বিবাহিত মানুষদের রোমান্টিকতা নিয়ে লেখা বিপদজনক। রবীন্দ্রনাথের মতো সাহসী পুরুষ বাংলাদেশে কজনকে পাওয়া যাবে? ৮০ বছর বয়সে লেখা কবিতা পড়ে বোঝার উপায় নেই এটি কোন বয়সে লেখা। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতাগুলোর স্থান ও সময় লিখে রাখতেন। নইলে বয়স বোঝা মুশকিল হয়ে যেতো। আমি বহুদিন কবিতা পড়ি না। আবৃত্তি করিনা আরো অনেক বছর।
কম বয়সে দুজন কবি সবচেয়ে বেশী নাড়া দিত। জীবননান্দ ও রবীন্দ্রনাথ। বেশীরভাগ বাঙালীর কাছে এই দুজনের জনপ্রিয়তা পর্বতসম। যদিও জীবনান্দের চেয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা বেশী পড়া, তবু জীবনানন্দের নামটা আগে আসার কারন তাঁর কবিতার প্রাত্যাহিকতা। প্রতিদিন যেমন সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে, তেমনি জীবনানন্দের কবিতাও ছিল প্রতিদিন। জীবননান্দের কবিতা হাটে মাঠে যেভাবে জোরে আওড়েছি, রবিঠাকুরেরটা তেমন হয়নি শুধু অন্তরেই মাধুরী সঞ্চার করেছে।
আবার কারো কারো কবিতার একটি লাইনের কারনে জীবনের পুরো দর্শন বদলে যেতে পারে। সুধীনদত্ত যখন হাঁক দিয়ে বলেন "সে ভুলে ভুলুক কোটি মন্বন্তরে আমি ভুলিবনা, আমি কভু ভুলিবনা"। ভালবাসা তখন স্তব্ধ পুকুর বুকের ভেতর। তাকে না পেলেও আমার ভালবাসা নিস্ফল হয়ে যায় না।
ছেলেবেলা থেকে রোমান্টিক আবহাওয়ার পরশে থেকে স্বপ্ন ছিল প্রেম করে বিয়ে করবো। বাংলা সিনেমার প্রেমকাহিনীগুলো সেই বিশ্বাসকে আরো দৃঢ় করে তোলে। প্রেম ছাড়া জীবনই বৃথা। হেথায় হোথায় প্রেমের অনেক বাগান দেখি, আমার গোলাপ কই? কেউ তো আমার প্রেমে পড়ে না। আমি অনেকের প্রেমে পড়লেও প্রেম তাই আমার উপর এসে পড়েনি। বহুবছর পর প্রেম নিয়ে মনের মতো একটা গান শুনেছিলাম 'ব্যাচেলর' ছবিতে। "আমি তো প্রেমে পড়িনি, প্রেম আমার উপরে পড়েছে।" ভাগ্য কাহাকে বলে। প্রথম শুনে মনে হয়েছিল আমার প্রেম ভাগ্যকে হিংসে করে লেখা।
৩৩ বছর কেটে গেল কেউ কথা রাখেনি। যে রাখতে পারতো সেও রাখে নি। কেন রাখেনি সে জানে। ২৮ বছর বয়সে পাড়ি জমালো অন্য ঘরে। আমার কেউ রইলো না। এক দিকে ভালোই হলো। প্রেমের জন্য গদ্য পদ্য লিখে সময় নষ্ট করার অবকাশ হয়নি। তারচেয়ে বিরহের কবিতা অনেক রোমান্টিক। হারানোর বেদনাও। পেয়ে গেলে এই বেদনা, এই না পাওয়া প্রেমের জন্য হাহুতাশ কোথায় থাকতো। বিরহকাতরতাই সৃজনশীলতার আতুড়ঘর।
৩৪ বছর বয়সে প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করে নিরুপায় প্রেমহীন বিয়ে করতে হলো অনাঘ্রাত এক গোলাপের সাথে। সরাসরি বিয়ে নয়। বাগদানের পরবর্তী প্রবেশন পিরিয়ড ছিল তিন মাস। ভেবেছি সেই তিনমাস অপূর্ব সুযোগ। মোবাইল ফোনের যুগে রাত কেটে ভোর হয়ে যায় সাশ্রয়ী টকটাইমের বন্যায়। রাত প্রতি দুঘন্টা হলেও কম কি। কিন্তু গোলাপফুল তাতে নিতান্ত অনাগ্রহী। সামনে পরীক্ষা তার। জীবন গড়তে ভালোবাসার চেয়েও ভালো রেজাল্টের জন্য সাধনা করা জরুরী। প্রেমচিন্তা মাঠে মারা যায় যায়। প্রেম দুরে থাক ফোনাফুনির উপরও অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি হয় গোলাপের পক্ষ থেকে। বেকার মালী ঘোড়ার ঘাস কেটেই সময় পার করে।
হঠাৎ কোন এক শারদ সন্ধ্যায় পরীক্ষার এক ফাঁকে গোলাপের হঠাৎ সাধ হয় ফোন করে কথা বলার। গোলাপের ফোন মালীকে আগ্রহী করলেও প্রতিশোধমনষ্কতায় নিতান্ত রূঢ়ভাবে লাইনটা কেটে দেয়া হয়। একবার দুইবার তিনবার। এবার গোলাপের নাভিশ্বাস ওঠে। দুশ্চিন্তায় পরীক্ষা লাটে ওঠে। কথা বলতেই হবে। কী কথা? কিছু না। শুধু কথা। গোলাপের আবদার একটি মাত্র ঘন্টার।
নিরস গোলাপের এহেন আবদারে মালী দারুন অবাক। প্রেমহীন বাগানে ফুটলো কি অজানা ফুল? তিন পায়ে দৌড় দিয়ে হাজির হলো গোলাপের আবাসে। প্রথম একা থাকা সেই নিষিদ্ধ একটা ঘন্টা ঘটিয়ে দিল একটা ব্যাপার। জীবনে কোন বিপরীত মানুষের হাতে হাত রাখা হলো। নিরস হবু দম্পতির রোমান্টিকতার প্রথম পর্বের ফুল। সুযোগের অপেক্ষায় প্রেমহীন কেটেছিল যে দুটি মানবজীবনের। তবে প্রায় রেডিমেড প্রেমে না ছিল হারানোর ভয়, না ছিল ধরা পড়ার আতংক। সহজলভ্যতায় কী রোমান্টিকতা পরিপূর্নতা পায়? পায় না।
তবু একসময় ঘর হয়। ঘরোয়া আধো আধো রোমাঞ্চে দিন কাটে। ভালোবাসার খোঁজে অন্য কোথাও যাওয়া হয় না ঠিকই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ প্রেরনা হয়ে যায় সময় সময়। কারো সাথে একটু দুরের দৃষ্টি বিনিময় নিষিদ্ধ অনুভুতির জোয়ার জাগায়। প্রিয় এক তরুন সহব্লগার বলে - পরকীয়া। দুঃসাহসী ব্যাপার। আমার এখন সেসব মানায়? দুচ্ছাই! তারপর?
অনেক বছর পরে আমি খোঁজ পেয়েছি নতুন প্রেমের। নতুন প্রেমের পরশ নিতে প্রতিটি দিন অফিস করে বাসায় ফিরি। ভালোবাসার ঢালি নিয়ে অপেক্ষাতে কান পেতে রয় কলিং বেলের। এতদিনে পুর্ন হলো বহুযুগের অনাহারী একটি জীবন। কন্যা আমার তিন বছরের। দরজা খুলেই বুকের ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সদা সবাক মেয়ে আমার কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রয় ছোট্ট দুহাত গলার মালা। এত আদর এতযে প্রেম তিনশো বছর ভালোবেসে শেষ হবে না অশেষ এ টান। প্রতীক্ষাটা শেষ হলো আজ চার দশকের অবসানে। প্রেমে প্রেমে কানায় কানায় পূর্ন হলো আমার জীবন।
আমি তো প্রেমে পড়িনি, প্রেম আমার উপরে পড়েছে! নাকি?
No comments:
Post a Comment