বোকাসোকা লোকগুলা কখনো মুশকিলে আসান হতে পারে, আবার কখনো আসানকে মুশকিলে ফেলতে পারে। মোশাররফ রানা তাদের একজন। নামে যেমন চেহারা সুরতেও টিভি নাটকের মোশাররফ করিমের কাছাকাছি। তার আচার আচরন যদিও একটু বোকাবোকা কিন্তু মজার লোক বলে খুব জনপ্রিয়। অ-ইংরেজ বিদেশীদের সাথে নিয়মিত কথোপকথনের কল্যানে তার ভাষাজ্ঞান বাংরেজী মেশানো শারীরিক অঙ্গভঙ্গির অনন্য মাত্রায় পৌছে গিয়েছিল। এই ভাষাজ্ঞান দিয়ে সে হোমো স্যাপিয়েন্স গোত্রের সকল প্রানীর কাছে তার বার্তা পৌছে দিতে সক্ষম বলে আমার ধারনা।
কয়েক বছর আগে অফিস থেকে একটা ট্যুরে যাচ্ছিলাম ভিয়েতনামে। সঙ্গে ছিল ১৯ জন সহকর্মী। হ্যানয়ের উপকন্ঠে আমাদের একটা প্রজেক্ট আছে যেখানে বেশ কজন বাঙালীও কাজ করে। ওই ট্যুরটা অন্যন্য বারের চেয়ে আলাদা। ট্রেনিং -মিটিং-সেমিনার এসব ফালতু বিষয় নাই। শুধুই ঘোরাঘুরি, দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন, নির্মল বিনোদন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল হালং বে(Ha Long Bay)-তে নৌ বিহার ও বিখ ডং(Bich Dong)-লেকে ডিঙি নায়ে ভেসে বেড়ানো।
সহকর্মীদের মধ্যে আমি ছাড়া আর কেউ ভিয়েতনাম যায়নি আগে। আবার কয়েকজন ছিল যাদের এটাই প্রথম বিদেশ সফর, মোশাররফ রানা তাদের একজন। সে এমনিতেই আমাকে খুব পছন্দ করে তার উপর আমার পুর্বাভিজ্ঞতা থাকার কারনে ওখানে পৌছানোর পর থেকেই সারাক্ষন আঠার মতো আমার সাথে সাথে আছে। আমি যে দোকানে ঢুকি সেও ঢুকবে ওখানে। আমি যা কিনি, সেও তার একটা কিনবে। আমি যা ধরি সেও তা দরাদরি করবে। এরকম একটা ছায়াসঙ্গী বিরক্তিকর মনে হলেও ওর কান্ডগুলোর জন্য আমার মজাই লাগতো।
একদিন বেড়াতে গিয়ে পথে খিদে পেলে আমি শুকনো বিস্কুটের জন্য একটা মার্কেটের মতো জায়গায় গাড়ী থামালাম। রানাও নামলো আমার সাথে। আমি একটা বিস্কুট ধরলে - সে এগিয়ে দোকানী মহিলাকে বলে 'হাউ মাচ, ম্যাডাম গিভ মি এ প্যাক।' আমি অন্য বিস্কুট ধরি। সে আবারো এগিয়ে এসে বলে- 'হাউ মাচ, ম্যাডাম গিভ মি এ প্যাক।' ফলতঃ গাড়ীতে ফিরে আসার পর আমার হাতে দুজন খাবার মতো একটা বিস্কুটের প্যাকেট আর রানার হাতে বিশাল পলিব্যাগে নানান জাতের ভিয়েতনামী বিস্কুটের সমাহার।
আমাদের হোটেলটা ছিল শহর থেকে একটু দুরে। সাদামাঠা হোটেল কিন্তু প্রয়োজনীয় সব সুযোগ সুবিধা আছে। এসি, ফ্যান, টেলিফোন, টিভি, ভিসিডি থেকে শুরু করে বাথরুমে গরম ঠান্ডা পানির ব্যবস্থা সব কিছু। সব থাকলেও রাত দশটার দিকে রানার খেয়াল হলো মশারি নেই। মাঝরাতে যদি মশা কামড়ায় তাহলে কি দশা হবে। তখন তো ডেকেও কাউকে পাওয়া যাবে না। বিদেশ বিভুঁই, যা করার এখনি করতে হবে। রানা আমার রুমে এসে বললো, "ভাইয়া একটা সমস্যা তো হয়ে গেছে। এই ব্যাটারা তো মশারি দেয় নাই।" আমি বললাম, "এখানে মশা নেই, তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।" কিন্তু রানা নাছোড়বান্দা। মশারি ছাড়া তার নাকি ঘুম আসে না। তার ডেঙ্গুভীতি প্রবল।
পীড়াপীড়িতে অতিষ্ট হয়ে হোটেলের রুম সার্ভিসকে ডাক দিলাম। অল্পবয়সী ছেলেটা দুএক শব্দ ইংরেজী বোঝে। ইংরেজীতে বললাম কি চাই। সে মাথা নাড়লো। বুঝে নাই। ইশারায় বোঝালাম আবারো। কিন্তু ডানে বায়ে মাথা নাড়ছে। বুঝে নাই। ভুদাই একখান! নানা কায়দা করেও আমি ওকে বোঝাতে পারলাম না মশারি চাই একখান। আমাদের কথাবার্তার আওয়াজ পেয়ে উপর নীচের সব সহকর্মী রুম থেকে বের হয়ে এসেছে। ভিয়েতনামীরা ইংরেজীতে একদম গোল্লা। আমরা ছিলাম ইংরেজের কলোনী ওরা ছিল ফরাসী কলোনী। ফরাসীতে বললে হয়তো বুঝতো। ওই বিদ্যা আমার নেই। সাধারন ভিয়েতনামীদের ইয়েস নো বুঝাতেও কেয়ামত হয়ে যায়।
কিছুতেই যখন কাজ হচ্ছে না রানা হঠাৎ লাফ দিয়ে টেবিলের উপর উঠে দাঁড়ালো। দুহাত উঁচু করে কল্পনায় মশা খুঁজলো, তারপর ঠাশ ঠাশ করে কয়েকটা কাল্পনিক মশা মেরে বিদঘুটে অঙ্গভঙ্গি করে দুহাতে চৌকোনা আকৃতি দেখিয়ে জোড়া হাত গালের পাশে রেখে ঘুমের ভঙ্গী করলো। এটুকু দেখেই বুদ্ধিমান রুম সার্ভিস 'ওহ ইয়েস ইয়েস কামিং' বলে ছুট দিল নীচে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে রানার জন্য মশারি হাজির। ওদের ষ্টকে ছিল, কেউ চাইলে দেয়। তবে মশারিটা কেউ হাতে নিতে পারলো না। কারন রানার মশারি ক্যারিকেচারে মুগ্ধ দর্শককূল তখনো হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছিল।
এক সপ্তাহের ভ্রমন শেষ। ফেরার দিন এয়ারপোর্টে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে প্লেনে ওঠার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছি সবাইকে নিয়ে। প্লেন ছাড়বে কিছুক্ষনের মধ্যেই। বোর্ডিং ব্রীজ লাগানো হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ একজন পেছন থেকে এসে জানালো রানা বাইরে যাচ্ছে।
আমি ছুটে গিয়ে রানাকে ধরলাম। "কই যাও?"
রানা একগাল হেসে বললো, "এই তো পাঁচ মিনিটে চলে আসবো, একটু এয়ারপোর্টের গেটে যাচ্ছি একটা সিগারেট কিনতে"
আমি তাজ্জব হয়ে বলি,"একটা সিগারেট কিনতে গেটে যাচ্ছো?"
রানা সরলভাবে বললো, "মানে কয়েকটা খুচরা ভিয়েতনামী ডং রয়ে গেছে পকেটে, দেশে তো কোন কাজে আসবে না, তাই ভাবলাম একটা সিগারেট কিনে শেষ করে ফেলি। ভেতরে তো এক কার্টনের কম বেচে না। গেটের সামনে দোকান টোকান পাওয়া যাবে না?"
আমি আকাশ থেকে পড়লাম "তুমি জানো এটা কোন জায়গা? তুমি ইমিগ্রেশান, কাষ্টমস পেরিয়ে প্লেনের দরজায় দাড়িয়ে, এখান থেকে তুমি একটা সিগারেট কিনতে বাইরে যাবে? এটা কি গুলিস্তান সায়েদাবাদ পেয়েছ যে বাস ছাড়তে দেরী হচ্ছে একটা বিড়ি ফুঁকে আসি। যাও লাইনে দাঁড়াও গিয়ে, এখুনি প্লেন ছাড়বে"
বোর্ডিং ব্রীজে ঢোকার মুখে পেছনে তাকিয়ে দেখি মোশাররফ রানা বিরস মুখে লাইনের পেছনে দাঁড়িয়ে। ডান হাতটা তখনো পকেটের ভেতরে অবশিষ্ট খুচরো ভিয়েতনামী মুদ্রা গুলো ধরে রেখেছে।
No comments:
Post a Comment