Sunday, April 19, 2009

গ্রামীন ব্যাংক ও ডঃ ইউনুস

ব্লগে সম্প্রতি ডঃ ইউনুস এবং গ্রামীন ব্যাংক নিয়ে কয়েকটা লেখা পড়ার পর আমাদের গ্রামে গ্রামীন ব্যাংকের দুজন গ্রাহকের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না।

১. মর্জিয়া বেগম গৃহবধু। গ্রামীন ব্যাংক থেকে সেলাই মেশিন কেনার জন্য ৩ হাজার টাকা ঋন নিয়ে শখের টিভি কিনে ফেলেছিল বলে কিস্তির টাকা পরিশোধে সমস্যায় পড়ে। কারন টিভি থেকে কোন আয় বের হয় না। গ্রামীন ব্যাংক কিস্তি পরিশোধে ক্রমাগত চাপ দিলে দলের অন্যন্য সদস্যদের সহায়তায় তার বড় ভাই বাড়তি সময় নিয়ে কিস্তির টাকা পরিশোধ করে। টাকা না পেয়ে টিনের চালা বা গরু বাছুর নিয়ে যাবার মতো পরিস্থিতি হয়নি। হয়তো ব্যাপারটা আপোষে সমাধা হয় বলে তেমন সমস্যা দেখা দেয়নি। কিন্তু যদি না হতো? টাকা পরিশোধ না করলে গ্রামীনব্যাংক কর্মী কী করবে? আমরা বাড়ী করার জন্য ঋন নিয়ে সময়মতো ঋনের টাকা পরিশোধ না করলে তফসিলী ব্যাংক বা হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স কী করে? বাড়ী দখল করে বা নিলামে তোলে। গ্রামীন ব্যাংকের ঋন পরিশোধ না হলে ব্যাংক কর্মী কী করবে? গরীব মানুষের সামান্য টাকা, তাই সেই টাকা মওকুফ করে দেবে? করা যায়? বলতে পারেন কিছু কিছু মওকুফ করে দেয়া যায়। কিন্তু কয় জনকে মওকুফ করবে? মওকুফ করার নিয়ম থাকলে টাকা নিয়ে কেউ কি ফেরত দেবে? আপনি দেবেন? আমি দেবো?

২. নুর মোহাম্মদ রিকশা চালায় আর বউ গেরস্থালি কাজ করে। তারা দুজন গ্রামীন ব্যাংক ও আরো কয়েকটা এনজিও থেকে ঋন নিয়ে বাড়তি আয়ের জন্য এটা সেটা করে। তাদের দুই সন্তান। ছেলেটা এসএসসি পাশ করেছে, মেয়েটা প্রাইমারীতে। ছেলের মামা দুবাইতে চাকরী করে, সে জানিয়েছে দুবাইতে অটোমোবাইল ইন্জিনিয়ারের খুব দাম। তাই নুর মোহাম্মদ ছেলেকে অটোমোবাইল ইন্জিনিয়ার বানাবার স্বপ্ন দেখে। গত বছর সে গ্রামীন ব্যাংক থেকে বিশ হাজার টাকার ঋন নিয়ে তার ছেলেকে চট্টগ্রাম শহরের মুরাদপুরে একটা প্রাইভেট টেকনিক্যাল কলেজে ভর্তি করিয়েছে দুবছরের অটোমোবাইল কোর্সে। ছেলে পাশ করে দুবাই গেলে তার কষ্ট লাঘব করবে। ছেলে এবছরের শেষে বের হবে। হয়তো তাঁর স্বপ্নপূরন হবে। এদিকে গ্রামীন ব্যাংকের ঋন পরিশোধ না করলে মুশকিল। কিভাবে পরিশোধ করবে? তার উপায়ও সে ভেবে রেখেছে। রিকশা চালিয়ে সে কিছু টাকা জমিয়েছে, বাকী টাকা আরেকটা এনজিও থেকে নিয়ে পরিশোধ করবে। এভাবেই এদিকের মাল ওদিকে দিয়ে সে ম্যানেজ করে। কিন্তু গ্রামীন বা সেরকম প্রতিষ্ঠান যদি না থাকতো, তাহলে সে কীভাবে ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতো। তার ছেলেও হয়তো রিকশা চালাতো।

উপরে ঋন বিষয়ে দুজনের ক্রিয়া ভিন্ন কিন্তু প্রতিক্রিয়া এক। মর্জিয়া বেগম এবং নুর মোহাম্মদ দুজনকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম গ্রামীন ব্যাংক নাকি টাকা ফেরত না দিলে অত্যাচার করে। দুজনেই হাসলো। ওদের বক্তব্যটা মোটামুটি এরকম, ‘শুধু গ্রামীন ব্যাংক না, যে কোন এনজিওর টাকা ফেরত না দিয়ে উপায় আছে? ঋন নিবেন কিন্তু ফেরত দিবেন না তাইলে কী আপনেরে আদর করবো? কেউ করে? বরং মহাজনের অত্যাচারের চেয়ে এরা হাজারগুন ভালো।’ ওরাও মনে করে না গ্রামীন ব্যাংক অযৌক্তিক কাজ করছে। বরং একটা উসিলা করে আপদে বিপদে টাকা পাওয়া যায় সেটাই বড় কথা। এই দুজনের কথা শুনে গ্রামীন ব্যাংকের নির্যাতন নিয়ে যারা হৈচৈ করে তাদের গ্রামীন ব্যাংক সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই বলে মনে হয়।

তবে অবিচারের ভিন্নচিত্রও থাকতে পারে, আছেও। কিন্তু সেটা তো সামগ্রীক চিত্র নয়। বিচ্ছিন্ন কিছু চিত্র দিয়ে এতবড় একটা প্রতিষ্ঠানের বিচার করা যায় না। গ্রামীন ব্যাংক এত জনপ্রিয় হলো কেন, তারা কী মানুষকে জোর করে ঋন গেলাচ্ছে? এতটা খারাপ দৃষ্টান্ত থাকলে মানুষতো গ্রামীন ব্যাংক থেকে ১০০ হাত দুরে থাকার কথা। বাস্তবতা কী তা বলে? আসলে পেশাদারী দৃষ্টিতে দেখলে জামানতবিহীন ঋন কখনো ৯৯ ভাগ আদায় হবে না যদি ঋন পরিশোধ করার একটা চাপ না থাকে। গ্রামীন ব্যাংক কি একটা দাতব্য প্রতিষ্ঠান না পেশাদারী ঋনদাতা সংস্থা? তবে টিনের চালা খুলে ফেলার ঘটনাকে যারা উদাহরন হিসেবে নেয়, তাদের বলি সেই নির্দেশ নিশ্চয়ই ইউনুস দেননি, সেটা কোন রগচটা মাঠকর্মীর তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া। মানুষ কত রকমই হতে পারে। সেটার দায় প্রতিষ্ঠানের উপর পড়ে ঠিকই, কিন্তু সেটা দিয়ে একজন ডঃ ইউনুসের বিশাল কর্মযজ্ঞকে বিচার করা যায় না।

ডঃ ইউনুসের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ আমারও আছে, নোবেল পাওয়ার পর তাঁর অনেকগুলো আচরন আমার বেখাপ্পা লেগেছিল। নিজের ওজন হালকা করার মতো বেশ কিছু হুজুগে বক্তব্য দিয়েছিলেন। তার উপর বিতর্কিত ইয়াজউদ্দিন সরকারকে একরকম স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। দেশের প্রবল সংকট তিনি নোবেল উচ্ছ্বাসে ভুলতে বসেছিলেন। দেশ তাকে অভিভাবক মনে করতো, সেই ভুমিকা তিনি রাখতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ২০০৬ সালে আমি তার কঠোর সমালোচনা করে বেশ কিছু লেখা লিখেছিলাম। কিন্তু তার মানে এই নয় তার সব কীর্তিকে অস্বীকার করতে হবে সমালোচনাকে জায়েজ করার জন্য। যার যা প্রাপ্য তা দেয়াটাই ন্যায়পরায়নতা।

No comments: