কিভাবে ছুটি কাটাতে চাই?
"সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে শুয়ে শুয়ে একটু বিশ্রাম করি। তারপর হাতমুখ ধুয়ে চা-জলখাবার খেয়ে আবার শুয়ে পড়ি। দুপুরবেলা কষ্টেসৃষ্টে উঠে টানটান করে খাওয়া সারি। দ্বিপ্রাহরিক আহারের পর ভাতঘুম তো বাঙালীর ন্যায্য পাওনা, দুপুরের পর তাই ভাতঘুমে থাকি। বিকেলে চা জলখাবার খাবার পর ভাবি কোথায়ই-বা যাবো, বরং শুয়েই থাকি। রাতের বেলা খাওয়া সেরে আবার ঘুমিয়ে পড়ি।"
সৌজন্যে: বিশ্রামগুরু শিবরাম চক্রবর্তী
দেখা গেল আক্ষরিক অর্থে ছুটিটা চুড়ান্ত অলসতায় গেল, যেটাকে খানিক অসুস্থতা বলেও চালানো গিয়েছে। এই অবসাদ, এই ক্লান্তি, কোথাও যেতে ইচ্ছে না করা, কিছু লিখতে না পারা, অথচ নির্ঘুম রাত এইসব কি অসুস্থতার লক্ষণ? আমি ঠিক জানি না, কিন্তু ভেতরের কলকব্জাগুলো ঠিকভাবে কাজ করছে না এটা নিশ্চিত। ৪৫ পার হওয়া মানে ৫০ এর পথে রওনা দেয়া। পঞ্চাশের দিকে সুস্থতার সম্ভাবনা কমে আসতে থাকে ক্রমেই। অগ্রজেরা যে পথে গেছে আমি সেই পথ থেকে ব্যতিক্রম হবো কি করে।
জুবায়ের ভাইয়ের 'সিকি আধুলি গদ্যগুলি' পড়ছিলাম। আগেও পড়েছি, কিছু লেখা বাকী ছিল সেগুলো পড়লাম রাত জেগে। একটা লেখা আরেকটা লেখাকে ডেকে আনে। বইটা আমাকে আরো তিনটা বই পড়তে বাধ্য করলো। আরো কয়েকটা জীবনকে আমার কাছে উন্মুক্ত করলো। চেনা মানুষের অজানা জীবন। আমি দুদিন বুঁদ হয়ে থাকলাম। এমন ঘোর অনেকদিন আসেনি আমার। আমি যখন ব্লগ জীবন শুরু করি, জুবায়ের ভাই তখন জীবনের মায়া ছেড়ে অন্য পৃথিবীর পথে রওনা দিয়েছে। মূলতঃ জুবায়ের ভাইয়ের সবগুলো লেখাই পড়েছি তাঁর অন্তর্ধানের পর। এই বইটা যতবার হাতে নেই, কেমন একটা চাপা কষ্টবোধ পেয়ে বসে। বর্তমান আনন্দময় দিনগুলো থেকে আমি ভাসতে ভাসতে ভবিষ্যতের না হওয়া কোন এক বিষন্ন দিনে ঘুরতে থাকি। তবু এই ছোট্ট বইটার ছোট ছোট বিষন্ন শব্দগাঁথা আমার পড়তে ইচ্ছে করে। অনেক লেখার বিষয়বস্তু চলে যাওয়া। অনেক মানুষের চলে যাওয়া নিয়ে লিখতে লিখতেই তিনি নিজেও একদিন চলে গেলেন। আমি জুবায়ের ভাইয়ের ব্লগস্পটে ঢুকে পুরোনো লেখাগুলো খুঁজে পড়তে থাকি। আমি কি কোথাও নিজেকে খুঁজে পাই ওখানে?
সিকি আধুলি গদ্যগুলির নতুন একটা লেখা পড়লাম পরশু রাতে। ২০০৬ সালে প্রয়াত কবি সুরাইয়া খানমের স্মরণে। একালের খুব বেশী মানুষ তাঁকে চেনে না। সত্তর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়েছেন শিক্ষকতা করেছেন, ছিলেন তাদের কাছে ইংরেজী সাহিত্যের অধ্যাপক সুরাইয়া খানম এক আলোচিত কিংবদন্তী। যত না তাঁর প্রতিভা ও মেধার জন্য, তার চেয়ে অনেক বেশী রূপের জন্য, সম্পর্কের জন্য। সবচেয়ে বেশী আলোচিত কবি আবুল হাসান এবং লেখক আহমদ ছফার সাথে বিশেষ সম্পর্কের জন্য। লেখাটি পড়ার পর আমাকে পড়তে হলো আহমদ ছফার আত্মজৈবনিক উপন্যাস- 'অর্ধেক নারী, অর্ধেক ঈশ্বরী'। বইটিতে চরিত্রের নামগুলো বদলে দেয়া হলেও অধিকাংশ চরিত্রই আমাদের চেনা। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক থেকে শামীম শিকদার, আহমদ ছফা থেকে আবুল হাসান সবাইকে খুঁজে পাই। ছফার জীবনীকার নুরুল আনোয়ারের মতে উপন্যাসে বর্ণিত প্রতিটি ঘটনা সত্য। এখানেই কিছু গোলমাল লাগে। কারণ ছফার দৃষ্টি দিয়ে বিচার করলে সবার প্রতি ঠিক সুবিচার করা হয় না। আবার তৃতীয় পক্ষের সাক্ষ্য পাওয়াও মুশকিল। আবুল হাসানের কোন সম্পূর্ন জীবনী পাইনি। সুরাইয়া খানমের জীবনির খোঁজও জানা নেই। তবে সুরাইয়া খানমের পরিচয় খুঁজে গিয়ে পেলাম তিনি ভোয়ার দিলারা হাশেমের ছোটবোন। তাঁর আরেক বোন দিলশাদ খানম সত্তর দশকে বিটিভিতে রক্ত করবী নাটকের নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, সেই নন্দিনী যাকে আমি কৈশোরে দেখে এত বছরেও ভুলিনি। জুবায়ের ভাইয়ের লেখাটা আমাকে আবুল হাসান, সুরাইয়া খানম আর আহমদ ছফা ত্রয়ীর সম্পর্কের আরো ইতিবৃত্ত জানার আগ্রহী করায় আমি 'ছফামৃত' পড়ে ফেললাম আরো একবার।
জুবায়ের ভাইয়ের শেষ লেখা ছিল - দুই মাস যখন দুইদিনে নেমে আসে। চলে যাবার এক মাস আগের লেখা অথবা প্রকাশ। লেখাটি অসম্ভব বিষন্ন করে দেয় মন। এই বিষন্নতা কাটাতে নতুন কিছু পড়া দরকার। এই অন্তহীন মন খারাপিয়া চক্র থেকে বের করার জন্য অন্য কোন বই পড়তে হবে। ছফা নয়, আবুল হাসান নয়, অন্য অন্য কোন বই।
২.
ঈদে কোথাও বেড়াতে না গেলেও বাচ্চাদের নিয়ে রাতের বেলা রিকশায় করে পূর্ণিমা দেখতে বেরোলাম গত রাতে। পাশাপাশি প্রবারণা পূর্ণিমার ফানুস উড়ানোর অপরূপ দৃশ্যও দেখা হলো। শত শত ফানুস আকাশ ছেয়ে ফেলেছে, চাঁদের চারপাশে লালচে তারার মেলা। বাতাসে শীতলতা। অপূর্ব সুন্দর কিছু সময় কাটলো বাইরে। নিস্তব্ধ ছুটির শহরে এ এক পরম প্রাপ্তি।
No comments:
Post a Comment