একদম পোলাপান বেলায় বাসায় নিয়মিত কোন দৈনিক পত্রিকা রাখা হতো না। বাবা যেদিন যা খুশী কিনতেন, কোনদিন কিনতেনও না। খবরাখবরের জন্য রেডিও ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। সকালে একবার রাতে দুবার বিবিসি আর ভয়েস অব আমেরিকার খবর শোনা হতো। আজকে অবাক লাগলেও সত্তর দশকে দল বেঁধে, আয়োজন করে মানুষ রেডিও শুনতো। কাছাকাছি মানুষদের মধ্যে একমাত্র বড় মামা আর মেজ চাচার বাসায় দৈনিক পত্রিকা নিয়মিত ছিল। বড়মামা সরকারী কর্মকর্তা। তার বাসায় সবসময় ইত্তেফাক রাখা হতো, মামা এত বেশী ইত্তেফাক ভক্ত ছিলেন যে আমি ভাবতাম ইত্তেফাক বোধহয় সরকারী পত্রিকা। এমনকি বড় হয়েও মামার বকা শুনতাম -তোরা কী ছাতামাতা পত্রিকা রাখিস, ইত্তেফাক রাখবি, ইত্তেফাক সবচেয়ে ভাল পত্রিকা (তখন আজকের কাগজ নতুন বেরিয়েছে আমি তাই রাখতাম)। আমার ইত্তেফাক পছন্দ ছিল না, ওটাকে আমার চিরকাল দালাল পত্রিকা মনে হতো। কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মামা ইত্তেফাক ভক্ত ছিলেন।
মেজচাচা ব্যবসায়ী মানুষ, বাম রাজনীতি করতেন। তিনি রাখতেন 'সংবাদ'। এটাও আমার চোখে 'সুন্দর' লাগতো না। ছাপাগুলো কেমন ছেড়াবেড়া, ছবিগুলো ঝাপসা। সেদিক থেকে ইত্তেফাক অনেক পরিচ্ছন্ন ছিল। তবে ইত্তেফাকের সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার ছিল বিজ্ঞাপনের হিবিজিবি আর প্রথম পৃষ্টায় প্রত্যেক খবরের দুলাইনের পর '৮ম পৃষ্টায় দ্রষ্টব্য' লেখাটি।
নিজে প্রথম নিয়মিত পত্রিকার গ্রাহক হই ১৯৮৩ সালে, 'কিশোর বাংলা' নামের একটা ছোটদের পত্রিকা। ভীষন প্রিয় পত্রিকা ছিল আমার। তখন ঢাকার পত্রিকা চট্টগ্রামে পেতে পেতে বিকেল হয়ে যেত। ভোরে উঠে চায়ের কাপের সাথে দৈনিক পত্রিকা শুধু গল্প উপন্যাসের বিষয়। 'কিশোর বাংলা' পেতাম বিকেল চারটার পরে। আরো কিছুদিন পর চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী রাখা শুরু করি কিশোর বাংলার পাশাপাশি। তারও কিছুদিন পর সাপ্তাহিক বিচিত্রা। আজাদীর ছাপাটাও পুরোনো লাগতো বলে বন্ধ করে দেই একসময়। আমি তখন থেকেই দৃষ্টিনন্দন পত্রিকার পিয়াসী ছিলাম। কিন্তু মনমতো একটাও ছিল না। চট্টগ্রাম থেকে দৈনিক পূর্বকোন যখন প্রথম প্রকাশিত হয় (সম্ভবতঃ ১৯৮৬ সালে) সেই প্রথমবারের মতো ঝকঝকে ছাপা একটা পত্রিকা হাতে পাই। ফটোকম্পোজ নামের আধুনিক প্রযুক্তির আমদানী ঘটেছিল তখন ছাপাখানায়। আমি পুর্বকোন রাখা শুরু করি।
কলেজে উঠে যায়যায়দিনের সাথে পরিচয়। ৩ টাকা দামের ভিন্ন আঙ্গিকের ৩২ পাতার পত্রিকাটি হারিয়ে দিলো বিচিত্রা-রোববারের মতো ৬৪ পৃষ্টার প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাকে। আশির দশকের বিশাল অংশের আধুনিক তরুনের চিন্তাভাবনার ধারক বাহক হয়ে ওঠে যায়যায়দিন। আমরা যাযাদি বিপ্লবে সামিল হলাম। শফিক রেহমান তখন আমাদের আইডল (আজকের নষ্ট শফিক রেহমানকে যখন দেখি, নক্ষত্রপতনের কষ্ট পাই)। ত্রিশ সেট অলংকার কাহিনীতে যায়যায়দিন নিষিদ্ধ হলে আমার ম্যাগাজিন কেনা বন্ধ। তবু প্রতি সপ্তাহে পত্রিকার ষ্টলে গিয়ে খোঁজ নিতাম কোন সুখবর আছে কিনা। নিষেধাজ্ঞা উঠেছে কিনা। কিন্তু এরশাদের কোপানলে পড়েছে যাযাদি। ছাড়পত্র মেলে নি। সেই সময় বাজারে ৩২পৃষ্টার আরেকটি বিপ্লবী পত্রিকা চলছিল -মিনার মাহমুদের 'বিচিন্তা'। আপোষহীন রাগী তারুন্যের পত্রিকা। বিচিন্তার গ্রাহক হলাম। এটা নেয়া শুরু করতে না করতে কিছুদিন বাদে এটিও এরশাদের কোপানলে নিষিদ্ধ ঘোষিত হলো।
তারও কিছুদিন পর মোজাম্মেল বাবু সম্পাদিত 'পূর্বাভাস' নামের একটা ঝকঝকে সাপ্তাহিক পত্রিকা দেখা গেল হকারের থালায়। দাম পাঁচ টাকা, সেই বত্রিশ পাতাই, কিন্তু কাভারটা অফসেটের ঝকঝকে ছাপা। প্রথম সংখ্যা কিনেই বিমুগ্ধ ভক্ত। যাযাদির সমকক্ষ হতে পারে পত্রিকাটি। কিছুদিন পর এটিও এরশাদের চক্ষুশলে পরিনত হলো। শিশিরের অসাধারন কার্টুনের সাথে পরিচয় হয় এই পত্রিকা দিয়েই। প্রিয় পত্রিকাগুলো একের পর এক নিষিদ্ধ হওয়াতে নতুন পত্রিকার জন্য চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকতাম। সেই সাংবাদিককুলের কাছে আমি আজো কৃতজ্ঞ দিনের পর দিন নিষেধাজ্ঞার খাড়া মাথায় নিয়ে যারা একের পর এক পত্রিকা উপহার দিয়ে চলেছিল। পত্রিকা প্রকাশের সাথে বানিজ্য ব্যাপারটা তখনো তেমন করে যুক্ত হয়নি।
প্রতিদিন ঘুরঘুর করতাম পত্রিকার ষ্টলের আশেপাশে। যদি নতুন কিছু চোখে পড়ে। অদ্ভুত নামের একটা পত্রিকা চোখে পড়লো একদিন। দুর থেকে লেখা দেখলাম 'কাগজ'। সম্পাদক নাইমুল ইসলাম খান। ছবি বিহীন, প্রায় বিজ্ঞাপন বিহীন অনেকটা ভাবগন্ভীর পত্রিকাটা হাতে নিয়ে বিশ্বাস জন্মালো এটি আমার নতুন পত্রিকা হবে। আমি খবরের কাগজের পাঠক হয়ে গেলাম সেদিন থেকে। কিন্তু বেশীদিন নয়। কয়েকমাস পরেই সামান্য একটা প্রতিবাদী কবিতা ছাপানোর জন্য নিষিদ্ধ হয় খবরের কাগজ। এরশাদের পুরো সময়টা ছিল আতুরঘরে সংবাদপত্র হত্যার কাল। এরশাদের প্রতি আমাদের প্রজন্মের ঘৃনার হার সবচেয়ে বেশী এই কারনেও। তবে এখন ভাবি সেই নির্যাতনগুলো ভবিষ্যতের জন্য ভালো হয়েছিল। তরুন সাংবাদিকদের পত্রিকা প্রকাশের চেতনাকে জিদকে আরো অনেক বৃদ্ধি করেছিল। বিপরীত অর্থে সংবাদজগতের জন্য মঙ্গল বয়ে এনেছিল। মেরুদন্ডহীন সাংবাদিকতার যুগের অবসান ঘটিয়ে সংবাদপত্রের নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল এরশাদের কঠোর নিষেধাজ্ঞার কারনে। নিষেধের বেড়াজালে তারুন্য আরো বেশী শক্তিমান হয়।
এরশাদ পতনের পর যেদিন জানতে পারলাম 'খবরের কাগজ' সাপ্তাহিকটি আজকের কাগজ নাম নিয়ে দৈনিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশ পাবে, সেদিন আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল এই পত্রিকাটা আমার নিয়মিত পত্রিকা হবে। পত্রিকা হাতে পেয়ে আমার বিশ্বাস আরো বদ্ধমূল হলো। নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরপুর, তথ্যসমৃদ্ধ, বিজ্ঞাপন উৎপাত বিহীন একমাত্র পত্রিকা ছিল আজকের কাগজ। আজকের কাগজকে আমি বলবো সংবাদপত্র জগতের 'একুশে টিভি'। আজকের সবগুলো টিভি চ্যানেলের আতুরঘর যেমন 'একুশে টিভি', তেমনি আজকের সবগুলো আধুনিক পত্রিকার আতুরঘর 'আজকের কাগজ'।
প্রিয় ম্যাগাজিন আর পত্রিকাগুলো ঘাটতে ঘাটতে আমি ততদিনে চিনে গেছি কে কোথায় লেখে, কোন কলামিষ্ট কোত্থেকে এসেছে। পত্রিকায় যারা লেখেন, কাজ করেন তাঁরা বোধহয় জানেন না, আমরা সাধারন পাঠকেরা দুর থেকে কিভাবে পত্রিকা কর্মীদের অনুসরন করি। পত্রিকা খুলে খবর পড়ার আগে প্রথমে কর্মীতালিকায় চোখ বুলানো আমার দুই যুগের অভ্যেস। এমনকি কম্পিউটার গ্রাফিকস এর দায়িত্বে কে আছেন সেটাও খেয়াল করতাম। কোন পত্রিকায় কে কোন বিভাগ দেখে সব মুখস্ত ছিল। ফলে কোন ছোটখাট নড়নচড়নও চোখ এড়াতো না। সাংবাদিক লেখকরা কোথাও ভুল করলে আমরা দুর থেকে বলে দিতে পারি। কিন্তু পাঠকের উপায় থাকে না সেই ভালোমন্দগুলো সেই লেখক সম্পাদক বা কলামিষ্টকে জানানোর। অনেকে পত্রিকায় লেখা পাঠাতো। আমি কখনো লিখতাম না। নিখাদ পাঠক ছিলাম আমি। পড়ার খিদে বরাবর বেশী। এখনো।
পত্রিকা কখনো ভাঙ্গতে পারে জানা ছিল না। প্রথম অভিজ্ঞতা হলো আজকের কাগজ দিয়ে। পত্রিকায় ভাঙ্গন পাঠকের মনে কিরকম আলোড়িত করে তা পত্রিকার মালিক বা কর্মীদের জানা নেই। আজকের কাগজের ভাঙ্গন আমাকে কষ্ট দিল। ভেঙ্গে একাংশ বেরিয়ে যাবার পর পত্রিকার মান ধপ করে নীচে নেমে গেল। এতে বোঝা যায় পত্রিকা মেশিনে ছাপা হলেও এর প্রধান কারিগর পেছনের মানুষগুলো। নতুন সম্পাদক আগের 'আজকের কাগজ' ফিরিয়ে আনতে পারলো না। আজকের কাগজ আমার নজর হারালো। পত্রিকা রাখা ক্ষান্ত দিলাম। কদিন পর ভোরের কাগজের খবর পেলাম। সম্পাদকীয় লাইন, ছাপা আর লেখা দেখে মনে হলো এটা আজকের কাগজের বিকল্প হতে যাচ্ছে। আমি ভোরের কাগজের গ্রাহক হলাম। একসময় ভোরের কাগজও ভেঙ্গে গেল। আবারও হতাশা। ভোরের কাগজের মান পড়ে গেছে। পত্রিকা নেয়া বন্ধ করলাম আবার।
খবর পেলাম প্রথম আলো আসছে। প্রথম সংখ্যাটা হাতে নিয়ে বেশ পছন্দ হলো। ভোরের কাগজের সাদাকালো নীতি বাদ দিয়ে রঙিন পত্রিকা। খোঁজ নিয়ে জানলাম এখানে সেই কারিগরেরা আছে যাদের আমি গত দশ পনের বছর ধরে অনুসরন করে আসছি নানান পত্রিকার মাধ্যমে। সেই অদেখা মানুষগুলো। প্রথম আলোর বিমুগ্ধ পাঠক ছিলাম অনেকদিন। তারপর আরো অনেক পত্রিকা এলো বাজারে। সমকাল ছাড়া অন্যগুলো তেমন টানতে পারেনি।
এক সময় আবিস্কার করলাম সবগুলো পত্রিকা কোন না কোন ব্যবসায়ীক গোষ্টীর প্রতিনিধিত্ব করছে। স্বাধীন সাংবাদিকতা প্রায় উঠে গেছে। আবারও আশাভঙ্গ। এবার পত্রিকার ভাঙ্গন নয়, কিন্তু পত্রিকার ব্যাবসায়িক মনোবৃত্তি, বিশেষ গোষ্টীপ্রীতি, স্বার্থকলুষ সম্পাদকীয় নীতির কারনেই হতাশা হলাম। সাদাচোখে যতটুকু ধরা পড়ে আর কি। আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম পত্রিকার প্রতি। আর কোন পত্রিকা টানতে পারে না আমাকে। পত্রিকা পড়ার নিয়মিত অভ্যেস চলে যাওয়া শুরু করেছে। দৈনিক তিনটা পত্রিকা রাখা হলেও একটাও ভাল করে পড়া হয় না। শুধু অভ্যেসবশতঃ রাখা।
পত্রিকার জগত থেকে দুরে সরে এসে ইন্টারনেটে যুক্ত হয়ে পড়ি। স্বাধীনভাবে পড়াশোনা করি। পত্রিকাপাঠক আমি হয়ে যায় ইন্টারনেট পাঠক। দৈনিক অন্ততঃ আটঘন্টা ইন্টারনেটে থাকা হয়। পত্রিকার চেয়ে অনেক বেশী পড়া হয় ব্লগ। পত্রিকার স্থান অনেকাংশে দখল করে নেয় ব্লগ। মাঝে মাঝে এখানেও ভাঙ্গন দেখি। কিন্তু এই ভাঙ্গন থেকে চোখ সরিয়ে রাখার সহজ উপায়ও আছে। অন্তর্জালে আছে শত কোটি বিকল্প তথ্যভান্ডার। এক জায়গা ভালো না লাগলে অন্য জায়গায় চলে যাই। একেকটি ওয়েবসাইট একেকটা জগত। ডুব দিয়ে পুরো দিন হারিয়ে যেতে পারি ওই জগতে। এই স্বাধীনতা আমি উপভোগ করি। এই স্বাধীনতা আমার অধিকার।
No comments:
Post a Comment