Monday, October 20, 2014

সময় অসময়ের কথকতা

এক. হেমন্ত হিম

অনেকদিন পর হেমন্তের ঘ্রাণ পেলাম। গতকাল সন্ধ্যায় রিকশা নিয়ে যখন বাড়ি ফিরছিলাম তখন লালখান বাজার থেকে চিটাগং ক্লাবের দিকে যাবার পথে হঠাৎ বাতাসে একটা হিমেল স্পর্শ। অক্টোবর মাসে এই আবেশ বহুবছর নির্বাসিত ছিল। এই আবহাওয়া বসন্তের চেয়েও আদৃত। বাংলা কত তারিখ আজ? পত্রিকা দেখে জানলাম কার্তিকের ৫। হ্যাঁ কার্তিকেই তো একটু হিমহাওয়া বইবার কথা, সাথে হালকা কুয়াশা।

এমন আবহাওয়ায় কোথাও বেড়াতে ইচ্ছে করে। না শীত না গরম। আজকাল বসন্তে সেই সুখ নেই। ফেব্রুয়ারী থেকেই কেমন তেতে ওঠে আবহাওয়া। সকালটা সহনীয় হলেও দুপুরটা অসহ্য। বছরে একবার কক্সবাজারে ছোটে বাঙালী। আমিও। যেতে না চাইলেও যেতে হয়। বাকীরা যাচ্ছে, আমরা একঘরে হয়ে থাকি কি করে? প্রতিবার যাই, একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফিরে আসি। অবশ্য বিরক্তি আমার একারই। বাকীদের আনন্দ। ওদের আনন্দের জন্যই আমার যেতে হয় বিরক্তি সহ্য করে।

কিন্তু একটা সময় ছিল আমি কক্সবাজার গিয়ে এরকম বিরক্ত হতাম না। তখন আমি অনেক বেশী স্বাধীন ছিলাম বলেই? মনে হয় না। তখন কক্সবাজারে এত ভিড় হতো না, হাজার হাজার মানুষ আর দালানকোঠার ভিড়ে সমুদ্রের নির্জনতা হারিয়ে যেতো না। এখন একা হবার জো নেই। থাকার হোটেল, খাবার হোটেল সবকিছুর শান শওকত বেড়েছে, কিন্তু সেবা ও আন্তরিকতার মানে চরম অধোগতি। প্রতিটা হোটেলে একই খাবার, কোন বৈচিত্র নেই। তবু মানুষ হৈ হৈ করে যায়, হৈ হৈ করে খায়, হৈ রৈ ফুর্তিতে কলাতলীর রাস্তা মাতিয়ে রাখে। কেন জানি কক্সবাজার গেলে আমার খুব ক্লান্তি লাগে, সামান্য হেঁটেও কাতর হয়ে পড়ি। আর কেবলই ঘুম পায়। আমি গতবার দুদিন ছিলাম। অধিকাংশ সময় আমার ঘুমে কেটেছে হোটেলে।



দুই. স্মার্টফোন কীর্তি:

১. মানুষ এখন দুই প্রকার। 'নেট মানুষ' এবং, 'বাস্তব মানুষ'। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবজাতিকে এই দুই ভাগে বিভক্ত করেছে স্মার্টফোন।

২. আগের মানুষ বিবেক দ্বারা চালিত হতো, এখন চালিত হয় ফেসবুকের লাইক দিয়ে। স্মার্টফোনের দামে বিবেক কিনে নিয়েছে জুকারবার্গের ফেসবুক।

৩. অচেনা 'নেট মানুষ'কে যেমন আপন করে দিয়েছে স্মার্টফোন, তেমনি অতিচেনা বাস্তব মানুষকে ভুলে যেতে শিখিয়েছেও সেই স্মার্টফোন।

৪. পাশের বিছানায় তিনদিনের জ্বরে যে ভাই/বোন/বাবা/মা পুড়ে তামা হয়ে যাচ্ছে তার কপালে কখনো হাত ছোঁয়ায়নি। কিন্তু অতিদূর সমুদ্রের পাড়ে অদেখা আপন কেউ হাঁচি দিলেও আঁতকে উঠে বলছে, 'ম্যান তুমি তো ভীষণ সিক, যাও ডাক্তার দেখাও এখুনি। পাশে থাকলে আমি জলপট্টি দিতাম কপালে।' এও সেই স্মার্টফোন কীর্তি।

৫. একাকীত্ব ঘোচাতে আগের যুগে আত্মীয় বন্ধুর বাড়ি গিয়ে কড়া নেড়ে বলতো, অবনী বাড়ি আছো? এখন আত্মীয় বন্ধুর বাড়ি যাবার বদলে ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে খোঁজে 'হু ইজ অনলাইন নাউ'!

৬. পথে যেতে শোনা একটি সংলাপ- 'ফেসবুক, স্কাইপে, ভাইবার, হোয়াটসআপ, ট্যাঙ্গো কিছুই নাই? তাহলে আমাকে খুঁজে পাবে কি করে?'

.....................মাত্র এই ৬টি নয়, আরো অগুণতি আছে!

স্মার্টফোন আমাদের অনেক উপকার করেও যে যান্ত্রিক মানবতা শিখিয়েছে, ভার্চুয়াল বাস্তবতার রাস্তা খুলে দিয়েছে, সেই রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা মনুষ্যত্ব হারিয়ে বরণ করছি টেকনোলজির দাসত্ব!! আমি নিজেও এই দাসত্বের অনিবার্য শেকলে বন্দী হয়ে যাই মাঝে মাঝে।



৩. আত্মঘাতী বাঙালী

নীরদ চৌধুরীকে খুব অপছন্দ করতাম একসময়। বাঙাল বিদ্বেষী লোক বলে খ্যাত। কিন্তু তার আত্মঘাতী বাঙালীতে কিছু অজনপ্রিয় সত্যি কথা পড়ে ভিন্নভাবে ভাবতে হচ্ছে এখন। বাংলাদেশ এবং বাঙালী জাতি আসলেই একটা সংকটপ্রিয় মানবের একটা অংশ। বাঙালী হুমায়ূন আজাদের তিতা কথাগুলোতেও চরম সত্য কথার নজির ছিল। আমার কি দেশপ্রেম কমে যাচ্ছে?


No comments: