Sunday, April 19, 2009

একটি ফোনালাপ এবং কতিপয় ভাবনা

-হ্যালো মাহমুদ
-কে বলছেন?
-আমি, চিনতে পারছেন না?
-অ, আচ্ছা, কেমন আছেন?
-ভাল, অনেকদিন দেখি না, ঘুমোচ্ছেন নাকি?
-না, এমনি শুয়ে আছি
-অনেকদিন পাড়ায় যাই না, ভাবলাম আপনাকে বিরক্ত করি, বাসায় আছেন এখন?
-আছি
-আমি আসতে পারি বিকেলের দিকে
-আমিতো ওই এলাকায় থাকি না
-বলেন কী? জানি না তো? এখন কোথায় থাকেন?
-বাকলিয়া, গতমাসে এসেছি, কাউকে বলা হয়নি
-অ, অফিসের কাছাকাছি চলে এসেছেন
-জী
-বাসার সবাই কেমন আছে?
-বাসায় আর কেউ নেই
-নেই মানে?
-মা তো আগেই গ্রামে চলে গিয়েছিল, বাবার রেখে যাওয়া জমিগুলো দেখাশোনা করার কেউ নেই। জমিজমা সব চাচার দখল করে নিয়েছে, মামলা ছাড়া হবে না, মামলার অনেক খরচ, নিজেই চলতে পারিনা, মামলা কীভাবে চালাবো। চাকরীটা এখনো আছে, মাঝে মাঝে বেতন পাই, অর্ধেক। বাসাভাড়া দিতে পারতাম না, তাই মেসে উঠেছি। ঝাড়া হাত পা।
-বাকী ভাইবোনরা কোথায়, গ্রামে?
-জী গ্রামে চলে গেছে, বড় আপা তো অসুস্থ জানেন, ৪০ পেরিয়েছে বয়স, ওর বিয়ে হবে না কখনো। মাও অসুস্থ এখন এইসব ঝামেলায়।
-ভাবী, মানে আপনার প্রাক্তন বউয়ের কী খবর
-হা হা হা, প্রাক্তন বউ, ভালোই বলেছেন, কাবিনের পাঁচ লাখ দিয়েই তো ফতুর হলাম, এরপর যোগাযোগ নেই আর। ডিভোর্সের পর কে আর যোগাযোগ রাখে।
-আর বিয়ে করবেন না?
-নাহ, সেই ভুল আর করবো না। এখনতো সামর্থ্যই নেই।
-আমাদের সেই আড্ডার দিনগুলো কী হারিয়ে গেছে?
-দিন হারায়
-অফিস থেকে ফিরে কী করেন?
-তা অনেক কিছু করি, খুব ব্যস্ত থাকি, সেই পুরোনো রাজনীতিতে ফিরে গেছি আবার
-বলেন কী, জেল থেকে ফিরে আর কখনো রাজনীতি করবেন না বলে খত দিয়েছিলেন না সরকারের কাছে?
-জীবনে তো অনেক খত দিয়েছি, এবার খত তুলে নেবার পালা
-বিদ্রোহ করবেন?
-হা হা হা, রাজনীতিতে ফিরে যাওয়া কী বিদ্রোহ হলো?
-না, তবে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা তো, তাই ভয় হয় আপনার জন্য
-আমার হারাবার কী আছে আর, দরিদ্র শ্রমিকদের স্বার্থে কাজ করা যদি দেশদ্রোহী হয়, তাতেই আমি রাজী, তাই আবার ফিরে গেলাম
-সাবধানে থাকবেন
-আছি, এবার এত সহজে ধরা দেবো না।
-বাসায় আসবেন একদিন
-সময় হয় না,
-ছুটির দিনে কী করেন?
-লেখালেখি করি
-কী লিখছেন
-পার্টি থেকে কাজ দিয়েছে একটা, 'বিশ্বমন্দায় পুজিবাদের সংকট' নিয়ে একটা পেপার রেডী করছি এ মাসেই শেষ করে জমা দিতে হবে।
-অ, আচ্ছা। ভাল থাকবেন
-নিশ্চয়ই
-রাখছি
-জী

ফোন রেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। মাহমুদের সাথে প্রায় দশ মাস পর কথা বললাম। এই মাহমুদকে দশ বছর আগের মাহমুদের সাথে মেলাতে পারি না। জীবন কোন কোন মানুষকে এমন বঞ্চনা করে! বউ চলে গেছে, চাকরি থেমে গেছে, জেলের ঘানি টেনেছে, পারিবারিক সম্পত্তি হুমকির মুখে পড়েছে, বড়বোনের অসুস্থতা হিস্টিরিয়া চরমে উঠেছে, দুমাসের ব্যবধানে বাবা হার্ট অ্যাটাকে, ছোট ভাইটা গাড়ীচাপায় দুম করে মরে গিয়েছে, এই সবগুলো সমস্যার যৌথ সুত্রপাত মাহমুদের জীবনকে উলটপালট করে দিয়েছিল। দু-তিন বছরের মধ্যে হাসিখুশী চেনা মানুষটা কেমন রূঢ় অচেনা হয়ে উঠেছিল। প্রতিটা আঘাত যেন তার চেহারায় ছাপচিত্র এঁকে গিয়েছে।

আমরা মাহমুদ থেকে দুরে থাকি। মাহমুদের দৈন্যতার জন্য নয়। মাহমুদের রাজনৈতিক অবস্থানে। আমাদের কারো বোধে মননে কাজ করে না কেন মাহমুদ রাজনীতি করার জন্য এমন একটা দল বেছে নিল যাকে কেউ চেনেনা পুলিশ আর টিকটিকি বাদে। এমনকি মাহমুদ যে রাজনীতি করে এটাও জেনেছি অনেক পরে। মাহমুদ যখন রমজানের প্রথম দিনে পুলিশের হাতকড়া পড়ে জেলখানায় ঢোকে তখন জেনেছি মাহমুদ নিষিদ্ধ এক বাম দলের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত দীর্ঘদিন থেকে। সেই থেকে মাহমুদকে ভয় পাওয়া শুরু করি। ভয় মাহমুদকে না, মাহমুদের সাথে যোগাযোগের সুত্রটাকে। মাহমুদের উপর টিকটিকির নজর। সুতরাং মাহমুদের বাসায় দিবারাত্র যে আড্ডা হতো পুলিশের খাতায় নিশ্চয়ই সেই আমলনামার রেকর্ড আছে, তাতে অপরাধ সহযোগীর তালিকায় আমাদের নাম থাকলেও অবাক হবার কিছু নাই। তবু বাংলাদেশের পুলিশ আমাদের ধাওয়া করেনি কখনো, করেছে মাহমুদকে। তা সত্ত্বেও আমরা এখন মাহমুদের আশপাশ মাড়াই না রিস্ক নিতে চাই না বলে।

আজ সকালে ফোনের বোতাম টিপে মাহমুদের নামটা যখন স্ক্রীনে আসলো, ভাবলাম এই সেই পড়ুয়া বন্ধু এখন জেলফেরত ঘুঘু। জীবন যাকে নিদারুন বঞ্চনা করেছে তবু জীবনের প্রতি কেমন তাচ্ছিল্য ছুড়ে দিয়ে মাহমুদ ফিরে গেছে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক জীবনে। জেল থেকে ফেরার পর যখন তার বাসায় যাই, আমাদের চা সিগারেট দিয়ে আপ্যায়ন করে। বলে, জেলে নাকি আগের চেয়ে অনেক বেশী আরাম। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে ভগ্নমলিন চেহারায় রাজবন্দীর তৃপ্তি।

আমাকে বেনসনের প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে বলে, জেলগেটে এক শুভাকাংখী দিয়েছে, আপনার জন্য রেখেছি। আমার এখন এসবে পোষায় না। আমি এখন আকিজ বিড়ি খাই। এটা জেলখানার নিজস্ব মুদ্রা। বিড়িতেই লেনদেন সব। বারবার যেতে হবে তাই অভ্যেস করে ফেলেছি।

আমি মাহমুদের জীবনকে দেখি এবং আমার কথা ভাবি। শ্রেনী সংগ্রামে মাহমুদ কী আমার বিপরীত ট্রেনের যাত্রী? মাহমুদের সংগ্রাম কী আমাদের বিরুদ্ধেই না?

No comments: