দানু মিয়ার পড়াশোনার দৌড় আন্ডার মেট্রিক হলেও আক্কেলের জোরে আর ভাগ্যের ফেরে এখন সে বিশাল কোটিপতি। তবে লোকটা লৌহকেপ্পন। হিসেবের এক পয়সা এদিক সেদিক হলে পিটিয়ে আড়তের কর্মচারীর পিঠের ছাল তুলে ফেলে। সকালে দুইটা টোষ্ট চায়ে ভিজিয়ে নাস্তা করে দানু মিয়া। যদি কখনো দুপুরে দাওয়াত থাকে, শুধু একখান টোষ্ট দিয়েই নাস্তা সেরে বসে থাকবে সেই দুপুর পর্যন্ত। ধুতে বেশী সাবান লাগার ভয়ে প্যান্ট না পরে লুঙ্গি পরে। গেঞ্জী পরলে শার্ট পরে না, শার্ট পরলে গেঞ্জী পরে না।
এই দানুমিয়া সেদিন বাড়ী ফিরে বউকে হাঁক ডাক দিয়ে কাছে আনে। বউ এসে দেখে দানু মিয়া একা একা হাসছে। হাসতে হাসতে তার গাটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। বউ ঘাবড়ে গেল। লোকটাকে এরকম তো দেখিনি কখনো। হায় আল্লা কী হলো আবার। দানু মিয়া খিক খিক করে হাসতেই থাকে। বিছানায় গড়িয়ে পড়ে তবু হাসে। বউ মুখ ঝামটা মেরে বললো-
-ঢং কইরেন না কুদ্দুসের বাপ, কি হইছে খুইল্লা কন।
-কইতাছি কইতাছি। আরে বেকুব তো আর গাছে ধরে না। আগে ভাবতাম দুনিয়াতে আল্লায় তোমার চেয়ে বেশী বেকুব আর কাউরে বানায় নাই। আইজকা আরেকটার সন্ধান পাইছি।
-অ সেই কথা, সেজন্য এমন কইরা হাসতে হবে, মর জ্বালা।
-আচ্ছা কও তো, বেকুব লোকজন সব আমার কাছে আইসা ধরা দিব এডা কেমুন বিচার। তাই হাসতাছি। কপাল মোর।
-হ্ইছে, আপনে হাসেন আমার রান্নাঘরে কাম আছে, যাই।
-আরে যাও কই, ঘটনা না শুইনা যাইতাছ কই? আইজকা যে বেকুবের সাথে দেখা হইছে আগামী দশ বছর রান্নাবান্না না করলেও চলবে তোমার।
-কি কও এসব?
-শোনো, আইজ দুপুরে খাইয়া ক্যাশের মধ্যে হেলান দিয়া ঝিমাইতাছিলাম, এমন সুময় ব্রিফকেস নিয়া এক ভদ্রলোক আসছে, আমি ভাবছি ইন্সুরেন্সের দালাল, ভাগায়া দিমু, এমন সময় লোকটা অদ্ভুত একটা প্রস্তাব দিল। সে একটা ব্যবসা করতে চায় আমার সাথে। ব্যবসাটা খালি ৩০ দিনের জন্য। টাকা পয়সার লেনদেন। সে আমারে সকালে এক লাখ টাকা দেবে, বিকেলে আমি তাকে ১ পয়সা ফেরত দিব। প্রতিদিন এক লাখ টাকা। কিন্তু শর্ত হলো সে এক লাখের বেশী কখনোই দেবে না, আর আমারে আগের দিনের দ্বিগুন দিতে হবে। মানে ১ম দিন ১ পয়সা, ২য় দিন ২ পয়সা, ৩য় দিন ৪ পয়সা, ৪র্থ দিন ৮ পয়সা এরকম। আমি দেরী না কইরা খপ কইরা ব্যবসাটা ধইরা নিলাম।
-মজার ব্যবসা তো! কিন্তু এখানে কোন ফাঁকিঝুকি নাই তো?
-আমার লগে ফাঁকিঝুঁকি? দলিল করায়া নিছি, রেজিষ্টার্ড দলিল। বাটপারি করলে পুলিশে ধরায়া দিমু। উকিলের সাথে পরামর্শ করছি। উকিল বলছে কোন অসুবিধা নাই।
তবে দানু মিয়া একটু সন্দেহ করেছে লোকটা নাও আসতে পারে। হয়তো রাতে হিসেব করে দেখবে কিরকম রাম ধরা খাইতে যাইতেছে, তাইলে নাও আসতে পারে।
কিন্তু দানু মিয়াকে অবাক করে দিয়ে পরদিন সকালে লোকটা আসে এবং দানু মিয়াকে এক লাখ টাকার প্যাকেট বুঝিয়ে দেয়। টাকা জাল কিনা পরখ করে দানু মিয়া ক্যাশে টাকা রেখে দেয়। প্রতিদিন এমন করে দানু মিয়ার দিন শুরু হয়। লোকটা কথা রেখেছে। ঠিক নটার সময় এসে ১ লাখটাকার প্যাকেট বুঝিয়ে দিয়ে যায়। আবার বিকেলে এসে পয়সা বুঝে নিয়ে যায়।
আহারে বেচারার বাস ভাড়াও হয় না। মাঝে মাঝে দানু মিয়ার মায়াও লাগে, অপরাধবোধও জাগে একটু। বোকা পেয়ে এমন ঠকানি ঠকিয়ে নিচ্ছে বলে। তবু কী আর করা, সে তো আর লোকটাকে ডেকে আনে নি। নিজে নিজে এসে ধরা দাও কেন? ব্যবসা হলো ব্যবসা। একটু আফসোস ব্যবসাটা ত্রিশ দিন না হয়ে যদি তিন বছর হতো, ইশশশ!! দানু মিয়ার চোখ লোভে জ্বলজ্বল করে।
দিন ভালোই যাচ্ছিল দানু মিয়ার। ১৯ দিন পর্যন্ত ১৯ লাখ টাকা ভরেছে আর নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছে। হিসেব রাখার প্রয়োজনও বোধ করেনি।
২০ দিনের দিন দেখলো মানিব্যাগের টাকায় কুলোচ্ছে না আর। এটিএম থেকে তুলতে হলো ৫২৪২.৮৮টাকা। তবু দুশ্চিন্তার কিছু নেই। ইতিমধ্যে তার ২০ লাখ পাওয়া হয়ে গেছে।
২৪তম দিন একটু দুশ্চিন্তার হাওয়া লাগলো। দানু মিয়ার ভুরু কুঁচকাতে শুরু করলো। এটিএম দিয়ে কুলাচ্ছে না। ব্যাংক থেকে তুলতে হলো ৮৩,৮৮৬.০৮টাকা।
২৬তম দিনে টাকা দেয়ার পর হিসেব খুলে বসতেই হলো। দানু মিয়া হিসেব করে দেখলো আজকে নিয়ে সে মোট পেয়েছে ২৬ লাখ, দিয়েছে ৬৭১,০৮৮.৬৩। বুকে ব্যাথা শুরু হলো তার।
২৭তম দিন বিকেলে টাকা দেবার পর দানু মিয়া শয্যাশায়ী। ডাক্তার কারো সাথে দেখা সাক্ষাত বারন করে দিল। কর্মচারীকে দিয়ে টাকা দেয়ার ব্যবস্থা করা হলো। সেদিন দিতে হলো ৬ লাখের বেশী। এই নিয়ে মোট গেল ১৩,৪২,১৭৭.২৭ টাকা।
৩০তম দিন শেষ বিকেলে দানুমিয়ার ঘুম ভাঙলে সে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে কর্মচারীকে ডাক দিল। জিজ্ঞেস করলো লেনদেন শেষ হয়েছে কিনা। কর্মচারী এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো - 'স্যার আজকেই শেষ। আজ দিয়েছি ৫৩,৬৮,৭০৯.১২ টাকা। এ পর্যন্ত মোট দেয়া হয়েছে ১,০৭,৩৭,৪১৮.২৩। পাওয়া হয়েছে ৩০ লাখ। নীট ক্ষতি ৭৭,৩৭,৪১৮.২৩ টাকা।'
কোটিপতি দানু মিয়া জ্ঞান হারিয়ে বিছানার উপর লুটিয়ে পড়লো।
No comments:
Post a Comment