১.
একদল হিংস্র পশু এবং একদল হিংস্র মানুষের মধ্যে সভ্য আচরণের তুলনামূলক
বিচার করলে পশু সমাজ যে এগিয়ে থাকবে তা আমরা এখন আর কেউ অস্বীকার করতে পারি
না। পশুর হিংস্রতা কোন একটি মৌলিক চাহিদা পূরণ ঘটিত সমস্যা থেকে উদ্ভুত হয়
এবং সেই হিংস্রতা প্রয়োগের একটা মাত্রা থাকে একটা যুক্তি থাকে। কিন্তু
মানুষ কোন রকম যৌক্তিক কারণ ছাড়াই স্বজাতির উপর চড়াও হয়ে চরম নির্মমতার
পরিচয় দিতে পারে খুব অনায়াসে।
বাঘ সিংহ গণ্ডার কয়োট হায়েনা বেড়াল কুকুর যেই হোক, সবাই নিজ নিজ সীমানাটা মেনে চলে। সিংহ কখনো বেড়ালকে কামড়ে দিয়ে বলে না তোর কেন কেশর হয় না, কিংবা হাতি কখনো কুকুরকে লাথি দিয়ে বলে না তুই কেন শুড় দিয়ে মাংস খাস না। আন্তঃপশু সংঘর্ষের কোন সংবাদ আমরা তেমন দেখি না। পশুরা কী করে যেন একটা সুশৃংখল সভ্যতা গড়ে তুলেছে সেটা খুব আশ্চর্যের। অথচ তাদের কোন রাষ্ট্রনায়ক নেই, মহামানব নেই, অবতার নেই, দেবতা নেই, পথ নির্দেশক নেই। তাদের নেই কোন রাষ্ট্র, ধর্ম, বিজ্ঞান, দর্শন, বিদ্যালয়, উপাসনালয়। এসব কিছু না থেকেও ওরা আদি থেকে এই সভ্যতা ধরে রেখেছে।
প্রাণীজগতের মধ্যে মানুষই একমাত্র প্রাণী যাদের রাষ্ট্র, নেতা, ধর্ম, মহামানব, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি সবকিছু আছে। এই সব কিছুর যোগফল নিয়ে মানবকূল পৃথিবীটা দখল করে শাসন করছে এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করেছে। বাকী প্রাণীসমাজ অবশ্য জানে না ‘মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব’, জানার মতো শিক্ষাদীক্ষাও তাদের নেই। জানলে এই শ্রেষ্ঠত্ব বিনাতর্কে মেনে নিতো কিনা সন্দেহ আছে।
কিন্তু মানব সমাজের বাইরে একটা তৃতীয় অবস্থান নিয়ে যদি আমি মানুষ এবং অন্য প্রাণীদের তুলনামূলক অবস্থানটা দেখি, তাহলে দেখবো, প্রযুক্তি, জ্ঞানবিজ্ঞান এবং ক্ষমতার দিক থেকে মানুষ বর্তমানে শ্রেষ্ঠ অবস্থানে আছে (৫০ হাজার বছর আগে হলে এটা বলতে পারতাম না) এটা সত্যি হলেও যাকে আমরা গড়পড়তা ‘মানবতা’ বলি, সেই হিসেবে মানুষ পশুদের চেয়ে সামগ্রিকভাবে পিছিয়ে।
মানুষকে বাই ডিফল্ট শ্রেষ্ঠ ধরে ভালো গুন সমৃদ্ধ অর্থে ‘মানবতা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। মানবতা বলতে মায়া দয়া স্নেহ মমতা সমৃদ্ধ একটি উদার একটি চরিত্রের নিদর্শনকে বুঝি। অথচ মানুষের ভেতরে যে চরম স্বার্থপর হিংস্রতম নির্দয় চরিত্রের অন্ধকার বিষয় লুকিয়ে আছে তাকে প্রকাশ করতে গেলে আমরা পশুর নামানুসারে আখ্যায়িত করি ‘পশুত্ব’ বলে। যদিও যুক্তিহীন নির্দয় হিংস্রতার ব্যাপারে পশু সমাজ একদমই নিষ্পাপ। মানুষের মতো অযৌক্তিক হিংস্র হওয়া কোন পশুর পক্ষে সম্ভব না। তাই মানুষের অমানবিক আচরণের প্রকাশ করতে গিয়ে ‘পশুত্ব’ শব্দটি বাদ দিয়ে আমাদের উচিত মানব উপযোগী নতুন একটি শব্দের উদ্ভাবন করা। মানুষের কুৎসিত আচরণের দায় নির্দোষ পশু সমাজের উপর চাপানো নিতান্তই অপমানের সামিল।
২.
খুব সাদামাটাভাবে তাকালেও দেখি মানুষের প্রাণীত্ব স্বভাবের মধ্যে সবচেয়ে
উৎকৃষ্ট বলে বিবেচিত শুভবুদ্ধিগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। যেটাকে অবক্ষয়
হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, নৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তো
অবক্ষয়টা চরম বিকৃত রূপ ধারণ করেছে। ব্যক্তি মানুষের হিসেব করতে গেলে
প্রতিটা মানুষের ভেতর শুভ অশুভ চেতনার মিশ্রন আছে। পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে
এই বোধগুলোর প্রভাব বিস্তারের মাত্রা ওঠানামা করে। বাংলাদেশের বর্তমান
পরিস্থিতিতে বলা যায় অশুভ বোধ প্রবলভাবে আক্রান্ত আমাদের জনগোষ্ঠির বিশাল
একটা অংশ।
গত শতকের শেষ দিকেও আমরা মাঝে মাঝে শুনতাম এই অবক্ষয়ের কথা, কিন্তু তখনো সেটা একটু দূরে ছিল, শোনা কথা, পত্রিকার পাতা ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ থাকতো। এই শতকের দ্বিতীয় দশকেই এসে তা এতই ভয়াবহ রূপে আক্রমণ করবে তা গত শতকে আমরা কল্পনাও করিনি। আমাদের প্রচুর দুর্বলতা আছে চরিত্রের, প্রচণ্ড সীমাবদ্ধতা আছে চিন্তা জগতের, আত্মকেন্দ্রিকতার অন্ধকার প্রচণ্ড। ভার্চুয়াল মননশীলতার বিচার করার জন্য বাঙালীর ফেসবুক ভুগোলে পরিভ্রমণ করেও অনেকটা অন্ততঃ আঁচ করা যায়। যদিও এই বাঙালী মধ্য এবং উচ্চবিত্ত বাঙালী। অনুমান করি শতকরা নব্বই ভাগ মানুষ এর অন্তর্ভুক্ত নয়। শ্রমজীবি কিংবা প্রান্তিক মানুষেরা এই জগতে নেই। কিন্তু একটা দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণীটাকে দিয়ে বিচার করা হয় সেই সমাজের মানবিক অবস্থান। এই অবস্থানটা অতিমাত্রায় সংকীর্ণ মানসিকতায় ভরপুর। এখানে শিক্ষা রুচি আর্থিক অবস্থা কোনটাই এই সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করতে পারেনি মানুষকে। যে যেই মতবাদে বিশ্বাসী তার বাইরের কাউকে মানুষের মর্যাদা দিতেও রাজী না। ন্যুনতম শ্রদ্ধাবোধ দূরে থাকুক, তার জীবনেরই কোন দাম নেই প্রতিপক্ষের কাছে। সেটা ধর্মীয় হোক বা রাজনৈতিক হোক কিংবা সামাজিক মতবাদ হোক।
তবু একটা সময় ছিল যখন কেবল পক্ষ বিপক্ষে সীমাবদ্ধ ছিল এই বিরোধীতা। হিংসা হানাহানি যাই হতো তা নিজ নিজ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেই হতো। তার বাইরের কেউ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে এটা আমরা দশ বছর আগেও কল্পনা করিনি। এই বাংলাদেশে এখন তাই হচ্ছে। কে কখন কার লক্ষবস্তুতে পরিণত হবে কেউ জানে না। কে কখন কার হাতে খুন হবে কেউ জানে না। চোখের সামনে দেখতে দেখতেই একটি আত্মহত্যাপ্রবণ অপরিণামদর্শী সমাজে বিবর্তিত হয়ে গেছি আমরা। সমস্ত জাতির রক্তে অজানা কোন বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ শিরা উপশিরা বেয়ে শুভবুদ্ধির প্রধান আশ্রয়কেন্দ্র মগজকে আক্রান্ত করেছে। মগজে মগজে অমানুষ। কত হাজার কত লক্ষ কত কোটি, এখনো ঠিক জানি না। শুধু জানি আমরা ‘ভালো নেই’। আমরা ‘ভালো নই’।
কেন ভালো নই? কেননা এইসবের জন্য আমিও দায়ী, আপনিও দায়ী, আমরা সবাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যে কোনভাবে অবশ্যই দায়ী। আমরা নিজ নিজ স্বার্থের বাছবিচার করে অশুভকে শুভ বলেছি, শুভকে অশুভ করেছি। আমাদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়েই বেড়ে উঠেছে বিষবৃক্ষ। সময়ে সময়ে আমরা বপন করেছি বীজ, রোপন করেছি চারা, সার দিয়েছি, জলপানি দিয়েছি। সময়ে সময়ে আগাছাকে বাড়তে দিয়েছি অন্যের বাগান গ্রাস করবে বলে। অন্যের বাগান আক্রান্ত হলে আমরা পুলকিত হই। কিছু কিছু ধ্বংস আনন্দ দিয়েছে আমাদের কাউকে কাউকে। আর এখন সেই আগাছা, সেই বিষবৃক্ষ অন্যের বাগান খেয়ে আমার নিজের বাগানেও হানা দিয়েছে।
এখন আমরা নিজেদের তৈরী ফ্রাংকেনস্টাইনে নিজেরাই আক্রান্ত। তবু কি আমরা কিছু না করে বসে থাকবো? নিজের অবস্থানে ঠায় বসে থাকবো নাকি একটু সরে এসে দানবের শক্তিকে রুখে দেবার জন্য সমাজকে তৈরী করবো?
[দিনলিপি: ২০১৮]
No comments:
Post a Comment