পৃথিবী নামক গ্রহটা প্রথমে মানুষ নামের একটা প্রাণী দখল করেছে। তারপর সেটা থেকে অন্য প্রাণীদের অধিকার বাতিল করে নিজেদের রাজত্ব কায়েম করেছে। তারপর নিজেদের মধ্যে জাতি, ধর্ম, বর্ন ইত্যাদি নানান দলাদলি সৃষ্টি করেছে। তারপর নিজেরা নিজেরা কোন্দল করে একেকটা এলাকা একেকটা জাতিগোষ্ঠির মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে। তারপর থেকে এক জাতি অন্য জাতির কাছ থেকে ভূখন্ড দল করার প্রতিযোগিতা করেছে। যার যার শক্তি নিয়ে অন্য দলের ওপর হামলে পড়ে একেকটা অঞ্চল দখল করে দাবী করেছে এটা আমার সীমানা, ওটা তোমার সীমানা। সীমানা নির্ধারণ করার পরও একে অন্যের সীমানায় হানা দিতে থাকে। একদল অন্য দলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে যেদিন বিজয়ী হয়েছে সেদিন ঘোষণা করেছে আজ আমি স্বাধীন হলাম। সেই তারিখটা লিখে মানচিত্র বানিয়ে একটা পতাকা উঁচিয়ে ঘোষণা করে স্বাধীনতা দিবস। প্রত্যেক জাতির স্বাধীনতা দিবসের একটা শ্লোগান থাকে। গানও থাকে। গানের সাথে বন্দুকও থাকে। শক্তির লড়াইয়ে যে পরাজিত হয়েছে তার কোন স্বাধীনতা থাকে না। কখনো কখনো পরাজিতরা আবার লড়াই করে নিজেদের একটা ভূখন্ড দখল করে। তখন বলে আমরাও স্বাধীন হলাম। এভাবে পৃথিবী জুড়ে শত শত স্বাধীন দেশের জন্ম হয়ে গেল। তাদের সবার পতাকা, মানচিত্র, শ্লোগান, বন্দুক আছে। তার বাইরে শত শত দুর্বল মানবগোত্র রয়ে গেছে যারা এখনো সে সুযোগ পায়নি। যারা পরাজিত তাদের কোন স্বাধীনতা দিবস হয় না, তাদের কোন রাজ্য সীমানা থাকে না। শুধু ভাগ্যবানেরাই জাতিপুঞ্জের সভ্য। ভাগ্যবান বিজয়ীরাই স্বাধীন এবং স্বীকৃত। তাদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য নানা সংস্থা তৈরি আছে। সেই সংস্থার কাজ হলো বিজয়ী শক্তিমান জাতিগুলোর স্বার্থরক্ষা করা। পতাকা, সীমানা, মানচিত্র এবং বন্দুক চালাবার অধিকার সংরক্ষণ করা। সারা পৃথিবীর মানুষ এটাকেই সভ্যতা বলে মেনে নিয়েছে। স্কুল থেকে পই পই করে মুখস্থ করে শিখিয়ে দেয়া স্বাধীনতা ও গৌরবের সংজ্ঞা। তবু তাতেও সবার শান্তি হয়নি। এখনো দেশে দেশে সীমান্ত অধিকারের যুদ্ধ চলে। এখনো সুযোগ পেলে এক দেশ অন্য দেশের সীমান্তে হানা দেয়। যে দেশের সীমানায় একাধিক জাতি-ধর্ম-বর্নের বসবাস, সেখানে পরস্পরের মধ্যে হানাহানি চলে নিরন্তর। গুহাবাসী থাকার সময় পাথরের অস্ত্র নিয়ে যা করেছে, সভ্যতার শীর্ষে ওঠার পর আধুনিকতম প্রযুক্তি নিয়েও তাই করছে। প্রযুক্তি বদল হলেও চরিত্র কিছুই বদলায়নি। যার যত বেশি অস্ত্র সভ্যতার ওপর তার অধিকার তত বেশি। যার যত শক্তি, পৃথিবীতে তার তত বেশি যুক্তি। সে যুক্তি মেনে নিতে বাধ্য দুর্বল জাতিগুলো। আবার দুর্বল জাতিগোষ্ঠির হাতে অস্ত্র-প্রযুক্তি আসার পর তার চরিত্র বিবর্তিত হয়। তখন সেও আগ্রাসী শক্তিতে দুর্বলের ওপর আঘাত করতে শুরু করে। অধিকাংশ শক্তিমান রাষ্ট্র ভয়ানক আগ্রাসী। পশুদের রাজ্য নেই বলে তাদের মধ্যে আগ্রাসন নেই, সন্ত্রাস নেই, দলগোত্রভেদ নিয়ে মানচিত্র ভাগাভাগি নেই। এটা শুধু মানবজাতিরই ধর্ম। আত্মগৌরবে অধিষ্ঠিত নিকৃষ্ট মানবধর্ম। গুহাবাসী মানুষের তুলনায় বহুগুন নিকৃষ্ট সভ্য মানুষ। সভ্যতার বিবর্তনেই মানুষ এই নীচতা অর্জন করেছে। সভ্যতার বিবর্তন একদিকে যেমন সুসভ্য জনগোষ্ঠী তৈরি করেছে, অন্যদিকে এরকম অসভ্য গোষ্ঠিও তৈরি করেছে। মানুষের এই পরিবর্তন প্রাকৃতিকভাবে পরিশোধিত হবে নিজেদের হাত ধরেই।
মানুষ বাদে অন্য প্রাণীরা এই পরিবর্তনের কিছুই জানে না। তাদের কোন দুশ্চিন্তাও নেই এসব নিয়ে। কারণ তাদের পড়াশোনা নেই। তাদের কোন ধারণা নেই মানুষ সভ্যতার সংজ্ঞা লেখার সময় তাদের নাম কেটে বাদ দিয়েছে। কিন্তু একটা জিনিস জানে। তাদের কাছে পুরো মানবজাতিই একটা মূর্তিমান আগ্রাসন। বাকী প্রাণীজগতের কাছে মানবসমাজ একটা জীবন্ত সন্ত্রাস। কিন্তু তাদের কাছে এই সন্ত্রাস নিবারণের কোন উপায় নেই। তারা এটাকে ভূমিকম্প, ঘুর্ণিঝড় কিংবা মহামারীর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে মেনে নিয়েছে। তাদের কোন ভাবনার কথা আমরা জানি না, কারণ তারা বই লিখতে শেখেনি। বক্তৃতা দিতে জানে না। অন্তত একটা ভাষা শিখলেও মানুষ তাদের ভাবনার কথা জানতে পারতো। কিন্তু তা হবার নয়। তারা জানে না মানুষ কিভাবে সীমান্ত সীমান্ত খেলা করে। মানুষ কিভাবে নিজেদের সংজ্ঞায় সভ্যতার মাত্রা ঠিক করে। তারা এটাও জানে না এত অসভ্যতা করেও মানুষ নিজেকে এই জগতের শ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করে দিয়েছে। তারা এটাও জানে না মানুষ নিজের তৈরি করা সভ্যতার সংজ্ঞার মধ্যে নিজেরাই নির্বিচারে মারা পড়ছে একে অন্যের হাতে। স্রেফ অকারণে। মানুষকে তারা হাস্যকর প্রাণী বলে ভাবে কিনা সেটাও আমাদের জানা নেই। এখনো মানুষের ভাষায় বলতে শেখেনি, লিখতে শেখেনি। অন্য প্রাণীদের বক্তব্য শোনার আগে মানুষ নিজেকে সভ্যতম প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করা স্রেফ হাস্যকর। কিন্তু অন্য প্রাণীদের হাসি আমরা দেখতে পাইনা। কারণ মানুষ বিশ্বাস করে অন্য প্রাণীরা হাসতে জানে না।
একদিন এই সভ্যতম প্রাণীটা নিজেদের অস্ত্রে নিজেদের সমূলে বিনাশ করবে। সেদিন মানবজাতির সব হাসি থেমে যাবে। প্রকৃতি শুধু মানবজাতির জন্য এই গ্রহটা আলাদা করে তৈরি করেছে, এই বিশ্বাস নিয়ে যারা বেঁচে আছে, তাদের কেউ সেদিন থাকবে না।
No comments:
Post a Comment