Sunday, July 2, 2023

দেশের খনিজ সম্পদের অর্থমূল্য ২.২৬ ট্রিলিয়ন ডলার

 




প্রথমে চোখের মাথা খেয়ে সংবাদ শিরোনামটা দেখে ভেবেছি বাংলাদেশ রাতারাতি ইংল্যান্ডের মতো বড়লোক হয়ে গেছে। কারণ শিরোনামের সংখ্যাটা ২.২৬ ট্রিলিয়ন ডলার! বাংলাদেশের মাটির তলায় পড়ে থাকা খনিজ সম্পদের মূল্য। এই অংক ইংল্যাণ্ডের জিডিপির সমান।
তাও এই হিসাবে আমাদের গ্যাস সম্পদের মূল্য যোগ করা হয়নি। গ্যাসের মূল্য যুক্ত হলে সম্পদের আকার আরো কয়েক ট্রিলিয়ন বাড়বে। চারপাশের এত দুঃসংবাদের ভেতর একটা বিশাল সুসংবাদ।
কিন্তু সংবাদের পরের অংশটা পড়ে আনন্দটা বিষাদে পরিণত হলো। বলা হয়েছে ওই খনিজগুলো উত্তোলন ও ব্যবহার করার ব্যাপারে উৎসাহ নেই কর্তাদের। বরং অনেক বেশি টাকা দিয়ে পরের সম্পদ আমদানী করতে বেশি আগ্রহী। বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুসারে রিপোর্টে বলা হয়েছে ওই খনিজ উত্তোলনের জন্য বিনিয়োগ খুব বেশি নয়। সেই সামর্থ্য আমাদের আছে। তবু কর্তারা এটায় আগ্রহ পাচ্ছেন না। কেন আগ্রহ পাচ্ছেন না এটা তারাই জানেন, আমরা শুধু অনুমান করতে পারি।
আসলে এরকম ঘটনা আমাদের জন্য নতুন কিছু না। বাংলাদেশে এটা সবসময় হয়ে এসেছে।
২০০১ সালের একটা ঘটনা মনে পড়লো। তখন কক্সবাজার সৈকতের খনিজ সম্পদ নিয়ে এরকম একটা রিপোর্ট পড়েছিলাম 'সাপ্তাহিক ২০০০' ম্যাগাজিনে। রিপোর্টার ছিলেন সম্ভবত আসাদুজ্জামান। তিনি একটা বিস্তারিত তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট করেছিলেন। ওটা নিয়ে প্রচ্ছদকাহিনী হয়েছিল। রিপোর্টটা হয়েছিল কক্সবাজারের সৈকতে থাকা কিছু মূল্যবান খনিজ সম্পদের মজুদ নিয়ে যার মূল্য দিয়ে পুরো বাংলাদেশ কয়েকবার কিনে ফেলা যাবে। এখন যেখানে কলাতলী হোটেল মোটেল জোন ওই পুরো এলাকাটা ছিল সেই সৈকতের বালি ওই খনিজে ভরপুর। ওই খনিজের কারণে সেই এলাকায় কোন হোটেল করা যাবে না এই মর্মে আইনও হয়েছিল। শুরুতে স্থানীয় প্রযুক্তি দিয়ে বালি থেকে সেই খনিজ পরিশোধনের বেশ তোড়জোর করা হয়েছিল। মোটেল উপলের পাশে একটা ছোটখাট গবেষণাগারও খোলা হয়েছিল। কক্সবাজারের লোকেরা তামাশা করে বলতো বালির অফিস। কারণ গবেষণাগারের বিশাল চত্ত্বরে বড় বড় বেশ কিছু বালির স্তুপ ছিল।
সেই বালিতে প্রাপ্ত খনিজগুলোর মধ্যে বড় অংশ ছিল টাইটানিয়াম, জিরকনিয়াম, বেরিলিয়াম ইত্যাদি। এ বিষয়ে অভিজ্ঞজনের জানেন সারা বিশ্বে এই খনিজগুলো সোনার চেয়েও দামী। আকাশযান এবং মহাকাশযানের ইঞ্জিন এবং গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ তৈরিতে এই পদার্থগুলো ব্যবহার হয়। এগুলো ইস্পাতের চেয়ে বহুগুন শক্ত, উচ্চতাপ সহনশীল কিন্তু বেশ হালকা। দুর্লভ পদার্থ হওয়াতে চাহিদা অনেক বেশি।
কিছুদিন পর হঠাৎ শোনা গেল কক্সবাজারের সৈকতের সেই অংশটা লিজ দেয়া হচ্ছে বিদেশী একটা কোম্পানিকে। ওরা আমাদের সামান্য কিছু পয়সা দিয়ে খনিজগুলো উত্তোলন করে নিজেদের দেশে নিয়ে যাবে। সেখানে পরিশোধন করে বহুগুন বেশি দাম দিয়ে বিক্রি করবে। বুদ্ধিটা কার মাথা থেকে এসেছিল জানি না। কিন্তু দেশ বিক্রি করে দেয়া হয় এভাবেই। অথচ চেষ্টা করলে আমরা নিজেরাই একটা প্রকল্প তৈরি করে সেখানে বিদেশী বিশেষজ্ঞ আনিয়ে বিদেশী মেশিনপত্র বসিয়ে পরিশোধন করে খনিজগুলো আমরা নিজেরাই উচ্চমূল্যে রপ্তানী করতে পারি। বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা সেরকমই মতামত দিয়েছিলেন।
কথাটা শোনার পর আমরা কয়েকজন মিলে এই লিজিং তৎপরতা বন্ধ করার জন্য একটা মিডিয়া প্রচারণার উদ্যোগ নেই। আমি কক্সবাজার গিয়ে কলাতলীর সেই গবেষণাগারের অফিসারদের সাথে কথা বলে ঘটনার সত্যতা যাচাই করি। তারপর আমরা ঢাকায় একটা গোলটেবিলের আয়োজন করার জন্য সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকার সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরীর সাথে আলাপ করি। তাঁর পত্রিকাতেই সেই রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল। তিনি সানন্দে রাজী হলেন। সেই গোলটেবিল আয়োজনে সরকারের খনিজসম্পদ মন্ত্রীসহ বেশ কজন বিশেষজ্ঞকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল যাদের অধিকাংশ ছিলেন বুয়েটের। তাঁদের সাথে অন্যতম বক্তা ছিলেন কক্সবাজারের সেই প্রকল্প প্রধান। ভদ্রলোক বলেছিলেন ওই খনিজটা ৯৫% পরিশোধন করার মতো প্রযুক্তি তাঁর কাছে আছে। সেই আসরে উপস্থিত সবাই একমত হয়েছিলেন যে লিজটা যে কোন উপায়ে বাতিল করা উচিত। তারপর নিজেদের উদ্যোগে একটা প্রকল্প নেয়া হবে। খনিজসম্পদ মন্ত্রীও তাতে সায় দিয়েছিলেন। শুনেছিলাম তিনি প্রধানমন্ত্রীকেও জানিয়েছিলেন।
অতঃপর আমরা আনন্দের সাথে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। বিদেশী কোম্পানীকে লিজ দেয়ার প্রস্তাবটা বাতিল হয়েছিল। আমরা অল্প চেষ্টাতে এত বড় বিজয়ে ঢাকার একটা রেস্তোঁরায় পানাহারও করেছিলাম।
কিন্তু বছরখানেক পর দেখা গেল ওই জায়গাটা বিভিন্ন প্লটে বিভক্ত করে সীমানা দেয়াল তোলা হচ্ছে। আরো কিছুদিন পর দেখা গেল ওখানে বিক্ষিপ্তভাবে একটা দুটো হোটেলের ভিত্তিপ্রস্তর উঠছে। প্রথমে কলাতলী রোডের দিকে উঠেছিল সেই হোটেলগুলো। কয়েক বছর পর দেখা গেল সৈকতের সবটুকু এলাকা হোটেলে ছেয়ে গেছে। জায়গাটা কোন অদৃশ্য যাদুর ছোঁয়ায় হোটেল মোটেল জোনের পরিবর্ধিত এলাকায় পরিণত হয়েছে। অথচ সুগন্ধা পয়েন্টের দক্ষিণের পুরো এলাকায় কোন হোটেল হবার কথা ছিল না।
বড় বড় হোটেল গড়ে ওঠার পর খনিজ বালি প্রকল্প পরিত্যক্ত ঘোষিত হলো। সরকারও বদলে গেল। তারপর ধীরে ধীরে কক্সবাজারের মানুষ বালির অফিসের কথাও ভুলে গেল। ওই হোটেল-মোটেল জোন হবার আগে আমি সৈকত থেকে সেই কালো বালির খনিজের নমুনা তুলে এনে বোতলে ভরে বাসায় সাজিয়ে রেখেছিলাম। বেশ কিছুদিন ওই বালির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম।
অবশ্য কর্তাদের দোষ দেবার উপায় নেই। তাঁরা তো কথা রেখেছিলেন ঠিকই। বিদেশিদের না দিয়ে দেশের সম্পদ দেশে রেখে দিয়েছিলেন। একদম স্থায়ীভাবে কবরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এখন কেউ কলাতলী এলাকায় গেলে টেরই পাবে না ওই এলাকায় কী বিপুল সম্পদ মাটির তলায় হারিয়ে গেছে।


পুরো সংবাদ:
https://bonikbarta.net/home/news_description/345607/%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87-%E0%A6%96%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%9C-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%AE%E0%A7%82%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A7%A8.%E0%A7%A8%E0%A7%AC-%E0%A6%9F%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%A8-%E0%A6%A1%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B0-

No comments: