রায়হানা শফিকে আপনারা চেনেন না হয়তো। চেনার কথাও না। তিনি বিখ্যাত কেউ নন। সাধারণ একটি চাকরী করে সংসার চালান। ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন একা একাই। প্রবল মানসিক জোর না থাকলে তিনি টিকতে পারতেন না। তাঁর মানসিক শক্তির যোগান দেয় ছোট্ট একটি জুয়েলারী বাক্স। যুগের পর যুগ পার হয়ে গেলেও তিনি বাক্সটি আগলে রেখেছেন। জুয়েলারী বক্সে কী আছে বাইরের কেউ জানে না। মাঝে মাঝে দেখা যায় আলমারি থেকে তিনি সেই বাক্সটি বের করেন এবং ডালা খুলে আলতো হাতে ছুঁয়ে কিছু একটা স্পর্শ করেন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস চেপে রাখার চেষ্টা করেন। তাঁর কাছে সেই দিনটি এখনো গতকালের ছবির মতো পরিষ্কার।
চট্টগ্রামের সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য নিয়ে সিআরবি পাহাড়ের উপর ছোট ছোট বাংলোগুলো দাঁড়ানো তার একটিতে ছিল তাঁর বসবাস। তিনি এখন যেখানে থাকেন তার কয়েকশো গজ দূরেই ছিল তাঁর সেই বাংলোটির অবস্থান। তাঁর স্বামী রেলওয়ের চীফ প্ল্যানিং অফিসার। তার পাশেই ছিল ডেপুটি সুপার মকবুল আহমেদের বাংলো। দুজনেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে নিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন লালন করতেন। স্বামীদের পাশাপাশি স্ত্রীরাও রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামান। রায়হানা শফি নিজে আওয়ামী লীগের রেলওয়ে শাখার সভানেত্রী।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার পর থেকে সারা দেশ অচল হয়ে পড়ে। তখন এই দুই বাড়িতে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতাদের গোপন বৈঠকগুলো বসতো পাহাড়ের অন্তরালে। মাঝে মাঝে খুব গোপনে এখানে যোগ দিতেন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের বাঙালী সামরিক অফিসারগণও। পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হতে থাকলে ঘন ঘন বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে থাকে নেতাদের মধ্যে।
রায়হানা শফি তখন ৩/৪ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ২৪শে মার্চ হঠাৎ একটা টেলিফোন আসে শফি আহমেদের বাড়িতে। টেলিফোনে কারো সাথে কথা বলে দ্রুত তৈরী হয়ে একা বেরিয়ে পড়েন তিনি তাঁর ৯২৯২ নম্বরের টয়োটা করোলা গাড়িটি নিয়ে। মিসেস শফি কিছু বুঝতে না পেরে কিছু একটা অমঙ্গল আশংকায় পাশের বাংলোতে মিসেস মকবুলের কাছে খোঁজ নিতে গেলেন। মিসেস মকবুল জানালেন চিন্তার কিছু নেই, শফি ভাই খানিক পরেই চলে আসবেন আরো কয়েকজনকে নিয়ে। আমার কাছে ঢাকা থেকে গোপন মেসেজ এসেছে তাদের জন্য। কিছুক্ষণ পর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে শফি সাহেবের গাড়িটাকে আসতে দেখা গেল। তিনি নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন।
গাড়িটা কাছে আসলে কয়েকজন বাঙালী সামরিক অফিসার নামলো গাড়ি থেকে। লে.কর্নেল এম আর চৌধুরী, মেজর জিয়া এবং ক্যাপ্টেন রফিক। লে.কর্নেল চৌধুরী ছিলেন শফি আহমেদের আপন খালাতো ভাই। তিনি মিসেস মকবুলকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাবী কোন মেসেজ আছে? মিসেস মকবুল জানালেন, হ্যাঁ ভাই আছে। ক্যাপ্টেন আমিন ফোনে আপনাদের বলতে বলেছেন, কোন অবস্থাতেই যেন 'লাল ফিতা' না ছাড়েন।
কথা শুনেই এম.আর. চৌধুরীর মুখ লাল হয়ে গেল উত্তেজনায়।এরপর ওরা চারজন চলে গেলেন লুৎফুল করিমের বাংলোর পেছনে বড় গাছে ঢাকা জঙ্গলাবৃত জায়গায়।
পরে রায়হানা শফি জানতে পারেন সোয়াত জাহাজের অস্ত্র নামানোর জন্য মেজর জিয়াকে যে হুকুম দেয়া হয়েছে সেটা অমান্য করে বিদ্রোহ করার জন্য মেজর জিয়াকে ডেকে এনেছেন ক্যাপ্টেন রফিক যিনি প্রায় নিশ্চিত পাকিস্তানীরা বড় ধরনের গনহত্যার আয়োজন করছে। 'লাল ফিতা'র কোডের অর্থ হলো অস্ত্র। সেই সময় পাকিস্তানীরা কৌশলে বাঙালী সৈন্যদের অস্ত্রগুলোকে হস্তগত করার পরিকল্পনা করেছিল।
ঢাকা থেকে বলা হয়েছে কোন অবস্থাতেই যেন বাঙালী সৈন্যরা অস্ত্র সমর্পন না করে।
কিন্তু ২৪ মার্চ তারিখ ক্যাপ্টেন রফিকের বিদ্রোহ পরিকল্পনায় সায় দিতে পারেননি বাকী সেনাকর্তারা। তাঁরা আশাবাদী ছিল হয়তো আলোচনা সফল হবে। কিন্তু তার ২৪ ঘন্টা পরেই ইয়াহিয়া বাঙালীদের উপর চরম আঘাত হানার হুকুম দিয়ে ঢাকা এয়ারপোর্ট ত্যাগ করেছিল।
[খসড়া লেখা]
============================== =
লেফটেনেন্ট কর্নেল এম.আর. চৌধুরীর কথা মনে আছে? ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ
রাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে যাকে হত্যা
করেছিল? তাহলে নিশ্চয়ই মনে আছে
মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের লেখা 'লক্ষ প্রাণের
বিনিময়ে' বইটিতে উল্লেখিত সেই ঘটনাটি। লে.কর্নেল. এম.আর. চৌধুরী ২৪শে মার্চ সন্ধ্যার পর মেজর জিয়াউর
রহমানকে নিয়ে সিআরবি পাহাড়ে ক্যাপ্টেন রফিকের সাথে মিলিত হয়ে পাকিস্তানীদের
আসন্ন আক্রমন নিয়ে আলাপ সেরে পাশেই তাঁর এক আত্মীয়ের বাংলোর দিকে চলে
গিয়েছিলেন। বইটিতে অবশ্য সেই আত্মীয় সম্পর্কে কোন তথ্য দেয়া ছিল না।
আরেকটু সুত্র থেকে তথ্য মারফত জানা যায় সেই আত্মীয়টির নাম শফি আহমেদ, যিনি রেলওয়ের চীফ প্ল্যানিং অফিসার যিনি লে.কর্নেল এম.আর. চৌধুরীর ঘনিষ্ট আত্মীয়, তাঁর আপন খালাতো ভাই। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে যে কয়েকজন সরকারী কর্মকর্তা চট্টগ্রামে সরাসরি যুক্ত ছিলেন শফি আহমেদ তাদের একজন। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব নিবেদিত প্রাণ মানুষের আত্মত্যাগের ঘটনা ইতিহাস থেকে মুছে যাবার উপক্রম তিনি তাঁদেরও একজন।
No comments:
Post a Comment