অফিসের গেট থেকে সিকিউরিটি ফোন করে জানালো জামান নামের একজন আমার সাথে দেখা করতে চায়।
জামান। আমি দুই সেকেন্ড চুপ থাকলাম নামটা শুনে। বিরক্ত হবো কিনা ভাবছি। দুই সেকেন্ডে আমার মস্তিস্কের কোষগুলো যেন কয়েকশতবার স্মৃতিভ্রমন করে এলো। ওকে অফিসে আসতে দেয়া ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না। বললাম- আমি আসছি।
জামান একটা জীবন্ত উপন্যাসের ট্র্যাজিক হিরো কিংবা ভিলেনের নাম। ঔপন্যাসিকের চোখে সে হিরো নিঃসন্দেহে, কিন্তু সমাজের চোখে সে ভিলেন অপয়া দুষ্টলোক। কোন কোন মানুষের জীবন চটকদার উপন্যাসের চেয়েও বিস্ময়কর, জামান তাদের একজন। জামানকে নিয়ে কখনো লিখতে হবে ভাবিনি। জামানের জীবনটা সুস্থ স্বাভাবিক থাকলে কখনো লিখতে হতো না। অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম ওকে নিয়ে লিখবো। এরকম একটা ঘটনাকে পাঠক আজগুবি চাপাবাজি বলে উড়িয়ে দেবে বলে সাহস করিনি। কিন্তু সেদিন জামানের সাথে আবারো কথা বলে ইচ্ছে হলো লিখেই ফেলি।
ক্লাস নাইনে পড়ার সময় জামানের সাথে পরিচয়। আমি একজন ঘোর আড্ডাবাজ। ক্লাস নাইন থেকেই শুরু। জামানের হাত ধরেই। আড্ডার মধ্যমনি বলে একটা বস্তু থাকলে জামান ছিল তার চেয়েও বেশী। জামানের সাথে আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের হলেও সে যেন নক্ষত্র, আমরা গ্রহ। অথবা সে যদি গ্রহ হয়, আমরা উপগ্রহ। জামানকে প্রদক্ষিন করেই আমাদের যত আড্ডা। সেই আড্ডা হতে পারে সকাল ছটায়, কিংবা রাত বারোটায়। জামান থাকলে আড্ডা জমবে। সে প্রচুর কথা বলতো, প্রচুর জানতো। আমরাও বলতাম, কিন্তু জামানের মতো কেউ পারতো না। ওর কথা শোনার জন্যই আমরা ওকে ঘিরে থাকতাম। জামানের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু কে সেটা নিয়ে একট গোপন ঈর্ষা ছিল বন্ধুদের মধ্যে। জামান আমাদের মধ্যে সবচেয়ে স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান। যখনই হোটেলে খাওয়াদাওয়া হতো, জামান বিল দেবে এটা ধরে রাখা যায়। আমার খুব ইচ্ছে হতো জামানকে একবার খাওয়াই, কিন্তু সুযোগ পেতাম না। সমস্ত স্কুল কলেজ ভার্সিটি জীবনে মাত্র বার তিনেক বোধ হয় ওকে খাওয়াতে পেরেছি।
জামানের মনটা ছিল খোলা আকাশ। সেই আকাশে আমরা খেলতাম, হাসতাম গড়াগড়ি দিতাম। জামান যেভাবে চাইতো আমরা সেইভাবে করতাম। জামানের মন পাওয়া আমাদের জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল। এটাকে কী সম্মোহনী ক্ষমতা বলে? জামান যে গান গাইতো, আমরা সেই গান নকল করতাম। জামান যে সিনেমা দেখবে, সেই সিনেমা অবশ্যই আমাদের প্রিয় হবে। জামানের কতগুলি মজার দর্শন ছিল, আমরা সেগুলোকে ভালোবাসতাম। জামান কোন মেয়েকে পছন্দ করলে সেই মেয়েকে রাজী করাবার জন্য আমরা স্বর্গ পেড়ে দিতে চাইতাম। অদ্ভুত ভক্তি ছিল আমাদের।
জামানের পোষাক আশাক ছিল মার্জিত ও আধুনিকতার উত্তম সমন্বয়। আমরা কেউ জামানের সমকক্ষ হবার কথা ভাবতেও পারতাম না। জামানের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। কোন শত্রু ছিল না। দুষ্টলোকেরা জামানকে ভয় পেত। অপ্রিয় সত্য বলতে জামান অকপট ছিল। জামানের বহুমুখী গুন ছিল। সে একাধারে সুপুরুষ সুগায়ক বাকপটু আবার অন্যদিকে শক্তিমান কৌশলী। খালি হাতে আত্মরক্ষা বিদ্যায় কালো বেল্টধারী। পুরো শহরে জামানের চেয়ে শক্তিমান লোক পাওয়া দুষ্কর ছিল। জামান চাইলে বাংলাদেশের সেরা একজন হতে পারতো।
কিন্তু জামান সেরকম হলো না কিংবা হতে চাইলো না। জামান চলতে শুরু করলো ভিন্ন পথে। ঠিক কখন ভিন্নপথে যাওয়া শুরু করেছে আমি জানতাম না। তবে আমি ও কয়েক বন্ধু শিক্ষাজীবনের শেষদিকে অন্য এলাকায় চলে যাই বাসা বদল করে। ফলে আড্ডায় যাওয়া হতো না নিয়মিত। আড্ডার মানুষগুলো বদলে যেতে থাকে। গ্রহ ঠিক থাকলেও উপগ্রহগুলো বদল হয়। সম্ভবতঃ এখান থেকেই সমস্যার সুত্রপাত।
আর চাকরীতে ঢোকার পর জামানের সাথে আমার দেখা সাক্ষাত প্রায় বন্ধ। বন্ধুদের মাধ্যমে মাঝে মাঝে খোঁজ পেতাম ওর। শুনতাম জামান এখন জুনিয়র ছেলেদের সাথে আড্ডা দেয়। যে সব ছেলেদের সাথে আড্ডা দেয় তারা জুনিয়র হলেও জগতে আমাদের সাথে অনেক অগ্রসর। আমাদের আড্ডার অন্যতম একটা উপাদান ছিল সিগারেট। কিন্তু নতুন আড্ডায় নাকি গাঁজা, ট্যাবলেট, ডাইলের আগমন ঘটেছে। নতুন উপগ্রহরা গ্রাস করে নিয়েছে গ্রহকে সেসব দিয়ে। এগুলো দেখে আমাদের অবশিষ্ট বন্ধুরা ওসব আড্ডা থেকে নিজেদের সরিয়ে নিল। জামান এখন শুধু নতুন উপগ্রহদের নিয়ে আছে।
বন্ধুরা আফসোস করতো দুর থেকে। জামান নষ্ট পথে চলে যাচ্ছে। ওকে ফেরানো দরকার। আমাকে মাঝে মাঝে বলা হয়। আমি বললে নাকি শুনবে, ওর বাবা-মারও তাই ধারনা। আমি ওর সাথে আড্ডা দেয়া শুরু করলে আবার ফেরানো যাবে ওকে। কিন্তু আমার তখন পেশাদারী ব্যস্ততা। একজন বন্ধুর মঙ্গলের জন্য নিজের সময় নষ্ট করতে চাইলাম না। তাছাড়া সে তো যথেষ্ট বুঝদার, নিজেই ফিরে আসবে এক সময়।
ফিরে আসেনি সে। নেশার জগতের পাশাপাশি বিচরন শুরু হলো অন্ধগলিতে। শুধু বিচরন করলেই হতো। একদিন কাদায় পা আটকে গেল তার। আর বেরুতে পারলো না। কানাগলির একটা মেয়ের ঘরে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। একদিন মেয়েটা বোমা ফাটালো। জানালো সে গর্ভবতী এবং তার সন্তানের বাবা হলো জামান। জামান পালিয়ে আসতে পারতো, কিন্তু আসেনি। কেন আসেনি সেটাই একটা বিরাট বিস্ময় এবং অন্য সকল মানুষ থেকে জামানকে আলাদা করে। অন্য যে কেউ হলে ঠিকই পালিয়ে আসতো। কিন্তু জামান আসেনি। সে বিয়ে করে ফেললো সেই কানাগলির কুৎসিত মেয়েটিকে। পরিবারের মুখে চুনকালি দিয়ে তার বিলাসী জীবন ছেড়ে বস্তিতে উঠলো।
জামানের এই ঘটনার কোন ব্যাখ্যা আমি খুজে পাই না। যে মানুষ এরকম নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে, মাগীবাজী করে, সে কী করে এতটা মহৎ হয়। আমি জামানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। কেন? জামান যে কথাটা বললো তাতে আমার হা আরো বড় হয়। বিয়ের পর সে জানতে পেরেছিল মেয়েটার সিফিলিস হয়েছে। তিনমাস হাসপাতালে সেবা করতে করতে সুস্থ করে তুলেছিল মেয়েটাকে। সন্তান প্রসব করার পর মেয়েটা তাকে নিয়ে মেয়ের গ্রামে চলে যায়। সেখানে মেয়েটার বাবা-মা থাকে।
গ্রামে গিয়ে আরেক জীবন তার। শ্বশুর লবনচাষী, সেও লবনচাষে যুক্ত হয়। বছরের পর বছর লবনচাষ করে জামান। লবনচাষেও একসময় ধরা খায়। ফিরে আসে শহরে। তখন তাদের দুটি সন্তান। এবার বউকে গার্মেন্টসে কাজ দেয়। নিজে চাকরীর চেষ্টা করে। অভাবে অনটনের জ্বালায় জামান একবার নিজের বাসায় গেলে তাকে প্রস্তাব দেয়া হয় সে যদি মেয়েটাকে ছেড়ে দেয় তাহলে তাকে আমেরিকা কানাডা পাঠিয়ে দেবে। অনেক টাকা পয়সার লোভ দেখানো হয়। জামানের বাবার অগাধ টাকা পয়সা। কিন্তু জামান রাজী হয় না। সবকিছু করতে পারে, কিন্তু মেয়েটাকে সন্তানদের ত্যাগ করতে রাজী হয় না। আপোষ না করে ফিরে যায় অভাবের কুটিরে। আবারো যুদ্ধ শুরু। এই যুদ্ধের সময়ই সে একদিন আমার ঠিকানা নিয়ে অফিসে আসে। তখনই প্রথমবারের মতো তার কাহিনীগুলো জানতে পারি। প্রথমে আমি ওকে দেখে চিনতে পারিনা। মুখ ভর্তি দাড়িগোফ। বয়স যেন আমার চেয়ে দশ বছর বেড়ে গেছে।
সেদিনই আমার জানার শুরু তার নতুন অধ্যায়। খুব সংকোচে যতটা সম্ভব বলে আমাকে। তারপর বলে খুব অভাব। চাকরী দরকার। তার আগে দরকার কিছু নগদ। ঘরে চাল কেনার টাকাও নেই। বাচ্চারা অনাহারে। আমার এত কষ্ট লাগলো। চোখ জ্বালা করতে লাগলো। সেই জামানের এ কী দশা আজ। মানুষের জীবন এত বিচিত্র কেন? আমি পকেট থেকে হাজার খানেক টাকা বের করে দিলাম। সে বললো, টাকার জন্য ধন্যবাদ, কিন্তু এ টাকা হয়তো ফেরত দিতে পারবো না। মাফ করে দিস। আমি বললাম, লাগবে না। পরে আরো লাগলে আসিস।
সেই শুরু। জামান আমার কাছে আসতে লাগলো মাঝে মাঝে। আমি একবার দুবার তিনবার যতটা সাধ্যে কুলায় দিতে থাকি। একসময় আমিও হাঁপিয়ে উঠি। বিরক্ত হতে থাকি। একবার স্পষ্টই বলে দেই- টাকা নেই। একশো টাকাও দিতে পারবো না। তবু সে পঞ্চাশ টাকা নিয়ে বিদায় হয়। তারপর বহুদিন যোগাযোগ নেই আর। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।
তিন বছর পর আজকে আবার এলো। কি জন্য এসেছে? টাকার জন্য তো বটেই। নীচে নামতে নামতে ভাবলাম। নীচে নেমে বললাম, আয় গাড়ীতে ওঠ। অফিস থেকে কিছুদুর গিয়ে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে নামলাম। আমি কাটাকাটা সুরে বললাম-
-বল কি জন্য এসেছিস?
-তোকে দেখতে
-আসল কথা বল
-কিছু টাকা দে
-কত?
-হাজার দুই হলে চলবে
-এক হাজার আছে, নে
-এক হাজারে হবে না। পরে দিলেও চলবে, তবে দুই হাজার লাগবে।
-কী করবি?
-তোর কাছ থেকে শেষবার যাবার পর একটা চাকরীর দরখাস্ত করি। একটা কোম্পানীর সিকিউরিটি গার্ড। আমার যে বয়স অন্য চাকরী পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু গার্ডের চাকরীতে এসএসসি পাশ দরকার। একজন বললো বিএ এমএ বললে প্রাথমিক যাচাইতেই বাদ পড়বো। তাই মিথ্যে বলে মেট্রিক পাশ বলে চাকরীটা বাগালাম। বেতন খারাপ না, সব মিলিয়ে পাঁচ ছহাজার পাই। পার্মানেন্ট হয়েছে গত বছর। এবার একটা প্রমোশনের সুযোগ এসেছে। বিএ পাশ হলে প্রমোশন মেলে। ইন্সপেক্টর পদে। এখন সবাই জানে আমি বিএ পাশ। তবে অফিসে ফাইল নাড়ার জন্য কেরানীদের কিছু টাকা দিতে হয়, এ সপ্তাহেই দিতে হবে। আমার কাছে অত নাই। তাই তোর কাছে আসা।
-বাবার বাসায় যাস না?
-না, এখানে কেউ নেই এখন। বাবা রিটায়ার করার পর ঢাকা চলে গেছে। বাসা ছেড়ে দিয়েছে। আর কারো সাথে সম্পর্ক নেই।
-ও আচ্ছা
-তুই বিরক্ত হচ্ছিস জানি। কিন্তু আমার তো উপায় নেই। তুই ছাড়া আর কারো কাছে আমি যাই না।
-না, আসলে বিরক্ত না। আগে তুই নিজে কিছু করতি না বলে বিরক্ত হতাম। এখন একটা চাকরী করিস আমি এতেই খুশী। তোকে আমি টাকাটা কালকে দেবো।
-ঠিক আছে, আমি কাল আসবো।
জামান চলে গেল। আমি ভাবতে বসলাম মানুষের জীবনের অলিগলি নিয়ে। জামানের প্রতি আমার দায়িত্ববোধের অভাবটাও আমাকে পীড়া দেয়। আমি ওর জন্য কিছু করতে চাই। কিন্তু কী করবো বুঝতে পারছি না। কিছু করতে গেলে যদি উৎপাত বেড়ে যায়, সেজন্য বেশী কিছু করি না। যতটুকু করছি তা করাটা খুব সহজ হলেও ভান করতে হচ্ছে যেন আমার বেশ কষ্ট হচ্ছে। যাতে জামান আমাকে ঘন ঘন বিরক্ত না করে। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে আমি এখনো বুঝতে পারছি ওকে এখনো কতটা ভালোবাসি। যদি ওকে আরেকটু ভালো জীবন উপহার দিতে পারতাম! কেউ কি পারে? হাতের সীমানার বাইরে চলে যায় কত কিছু!
No comments:
Post a Comment