আমার মেয়ের বয়স পৌনে তিন বছর। এর মধ্যেই ওকে কোন স্কুলে পড়ানো হবে, কিরকম শিক্ষা দেয়া হবে এ নিয়ে ওর মা-দাদী-ফুফু-খালারা চিন্তিত। সবাই নাকি এখন আড়াই বছর থেকে বাচ্চাকে স্কুলে দেয়া শুরু করে। আমি স্পষ্ট বলে দিয়েছি, আমি যেরকম স্কুলে পড়েছি আমার মেয়েকেও সেরকম পড়াবো। আর এত তাড়াতাড়ি স্কুলে দেবার কোন ইচ্ছে নেই এবং ওকে এখনি সর্ববিদ্যায় পারদর্শী করে তোলার কোন দরকার নেই।
আমি এমন স্কুল চাই যেখানে বইপত্র সবচেয়ে কম এবং ফাঁকি দেয়ার সুযোগ সবচেয়ে বেশী। ফেল করলেও তুলে দেবে পরের ক্লাসে এরকম। সরকারী প্রাইমারী স্কুল এক্ষেত্রে আমার সবচেয়ে বেশী পছন্দ। আমার কথা শুনে সবাই তেড়ে আসে আমার দিকে। ওসব স্কুলে পরিবেশ নেই। বুয়ার ছেলেমেয়েরাও ওসব স্কুলে পড়ে না এখন।
কিন্তু মেয়েকে আমি এই বয়স থেকে বিদ্যার জাহাজ বানাতে চাই না। আমি চাই ওর শৈশবটা কৈশোরটা আনন্দময় হোক। বড় হবার পর সে নিজেই বেছে নিক তার পছন্দের রাস্তা।
ভাবি সরকারী স্কুলগুলোতে যদি পড়াতে না চায়, তাহলে সরকার এত টাকা-পয়সা বাজেটে খরচ করে ওই স্কুলগুলো কাদের জন্য রেখেছে? আমি কেন আমার সন্তানকে একটা সহজ শিক্ষাব্যবস্থায় বড় করতে পারবো না?
৩৫ বছর আগে আমি যখন একটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেনীতে ভর্তি হতে যাই, স্কুলের দুটি জিনিসের স্মৃতি এখনো জেগে আছে। একটি বেত হাতে মাষ্টার, অন্যটা বিশাল খেলার মাঠ। একটা দেখে ভয়, অন্যটা দেখে আনন্দ পেয়েছিলাম। আমাদের বই ছিল সামান্য। পড়াশোনা সামান্য, মাঠটা বিশাল এবং খেলার সময় অফুরন্ত হওয়াতে স্কুল খুব আনন্দময় ছিল।
দৈনিক সর্বোচ্চ আট ঘন্টা পড়াশোনার জন্য ব্যয় করেছি শুধু মেট্রিক পরীক্ষার সময়। আমাদের শৈশব, কৈশোর, কী আনন্দময় ছিল ভাবলে এখনকার ছেলেমেয়েদের জন্য কষ্ট লাগে।
এখনকার ছেলেমেয়েরা কী করে? শরীরের অর্ধেক ওজনের একগাদা বই নিয়ে স্কুলে যায়। দমবন্ধকরা গাদাগাদি ক্লাসরুম। হোমওয়ার্ক, স্কুলওয়ার্ক, প্রাইভেট টিউটর, মওলানা হুজুর। জ্ঞানার্জনের নানা ক্যাচাল। সন্ধ্যে হলে টেবিলে বসা, ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে পড়তে পড়তে নটা-দশটা বাজানো। তারপর হয়তো টিভি দেখা নয়তো খেয়েদেয়ে ঘুম। এখানে খেলার মাঠ কোথায়, খেলাধুলা কোথায়, আনন্দ করার অবকাশ কই?
স্কুলের মাঠ নেই, খেলাধুলার ব্যবস্থা নেই, জনসংখ্যার চাপে জায়গা সংকুচিত হতে হতে স্কুল এখন সিড়িঘরে পর্যন্ত আশ্রয় নিয়েছে। ঘিঞ্জি বাড়ীর দুটি কক্ষ হলেই একটা স্কুল খুলে ফেলা যায় এখন। কি পড়াবে, কে পড়াবে এসব বিবেচনার কোন বালাই নেই। দরকারি-বেদরকারি ইংরেজী বইয়ের ছড়াছড়ি। বাচ্চা ছেলেদের আয়ারল্যান্ডের রাইমগুলো পিটিয়ে মুখস্ত করানো হয়। কেউ বলার নেই। কোন বয়সে কতটুকু শিক্ষা প্রয়োজন, তার কোন নিয়মনীতি নেই। বাচ্চাদেরকে খুব তাড়াতাড়ি বিদ্যার জাহাজ বানিয়ে ফেলতে হবে। ক্লাস টু থেকে নিউটন পড়াতে হবে, ইকুয়েশান শেখাতে হবে, তুমুল স্মার্ট করে তুলতে হবে, এজন্যই হুড়োহুড়ি সব।
জাতির মেরুদন্ড মজবুত করার জন্য রীতিমত জাঁতাকলে পিষ্ট করে হলেও শিক্ষার নামে অপ্রয়োজনীয় বিদ্যা গিলিয়ে ছাড়বে আমাদের সেই ইংরেজী বিদ্যালয়গুলো। অভিভাবকদের তাড়াহুড়োও দেখার মতো। এমনিতে খেলাধুলার জায়গা নেই, তাদের যে অবসরটুকু থাকার কথা এই বয়সে, কিছু অতি সচেতন অভিভাবক তাও গ্রাস করে ফেলেছে।
একটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার এক কাজিন তার দুই ছেলেকে বাংলা ইংরেজী আরবী সর্ববিষয়ে বিশেষজ্ঞ করে তোলার স্বপ্ন দেখছেন। ভোর থেকে শুরু হয় তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন প্রকল্প। ঘুম থেকে উঠে কোনমতে নাস্তা গিলিয়ে স্কুলে চলে যায় দুই ভাই। একজনের বয়স ৬ বছর আরেকজন ৮ বছর। কিণ্ডারগার্টেনে ইংরেজী বাংলার পড়াশোনা শেষ করে দুপুরের আগে আগে চলে যায় ক্যাডেট মাদ্রাসায়। সেখানে আরবী অধ্যয়ন চলে। ফিরতে ফিরতে ৩ টা বাজে। খেয়ে উঠতে না উঠতে হুজুর আসবে প্রাইভেট পড়াতে। হুজুর যেতে যেতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, তারপর আসবে ইংরেজী অংকের মাষ্টারমশাই। মাষ্টারমশাই যেতে যেতে নটা বাজে। তারপর স্কুলের হোমওয়ার্ক তৈরী চলে রাত দশটা অবধি। এরপর খাওয়া সেরে ঘুমোতে ঘুমোতে রাত সাড়ে এগারটা পেরিয়ে যায়। পরদিন ভোরে উঠে আবার সেই একই রুটিন।
বাচ্চাদের এই ব্যস্ততার গল্প আমার সেই ভাই ও ভাবী তৃপ্তির সাথে খুব গর্বের সাথে বলে বেড়ায়-'পড়াশোনার এত চাপ, একদম সময় পায় না ওরা'। হায়, পড়াশোনাটাও ফ্যাশানের পর্যায়ে পৌছে গেছে।
আমি কাজিনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এভাবে চললে ওদের খেলাধুলা করার সময় কোথায়? উনি বলেন - 'খেলাধুলা করলে তো দুষ্টু হয়ে যাবে, এখন সারাদিন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত আছে ভালো আছে। আর ওরা তো সময় পেলে ভিডিও গেম খেলে কম্পিউটারে। আরো বড় হলে খেলাধুলা করতে পারবে' আমার মাথাটা গরম হয়ে যায় শুনে। এই হলো আমাদের অভিভাবক সমাজের একাংশের মানসিকতা। যার সাথে তাল মিলিয়ে চলছে স্কুলগুলো এবং দেশের জগাখিচুড়ি শিক্ষাব্যবস্থা।
শিক্ষার মধ্যে কোন আনন্দ নেই। যে বইগুলো পড়ানো হয় আদৌ সেগুলোর দরকার আছে কি না কেউ ভাবে না। যদি দরকার না থাকে তাহলে কেন সেই অপ্রয়োজনীয় বইগুলো পড়িয়ে বাচ্চাদের মাথা খারাপ করে দেয়া হবে? অর্থ, সময়, মেধার অপচয় বন্ধ করার পদক্ষেপ কে নেবে? শিক্ষাকে বানিজ্যের লোলুপ গ্রাস থেকে রক্ষার দায়িত্ব কার?
আমার মাথা চলে না।
[সহব্লগার গৌতম আর দিগন্তের শিক্ষাবিষয়ক লেখাগুলোর কাছে আমার অনেক কৃতজ্ঞতা। বাংলাদেশের অপশিক্ষা নিয়ে একটা চিন্তাপোকা বহুদিন যন্ত্রনা দিচ্ছিল বলে যাচ্ছেতাই একটা তাৎক্ষনিকভাবে লিখে ফেললাম। এই বিষয়ে পরে আরো লেখার ইচ্ছে আছে।]
No comments:
Post a Comment