প্রিয়
অতীত,
তুমি জানো বাড়িটার কোন বিশেষ সৌন্দর্য ছিল না। না ছিল বিশেষ মুগ্ধ হবার মতো কোন বৈশিষ্ট। শুধু একটা ব্যাপার। কোলাহলময় শহরে ওই বাড়িটা ছিল ছোট্ট নিস্তব্ধ একটা গ্রাম। রাস্তা থেকে গেট পেরিয়ে সীমানা দেয়ালের মধ্যে প্রবেশ করলে আমাদের নিজস্ব জগত। আমাদের আনন্দ বাড়ি। তুমি জানো ওখানে একটা বাগানও ছিল। সেই বাড়িটার সামনে অগোছালো একটা বাগান বা উঠোন। বাগানে কিছু বিক্ষিপ্ত গাছপালা। মোট কটা গাছ ছিল
বাগানে? কখনো গুনিনি। দাঁড়াও স্মৃতিতে গুনতে চেষ্টা করি। নারকেল গাছ ছিল
দুটো। সুপুরি তিনটা। পেয়ারা গাছ পাঁচটা, সেই পাঁচটা গাছের
পাঁচ রকমের পেয়ারা, আম গাছ চারটা প্রতিটা গাছের স্বাদ
আলাদা, দেশি আমের মতো পোকা নেই, টকও না। বরই গাছ ছিল দুটো, দেশি বরই, একটু কষা, আরেকটা টকমিষ্ট রসালো। কামরাঙ্গা
একটামাত্র কিন্তু ধরেছিল অজস্র ফল। কাঠাল গাছ দুটো, একটা
গাছ হাজারি কাঠাল। আগা থেকে গোড়া কাঠালে ভর্তি থাকতো। আরেকটি লেবু গাছ লাগিয়েছিলাম,
অনেকদিন লেবু ধরবে ধরবে করে গাছটা বড় হয়ে একদিন যা ধরলো সেটা
একটা জাম্বুরা।
সে
কথা রাখেনি, তবু
আমরা তাতেই কী আনন্দ করেছিলাম। আরো আছে, কলাগাছের কথা তো
বলাই হয়নি। অনেকগুলো গাছ ছিল। কিন্তু কলাগাছগুলো ফলের চেয়ে পাতা বেশী উপহার দিয়েছে,
কোরবানীর মাংস রাখার কাজে কাজে লাগতো, আর
লাগতো পিঠা বানাতে। তবু বছর কয়েক ধরে নিয়মিত কাঁচকলা উপহার দিয়েছিল দুটো গাছ। আর
দিয়েছিল কলার থোড়। কলা গাছ কেটে ফেললে সেটার কাণ্ডের মধ্যখানে যে সাদা শাস থাকে
সেটা এক মজার তরকারী হতো। চাটগাইয়া ভাষায় তাকে বলা হয় বহলী। সবজি হিসেবে অতুলনীয়।
বাগানে
আরো কটা ফলের গাছ ছিল আতা, জলপাই,
আমলকি হাবিজাবি। কিন্তু ওরা কেউ কথা রাখেনি। অথবা আমরা ওদের
ঠিকমতো যত্ন নিতে পারিনি। ফুলের গাছের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ছিল মাধবীলতা, সবচেয়ে সুগন্ধী ছিল শিউলি আর হাসনাহেনা। ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাইরে পা
রাখলে শিউলিতে সাদা হয়ে থাকতো পথের অনেকটা। হাসনাহেনার গন্ধে নাকি সাপ আসে,
আমার জানালার পাশেই ছিল হাসনাহেনার ঝাড়, কিন্তু আমি কখনো সাপ দেখিনি। গোলাপ ছিল, কথা রাখেনি গোলাপও। যে রঙের ফুল দেবার কথা তা না দিয়ে অন্য রঙ দিয়েছিল।
জবাগুলো অসাধারণ ছিল, সাদা, লাল,
গোলাপী। গাঁদা, কসমস, জিনিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, এমনকি সূর্যমুখীও ফুটেছে একসময়।
নিয়মিত
ফুলফলের পাশাপাশি ছিল অসংখ্য অজানা অচেনা ঘাসলতাপাতার জঙ্গল। এই যে যাকে বাগান
বলছি, তাকে সত্যি সত্যি বাগান বলা
যায় কিনা সন্দেহ আছে। এখানে সবকিছু ছিল একদম অগোছালো। কিছু গাছ নিয়ম মেনে লাগানো
হলেও অধিকাংশ উঠেছিল স্বেচ্ছাচারীর মতো। পাতাবাহারের ঝোপগুলো বেড়ে উঠতো ইচ্ছেমতো।
আমাদের বাড়ির চেয়ে তিনগুন বড় ছিল বাগান, তাই বৃক্ষদের
স্বাধীনতা ছিল অবারিত। ওরা ওদের মতো এখানে সেখানে বেড়ে উঠেছিল। একসময় বাগানের
আড়ালে হারিয়ে গেল আমাদের আস্ত বাড়িটাই।
পাশের
রাস্তা দিয়ে যাবার সময় কেউ বাড়ি খুঁজে পেতো না,
দেয়ালের দক্ষিণ পাশে যে রাস্তা সোজাসুজি চলে গেছে সেখানে দাড়ালে
দেখা যাবে শুধুই সবুজ, শুধুই ছায়া। কোলাহলময় ব্যস্ত সড়ক
থেকে আকাশী রঙের গেটটা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই সুনসান এক সবুজ শান্তির জগত। সেই
সবুজের ছায়ার আশ্রয়ে ছিল আমাদের বাড়িটা। আমরা দীর্ঘ ২২ বছর কাটিয়েছে সেই অখ্যাত স্মৃতিময় বাড়িটাতে।
এত
বছর পর হঠাৎ খুঁজতে গিয়ে দেখি ওই বাড়িতে তোলা অধিকাংশ ছবি হারিয়ে গেছে। সেই
সৌন্দর্যের একাংশও নেই বিদ্যমান ছবিগুলোতে। তবু কয়েকটি ছবি স্মৃতির অংশ হিসেবে
যুক্ত করা হলো।
প্রিয়
অতীত,
তুমি জানো বাড়িটার কোন বিশেষ সৌন্দর্য ছিল না। না ছিল বিশেষ মুগ্ধ হবার মতো কোন বৈশিষ্ট। শুধু একটা ব্যাপার। কোলাহলময় শহরে ওই বাড়িটা ছিল ছোট্ট নিস্তব্ধ একটা গ্রাম। রাস্তা থেকে গেট পেরিয়ে সীমানা দেয়ালের মধ্যে প্রবেশ করলে আমাদের নিজস্ব জগত। আমাদের আনন্দ বাড়ি। তুমি জানো ওখানে একটা বাগানও ছিল। সেই বাড়িটার সামনে অগোছালো একটা বাগান বা উঠোন। বাগানে কিছু বিক্ষিপ্ত গাছপালা। মোট কটা গাছ ছিল
বাগানে? কখনো গুনিনি। দাঁড়াও স্মৃতিতে গুনতে চেষ্টা করি। নারকেল গাছ ছিল
দুটো। সুপুরি তিনটা। পেয়ারা গাছ পাঁচটা, সেই পাঁচটা গাছের
পাঁচ রকমের পেয়ারা, আম গাছ চারটা প্রতিটা গাছের স্বাদ
আলাদা, দেশি আমের মতো পোকা নেই, টকও না। বরই গাছ ছিল দুটো, দেশি বরই, একটু কষা, আরেকটা টকমিষ্ট রসালো। কামরাঙ্গা
একটামাত্র কিন্তু ধরেছিল অজস্র ফল। কাঠাল গাছ দুটো, একটা
গাছ হাজারি কাঠাল। আগা থেকে গোড়া কাঠালে ভর্তি থাকতো। আরেকটি লেবু গাছ লাগিয়েছিলাম,
অনেকদিন লেবু ধরবে ধরবে করে গাছটা বড় হয়ে একদিন যা ধরলো সেটা
একটা জাম্বুরা।
সে
কথা রাখেনি, তবু
আমরা তাতেই কী আনন্দ করেছিলাম। আরো আছে, কলাগাছের কথা তো
বলাই হয়নি। অনেকগুলো গাছ ছিল। কিন্তু কলাগাছগুলো ফলের চেয়ে পাতা বেশী উপহার দিয়েছে,
কোরবানীর মাংস রাখার কাজে কাজে লাগতো, আর
লাগতো পিঠা বানাতে। তবু বছর কয়েক ধরে নিয়মিত কাঁচকলা উপহার দিয়েছিল দুটো গাছ। আর
দিয়েছিল কলার থোড়। কলা গাছ কেটে ফেললে সেটার কাণ্ডের মধ্যখানে যে সাদা শাস থাকে
সেটা এক মজার তরকারী হতো। চাটগাইয়া ভাষায় তাকে বলা হয় বহলী। সবজি হিসেবে অতুলনীয়।
বাগানে আরো কটা ফলের গাছ ছিল আতা, জলপাই, আমলকি হাবিজাবি। কিন্তু ওরা কেউ কথা রাখেনি। অথবা আমরা ওদের ঠিকমতো যত্ন নিতে পারিনি। ফুলের গাছের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ছিল মাধবীলতা, সবচেয়ে সুগন্ধী ছিল শিউলি আর হাসনাহেনা। ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাইরে পা রাখলে শিউলিতে সাদা হয়ে থাকতো পথের অনেকটা। হাসনাহেনার গন্ধে নাকি সাপ আসে, আমার জানালার পাশেই ছিল হাসনাহেনার ঝাড়, কিন্তু আমি কখনো সাপ দেখিনি। গোলাপ ছিল, কথা রাখেনি গোলাপও। যে রঙের ফুল দেবার কথা তা না দিয়ে অন্য রঙ দিয়েছিল। জবাগুলো অসাধারণ ছিল, সাদা, লাল, গোলাপী। গাঁদা, কসমস, জিনিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, এমনকি সূর্যমুখীও ফুটেছে একসময়।
নিয়মিত ফুলফলের পাশাপাশি ছিল অসংখ্য অজানা অচেনা ঘাসলতাপাতার জঙ্গল। এই যে যাকে বাগান বলছি, তাকে সত্যি সত্যি বাগান বলা যায় কিনা সন্দেহ আছে। এখানে সবকিছু ছিল একদম অগোছালো। কিছু গাছ নিয়ম মেনে লাগানো হলেও অধিকাংশ উঠেছিল স্বেচ্ছাচারীর মতো। পাতাবাহারের ঝোপগুলো বেড়ে উঠতো ইচ্ছেমতো। আমাদের বাড়ির চেয়ে তিনগুন বড় ছিল বাগান, তাই বৃক্ষদের স্বাধীনতা ছিল অবারিত। ওরা ওদের মতো এখানে সেখানে বেড়ে উঠেছিল। একসময় বাগানের আড়ালে হারিয়ে গেল আমাদের আস্ত বাড়িটাই।
পাশের রাস্তা দিয়ে যাবার সময় কেউ বাড়ি খুঁজে পেতো না, দেয়ালের দক্ষিণ পাশে যে রাস্তা সোজাসুজি চলে গেছে সেখানে দাড়ালে দেখা যাবে শুধুই সবুজ, শুধুই ছায়া। কোলাহলময় ব্যস্ত সড়ক থেকে আকাশী রঙের গেটটা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই সুনসান এক সবুজ শান্তির জগত। সেই সবুজের ছায়ার আশ্রয়ে ছিল আমাদের বাড়িটা। আমরা দীর্ঘ ২২ বছর কাটিয়েছে সেই অখ্যাত স্মৃতিময় বাড়িটাতে।
এত
বছর পর হঠাৎ খুঁজতে গিয়ে দেখি ওই বাড়িতে তোলা অধিকাংশ ছবি হারিয়ে গেছে। সেই
সৌন্দর্যের একাংশও নেই বিদ্যমান ছবিগুলোতে। তবু কয়েকটি ছবি স্মৃতির অংশ হিসেবে
যুক্ত করা হলো।
বাড়ির উঠোনে মা খালা ভগিনীত্রয়ীর অবসর বিকেল |
গাছের কাণ্ড ধরে ঝাকুনি নিলে বরই ঝরে পড়তো |
থালা ভর্তি কুড়িয়ে নেয়া বরই |
গাছ থেকে সদ্য পাড়া ডাব |
সকালের রোদ মেখে দ্বিতীয় প্রজন্মের দুইজন |
ঘুম ভাঙা শীতের সকালে বাগানে চেয়ার পেতে রোদ পোহানো |
দ্বিতীয় প্রজন্মের হাত ধরে চতুর্থ প্রজন্ম |
রাজকীয় জবা বাড়ির ছাদ ছুঁয়ে আম গাছের মগডালে পৌঁছেছে |
নিবাসী কাকের ধারণা, এই বাড়ি তার, আমরা নেহাত ভাড়াটে |
থোকা থোকা কামরাঙা |
জানালার পাশে ঝুলছে কাঠাল, হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় |
সবুজের ছায়ায় নিঃসঙ্গ কাক |
যে ফুলে সুগন্ধ নেই |
সমস্ত বাগানে বিস্তৃত সবুজের ছাদ |
অবসর বিশ্রামে মা |
ঘরের দেয়াল ঘেঁষে বাহারী পাতার মিছিল |
মানিপ্ল্যান্টের দেয়াল ভ্রমণ |
রাত জাগা ফুল ফোটাবার প্রস্তুতি |
দেয়াল বাইছেন ইনিও |
ওখানে কে রে? |
তৃতীয় প্রজন্মের উর্ধমূখী কৌতুহল |
গাছ থেকে পড়ে থাকা পাকা আম |
সাদা জবা |
অতিথি শালিক |
বাগানে দ্বিতীয় প্রজন্মের একজন |
দীর্ঘ বিশ বছরের ইতিহাস থেকে খুঁজে পাওয়া
কয়েকখানা মাত্র ছবি দিয়ে এই বাড়ি নিয়ে কিছুই বোঝানো যাবে না। যতটা লেখার সাধ, ক্ষমতা তার
চেয়ে অনেক কম।
ফেলে আসা বাড়িটা এখন কেবলই স্মৃতি। খুব প্রিয়
একটা স্মৃতিময় অংশ। অথচ,
অথচ এতসব স্মৃতির বোঝা ফেলে একদিন চলে যেতে হয়। তারপর.......
সেই সেদিন, অফিস থেকে ফেরার পথে আমাদের সাবেক সেই বাড়িটার পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখি
আস্ত বাড়িটা মাটির সাথে মিশে গেছে উন্নয়ন শাবলের আঘাতে, সেই সাথে মিশে গেছে
ছায়া সবুজের সকল আশ্রয়। আর কদিন পরেই আকাশচুম্বি দালান খাড়া হয়ে যাবে সেখানে। তখন
কেউ ভাবতেই পারবে না, এই জায়গার মাটি দীর্ঘ বিশ বছর সবুজ ছায়ায় নিমজ্জিত ছিল।
একদিন আমিও হয়তো বিস্মরণের পথে হাঁটতে শুরু করবো। তবু তার আগ
পর্যন্ত আমাদের ছায়াবাড়িটা নিয়ে স্মৃতির বিলাস চালিয়ে যাবো। মানুষের জীবনটা খুবই
ছোট্ট, অনিশ্চিত।
অনেক প্রতিশ্রুতি সময়ের স্রোতে হাস্যকর হয়ে যায়। তাই 'আমি আরো লিখবো' এটা কোন প্রতিশ্রুতির
দায় বহন করে না। এটা খুব সামান্য একটা ইচ্ছামাত্র।
[অসমাপ্ত]
No comments:
Post a Comment