধ্যে। অপমানের রক্তসরনে আমাদের দুজনের কান ফেটে যাবার দশা। তার মধ্যেও বুঝলাম এটা লাভলীরই কাজ। ওই শয়তান মেয়েটা নিশ্চয়ই কাগজটা কুড়িয়ে হেডস্যারের হাতে দিয়েছে। তোর কোন ক্ষমা নাই- পুটুল আর আমি ফিসাফিসি করে চোখাচোখি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। প্রতিশোধের ঘটনাটা ঘটেছিল ২৪ ঘন্টার মধ্যেই। সেই গল্প আরেকদিন।

কিন্তু সেই ঘটনার পর পুটুল আর আমি জানিদুস্ত হয়ে গেলাম। বিএ পাশ করার পর পুটুল চাকরী নিয়ে দেশের বাইরে চলে গিয়েছিল, সেও আজ প্রায় বিশ বছর। আমিও বাসা বদলে অন্য এলাকায় চলে যাই। ওর সাথে কোনরকম যোগাযোগ ছিল না। কয়েকমাস আগে স্কুলের একটা পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে এক বন্ধু সামনের সারিতে বসা কালো, মোটা, টেকো, আধাপাকা চুলের একটা মাথা দেখিয়ে বললো - 'এটাকে চিনতে পারিস?' আমি বললাম -'না'। বন্ধুটি বললো - 'এই হলো পুটুল'।

'অ্যাঁ বলিস কী? এই টাউক্যা আমাদের সেই পুটলা? আমার জানিদুস্ত?' আমি খুশীতে এক লাফে গিয়ে পুটলার সামনে দাঁড়ালাম। বলতে ইচ্ছে হলো -এই টেকো আমাকে চিনতে পারিস? কিন্তু মুখে বললাম- 'চেনা যায়?'

পুটুল গভীর ভাবে আমাকে নিরীক্ষা করলো মিনিট খানেক। তারপর ভদ্রলোকী ভাষায় বলে উঠলো- "আরে আপনাকে আমার তখন থেকেই চেনা চেনা মনে হচ্ছিল, আপনার সাথে শারজায় পরিচয় হয়েছিল না? কেমন আছেন ব্রাদার?"

আমি ধপাস করে পাশের চেয়ারে বসে গেলাম। দম নিয়ে পুটলার কলারটা চেপে ধরে টাক মাথায় একটা চাটি মারার প্রস্তুতি নিচ্ছি।

No comments: