Sunday, July 2, 2023
ক্যারিয়ার শুরুর একটি ছোট গল্প
এটি আমার ক্যারিয়ার সম্পর্কিত একটি গল্প। আরো বাইশ বছর আগের কথা। তখন আমার প্রথম চাকরীর বয়স মাত্র ৬ বছর। কিন্তু সেই অল্প সময়ে আমি অভাবিতভাবে কয়েকটি পদোন্নতি পেয়ে বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্কিত একটি বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আমাদের হেড অফিস ছিল দক্ষিণ কোরিয়া। মাঝে মাঝে সেখানে যেতে হতো মিটিং কনফারেন্সে।
একবার হেড অফিস থেকে চেয়ারম্যান ডেকে পাঠালেন। যাওয়ার পর তিনি এক সুদর্শন তরুণের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার পুত্র ব্রায়ান। আমেরিকা থেকে আইন পাশ করে এসেছে। সে ব্যবসাপাতিতে আগ্রহী নয়। তার ইচ্ছা ল প্র্যাকটিস করবে। কিন্তু আমার ইচ্ছা সে ব্যবসাটা একটু শিখবে। তুমি তাকে গাইড করবা।’
শুনে আমি প্রথমে খানিক বিব্রতবোধ করেছি সত্যি। আমার দেশের অভিজ্ঞতায় বড়লোকের ছেলেদের মতিগতি ভালো হয় না বলে জানি।
কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে ব্রায়ানের সাথে আমার চমৎকার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। এত বিশাল কোম্পানির উত্তরাধিকারী সে, তবু বিন্দুমাত্র অহংবোধ নেই। আমাকে ওস্তাদের মতোই মান্য করে। এতটা বিনয় আমি কল্পনাও করিনি।
কয়েকদিন পর বললাম, বাংলাদেশে আসো। তোমাকে হাতে কলমে শেখাবো আরো। কোম্পানির আরো কয়েকটি দেশে ব্যবসা ছিল। সে বলতো বাংলাদেশকেই তার বেশি ভাল লাগে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম। কয়েক মাস পর সে চট্টগ্রামে এলো। প্রথমদিন তার সাথে গল্পগুজব খাওয়াদাওয়া হলো। বললো, আমার সাথে কাজ শুরু করবে পরদিন থেকে।
কিন্তু পরদিন থেকে তাকে আর অফিসে আসতে দেখি না। আমি ভাবলাম বড়লোকের খেয়ালী পুত্র। হয়তো খুলশীর বাসায় আরাম করছে নয়তো কোথাও আমোদ প্রমোদে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
দুদিন পর তার সাথে দেখা হলো লাঞ্চের সময়। ঘর্মাক্ত শরীরে কাছে এসে একগাল হাসি দিল।
বললাম, 'একি দশা তোমার ব্রায়ান? কোথায় ছিলে?'
সে যা বললো তা শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম। তার বাবা বলেছে, অফিসের কাজ শেখার আগে নীচের ফ্লোরে নেমে শ্রমিকেরা কিভাবে কাজ করছে সেটা দেখতে হবে। সেখানে শ্রমিকরা যে পরিস্থিতিতে কাজ করছে তাদের সাথে থাকতে হবে। শুধু পর্যবেক্ষক হিসেবে না- সত্যিকার একজন প্যাকিংম্যান হিসেবে একতলার প্যাকিং এণ্ড শিপমেন্ট ফ্লোরে তাকে তিন মাস কাজ করতে বলা হয়েছে। ওখানকার কষ্টকর অবস্থা পার হয়ে তারপর অফিসে বসার সুযোগ পাবে। তার আগে নয়।
বেচারার দুর্দশার কথা শুনে আমার মায়া লেগেছিল। আমেরিকার ডিগ্রী নিয়েও বাপের কয়েকশো মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এসে অশান্তিতে পড়ে গেছে। কিন্তু কিছু করার নাই। তার বাপ ঘাড়ত্যাড়া। এক কথার লোক।
তবে সে এক মাসের মধ্যেই এত ভাল কাজ শিখে ফেলেছে যে তাকে দুমাস মওকুফ করে অফিসে প্রমোশন দেয়া হলো। কিন্তু অফিসে পদোন্নতি পেলেও ম্যানেজার বা কোন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়নি। সাধারণ অফিসার হিসেবে আমার কাছে বৈদেশিক বাণিজ্য, ব্যাংকিং, শিপিং ইত্যাদির দীক্ষা নেয় চুপচাপ পাশে বসে। কয়েক মাস পর হেড অফিসে বদলি করা হলে অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিল।
আমি ওই কোম্পানি ছেড়ে এসেছি আট বছর আগে। তখন পর্যন্ত ব্রায়ানকে শীর্ষস্থানীয় কোন পদ বা ডিরেক্টরশীপ দেয়া হয়নি। কোম্পানির সকল উঁচু পদে ছিল আমাদের মতো বাইরের লোকেরাই।
এই বিষয়ে তার কোন আক্ষেপ আছে কিনা আমি জানতে চেয়েছিলাম। জবাবটা খুব পছন্দ হয়েছিল।
সে যা বলেছিল তার সারমর্ম ছিল: উত্তরাধিকার সূত্রে কোম্পানির শীর্ষপদে বসে যাওয়া সম্মানজনক ব্যাপার নয়। বাবার মতো সেও পৃথিবীকে নিজের যোগ্যতায় জয় করতে চায়।
আজকের পত্রিকায় দেখলাম অনুর্ধ ত্রিশ এক পুত্র তার পিতার কল্যানে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় একটা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়ে গেছেন।
বুঝলাম, বাঙালীরা জগতের অন্য সকল জাতির তুলনায় কয়েক আলোকবর্ষ এগিয়ে।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment