Sunday, April 19, 2009

কন্যার সাথে শহীদ মিনারে

২০-২১ ছুটির দুদিন কক্সবাজার থাকার কথা থাকলেও প্রচন্ড ভীড় হবার আশংকায় শেষ পর্যন্ত মত পরিবর্তন করে বাসায় পরিবারের সাথেই ছুটিটা কাটানোর পরিকল্পনা করি। দুদিন পুরোপুরি আমার কন্যার জন্য বরাদ্দ করলাম, বাইরে কোথাও যাবো না। আড়াই বছরে পড়েছে এখন ওশিন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কন্যা নাকি অধিক পিতৃভক্ত হয়ে উঠছে, অভিযোগ আমার গিন্নীর। যদিও একমাত্র কন্যা হিসেবে যতটুকু আদর প্রাপ্য তার সাথে শাসন চড় চাপড়ও সমান তালে চলে। কন্যার হাতও থেমে থাকে না বরং গুনিতক হারে ফিরে আসে, কখনো দ্বিগুনিতক, কখনো ত্রিগুনিতক। আমার মুখমন্ডলে মাঝে মাঝেই তার ক্ষত বিক্ষত চিহ্ন দেখা যায়। কিন্তু আমাদের এই প্রাইভেট যুদ্ধদৃশ্য বাইরের কেউ দেখে না বলে বিশ্বাস করে না একটা শিশু কতটা হিংস্র হতে পারে আদর করতে গিয়ে। চুমুর সাথে কামড় বোনাস, চুলটানার সাথে খামচি এসব নিত্য ঘটনা। বিনিময়ে আমি দুচারটা চড় চাপড় দিলে আমার দোষ হয়ে যায়। আমার অভিযোগ কেউ নেয় না আমাকেই উল্টো অধিক শাসনের অভিযোগে অভিযুক্ত করে। সুতরাং যুদ্ধ এবং বিচার দুটোতেই কন্যা আমার অপরাজিতা।

প্রতিদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে চা খেয়ে ৪ কিমি পদব্রজে সান্ধ্যভ্রমনে বেরুতে হয় ডাক্তারী নির্দেশে। ইদানীং সেখানেও হাত পড়েছে কন্যার। কোন কোনদিন টি-শার্টের কোনাটা খামচে ধরে আদুরে হুকুম জারি করে - “থাকোওওও… নাআআআ…… আমার সাথে!!” এই থাকা মানে ওর সাথে সাথে থেকে মারামারি-খামচাখামচি করা, অতঃপর কান্নাকাটি, বিচার এবং সেই বিচারে আমার হেরে যাওয়া, এসব আমার কন্যার বিশেষ প্রিয়।

একুশের সকালে নটায় ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে টিভিতে শহীদ মিনারের লাইভ দেখাছিলাম। অনেক বাচ্চারাও শহীদ মিনারে ফুল দিচ্ছিল ভীড় ঠেলে ঠেলে। ওশিন চুপচাপ দেখলো কিছুক্ষন, তারপর সেই বিষয়ে প্রশ্নমালা শুরু। যেই বিষয়ে প্রশ্ন শুরু করবে সেই বিষয়ে আপনার সম্পূর্ন জ্ঞান নিষ্কাষিত না হওয়া পর্যন্ত থামবে না মেয়েটি। এত বাচাল। শহীদ মিনারে ফুল নিয়ে প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হবার পর আমার কন্যা ঘোষনা করলো সেও যাবে “শহী-মিনায়ে” এবং ফুল দেবে ওখানে। খাইছে, আমি ভাবছিলাম এবছর শহীদ মিনার এলাকা এড়িয়ে চলবো, আগের দিন যে বোমাবাজি দেখলাম টঙ্গীর পুলিশ সুপারের অফিসে, ভীড় এলাকা নিরাপদ না। জঙ্গী উৎপাত আবারো। এখন মেয়ে বলে কিনা শহীদ মিনারে যাবে। একবার বলেছে যখন না করলে আমার জান খেয়ে ফেলবে সারাদিন। সময় নষ্ট না করে চট করে রেডী হয়ে গেলাম। বললাম - চল যাই। বেরুবার আগে সে তার মা আর দাদীকে মুরব্বীসুলভ স্বরে শান্ত্বনা দিয়ে বললো- ‘তোমাদেরকে পরে নিয়ে যাবো, আরেকদিন, ঠিক আছে?’। মা দাদী দুজনে হাসি চেপে বললো - ঠিক আছে।

রিকশা নিলাম একটা। পথে পথে সব দালানে জাতীয় পতাকা উড়ছিল। ওশিন চিৎকার দিল - বাবা দেখো, পতাকা। আমি বললাম হ্যাঁ পতাকা। আরেকটু গেলে আরো পতাকা দেখা গেল। ও প্রতিবার চেঁচিয়ে বলে -পতাকা। আমার খুব ভালো লাগলো মেয়ের জাতীয় চেতনা দেখে। মিনিট পাঁচেক পর নতুন দাবী। ‘বাবা আমি পতাকা নেবো।’ আমি এখন পতাকা কোথায় পাই?

শহীদ মিনারের কাছাকাছি গিয়ে রিকশা থেকে নেমে যেতে হলো। হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম ফেরীওয়ালা ছোট ছোট পতাকা বিক্রি করছে। একটা কিনে মেয়ের হাতে দিলাম। খুব খুশী আমার মেয়ে। শহীদ মিনারে প্রচন্ড ভীড় ঠেলাঠেলি বলে আমরা পাশেই থিয়েটার ইনষ্টিটিউটের চত্বরে ঢুকে গেলাম। এখানটা নিরিবিলি এবং শহীদ মিনারটা দেখা যায়। আমি কোলে করে দেখালাম শহীদ মিনার ও ফুলের স্তুপ। পেছনে খাড়া পাহাড় উঠে গেছে। সামনে বিশাল বাগান। সবুজের ছায়া। খুব ভালো লাগলো। ওশিন পতাকা নিয়ে ছুটোছুটি করছে চত্বরে।

একটু পর ফিরে এসে পাশে বসা তিন তরুনীর দিকে ইশারা দিয়ে বলে, ‘বাবা ওরা কী খায়?’
আমি তাকিয়ে দেখি, ওরা আচারজাতীয় টক ঝাল কিছু খাচ্ছে। আমি বললাম, ‘ওরা পঁচা খায়’। দমাতে চাইলাম ওকে।
কন্যা আমার সহজে দমার নয় - ‘আমিও পচা খাবো’ বলে চিৎকার জুড়ে দেয়ার উপক্রম।

এমন সময় সামনের রাস্তা দিয়ে একটা মিছিল এলো শ্লোগান সহকারে। টিফা চুক্তি মানি না, মানবো না। এক হও এক হও ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বললাম, ‘ওই যে দেখো মিছিল, চলো আমরা মিছিল করবো।’ ওকে কোলে নিয়ে চট করে মিছিলের লাইনে ঢুকে গেলাম। ওশিন পতাকা নেড়ে নেড়ে মিছিলের সাথে সায় দিল। আপাততঃ ভুলে থাকলো আচারের কথা। সাময়িক হলেও আচারের চেয়ে মিছিল যে ওর ভালো লাগলো সেটাই বা কম কী।

No comments: