Sunday, July 2, 2023
ভিয়েতনাম ভ্রমণ: ২০০৪ সংস্করণ
অ্যানালগ যুগের এই ছবিটা হঠাৎ করে খুঁজে পেলাম। বহুকাল আগের এই ছবিটা আমার খুব প্রিয়। জায়গাটা ভিয়েতনামের Halong Bay, পেছনে তার বিখ্যাত ল্যাণ্ডমার্ক টুইন স্টোন। ২০০৪ সালে একটা অফিশিয়াল ট্যুরে গিয়ে হালং বে এলাকায় নৌবিহার করেছিলাম, তখনকার ছবি। এতদিন পর ছবিটা খুঁজে পেয়ে সেই ভ্রমণে ঢাকা এয়ারপোর্টের একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে গেল।
সেই ট্যুরে আমরা ১৯ জনের একটা দল যাচ্ছিলাম। নামে অফিশিয়াল ট্যুর হলেও এটা ছিল মূলত একটা আন্তর্জাতিক পিকনিক। হ্যানয়ের উপকন্ঠে আমাদের একটা বড়সড় কারখানা নির্মিত হয়েছিল। সেটা পরিদর্শনের উসিলায় ভিয়েতনামের বিখ্যাত কিছু পর্যটনস্থল ঘুরে আসাই মূল উদ্দেশ্য।
ঢাকা থেকে বেলা দুটোর সময় থাই এয়ারওয়েজের ফ্লাইট। সবাই ঘন্টা তিনেক আগে এয়ারপোর্টে গিয়ে হাজির হলাম। যেহেতু আনন্দ ভ্রমণ, সবাই টেনশান ফ্রী। পিকনিক মুডে সবাই থাই এয়ারলাইন্সের কাউন্টারে মালামাল বুঝিয়ে দিয়ে ভেতরে গিয়ে ইমিগ্রেশনে লাইনে দাঁড়িয়েছে।
আমি কী একটা কাজে একটু পিছিয়ে পড়েছিলাম। আধঘন্টা পর ভেতরে গিয়ে দেখি ইমিগ্রেশন লাইনের পাশে ছোটখাট একটা ভিড় জমে গেছে, একটা উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কাছে গিয়ে দেখি আমাদের লোকদের সাথে ইমিগ্রেশন অফিসার এবং অন্যন্য সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে একটা তর্কবিতর্ক চলছে। কাউকে ইমিগ্রেশন পার হতে দেয়া হয়নি।
অফিসারদের আপত্তি এতগুলো লোক একসাথে ভিয়েতনাম কেন যাবে? ওটা তো ট্যুরিস্ট কান্ট্রি না। বেড়ানোর নামে অন্য কোন মতলবে যাচ্ছে কিনা। ইমিগ্রেশন অফিসারদের শতবার বোঝানোর পরও বিশ্বাস করছে না আমরা কোন বদ মতলবে যাচ্ছি না। নেহায়েত প্রমোদ ভ্রমণ। আমাদের এ ধরণের ট্যুরগুলোর নাম ছিল ‘বিজনেস ট্রিপ’ এবং নানান দেশে বছরে কয়েকটা সত্যিকারের বিজনেস ট্রিপ হতো। এবারের ট্রিপটাই ছিল একটু ব্যতিক্রম।
তখন ভিয়েতনামে যেতে ভিসা লাগতো না। অন এরাইভাল ভিসাতে যাওয়া যেতো।
ইমিগ্রেশন অফিসারদের দৃঢ় বিশ্বাস এটা আদম পাচার কেস। এই সন্দেহের কারণ দলের প্রায় সবাই কম বয়সী তরুণ। দুয়েক জন বাদে বাকী সবার নতুন পাসপোর্ট। নতুন পাসপোর্টে প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। সুতরাং এটা আদম পাচার না হয়ে যায় না। আমাদের দলের মধ্যে যিনি সবচেয়ে সিনিয়র তাঁকে আদমপাচারের হোতা ভেবে গ্রেফতার করে ফেলবে এমন অবস্থায় চলে গেছে।
ওদিকে ফ্লাইট কলিং শুরু হয়ে গেছে। আধ ঘন্টার মধ্যে ফ্লাইট ছেড়ে যাবে। মহামুশকিল। পুরো আনন্দ ভ্রমণটাই একটা কেলেঙ্কারিতে পরিণত হয়ে ভেস্তে যাবার যোগাড়।
শেষ চেষ্টা হিসেবে আমি একটু দুঃসাহসী হবার সিদ্ধান্ত নিলাম। দলের মধ্যে একমাত্র আমিই ওই দেশে আগে গিয়েছিলাম এবং পূর্ব এশিয়ার আরো দুয়েকটা দেশ ভ্রমণের সুবাদে আমার ইমিগ্রেশন ভীতি একটু কম ছিল। সেই সাহসের ভিত্তিতে আমি অফিসারদের বললাম, আমি আপনাদের প্রধান কর্মকর্তার সাথে কথা বলতে চাই।
কিন্তু অফিসাররা আমাকে সেটাও করতে দেবেন না। সোজা বলে দিলেন, কথা বলার কোনো দরকার নাই। আপনারা যেতে পারবেন না। আমরা এয়ারপোর্টে এসব কেস হরদম দেখে আসছি। আর কিছু করার নেই।
ঠিক সেই সময় কোথা থেকে যেন দেবদুতের মতো উদয় হলেন চিফ ইমিগ্রেশন অফিসার। তিনি কাছে এসে জানতে চাইলেন, এখানে দলনেতা কে?
এই প্রশ্ন শুনে আমরা পরস্পরের মুখ দেখাদেখি করলাম। কারণ আমরা দলনেতা জাতীয় কিছু ঠিক করে আসিনি। আমাদের সবচেয়ে সিনিয়র যে কলিগ ছিলেন, অফিসিয়াল পদবীর হিসেবে তাঁকে দলনেতা বলা যায়। মুশকিল হলো ভদ্রলোককে আদম পাচারের নেতা বলে অপদস্থ করার কারণে তিনি পুরোপুরি নার্ভাস। বাকীদের মধ্যেও এই পরিস্থিতিতে চাপাবাজি করতে পারবে সেরকম কাউকে দেখছি না। অতঃপর নিজ দায়িত্বে এগিয়ে গিয়ে বললাম, আমার সাথে কথা বলতে পারেন।
তখন সেই চিফ ভদ্রলোক আমাকে তাঁর অফিস কক্ষে ডেকে নিয়ে পুরো বিষয়টা শুনতে চাইলেন। কথা শুরুর আগে বললাম, ‘অফিসার, তার আগে আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। ওই যে ফ্লাইট কলিং হচ্ছে সেটা বন্ধ করতে হবে। নইলে আর পনের মিনিটের মধ্যে প্লেনটা আমাদের রেখেই ছেড়ে চলে যাবে। আপনি দয়া করে থাই এয়ারকে বলে দিন প্লেনটা আমাদের ইমিগ্রেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেন উড়াল না দেয়। নইলে পুরো ব্যাপারটা ভেস্তে যাবে। ’
আমার কথা শুনে তিনি একটু চোখ বড় বড় করে তাকালেন। বুঝতে পারছি আমার মতো সাধারণ কোন যাত্রীর কাছ থেকে এ ধরণের কথা শুনতে তিনি অভ্যস্ত নন। তবু আমার কথাকে উপেক্ষা না করে তিনি ফোনটা তুলে কাউকে অনুরোধ করলেন ফ্লাইটটা যেন এক ঘন্টা পিছিয়ে দেয়া হয়। ভদ্রলোক সত্যি খুব অমায়িক ছিলেন। আমি তাঁকে ফ্লাইট পেছানোর কথা বললেও তিনি যে আমার কথাটা রাখবেন সে ভরসা করিনি। এয়ারপোর্ট কেন্দ্রিক যেসব সরকারী কর্তাদের দুর্নাম শুনি, ইনি নিশ্চিতভাবে তাদের মধ্যে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
আমি অল্প সময়ে ওনাকে গোটা পরিস্থিতি বুঝিয়ে বললাম। তারপর আমার পাসপোর্ট দেখালাম। আমাদের কোম্পানির ব্যবসার ধরণ এবং বিনিয়োগ ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা দিলাম। তখন তিনি বললেন, ‘সব মেনে নিলাম। তবু আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। দলের পক্ষ থেকে গ্যারান্টি দিতে হবে আপনি ফেরার পথে পুরো দলটা নিয়ে ফিরে আসবেন। আপনার পাসপোর্টের কপি আমরা রেখে দেবো’।
আমি গ্যারান্টি দিয়ে স্বাক্ষর করলাম একটা কাগজে। তিনি আমার পাসপোর্টের কপি রেখে ইমিগ্রেশনে বলে দিলেন আমাদের দ্রুত পার করে দেবার জন্য।
অতঃপর স্বস্তি ফিরে এলো দলে। হৈ হৈ করে পিকনিক মুডে আবারো সবাই গিয়ে ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়ালো। এক ঘন্টার মধ্যে আমাদের ফ্লাইট আকাশে উড়লো। তেত্রিশ হাজার ফুট উপরে ওঠার পর পাশে বসা দলনেতা মুরব্বী বললেন, ‘কী একটা ক্ষমতা দেখাইলেন, একটা ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট এক ঘন্টা পিছায়ে দিলেন!’
ক্ষমতা আমি দেখাইনি। নেহাত কপালজোরে পার হয়েছিলাম। কিন্তু আক্ষেপের ব্যাপার হলো ফেরার পথে অফিসারকে দেয়া কথাটা পুরোপুরি রাখতে পারিনি। সবাইকে নিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলাম ঠিক। কিন্তু ঢাকা এয়ারপোর্টে নামতে পারিনি আমরা। থাই এয়ারওয়েজের ফিরতি ফ্লাইটটা কী একটা কারণে যেন রুট বদলে ব্যাংককের বদলে চিয়াংমাই-তে যাত্রাবিরতি করেছিল এবং সেখান থেকে সোজা চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টে। আমরা চট্টগ্রামেই নেমে গিয়েছিলাম। আমাদের নামিয়ে ফ্লাইটটা ঢাকা চলে গেল।
জানি না ঢাকা এয়ারপোর্টের সেই অফিসার পরবর্তীতে আমার খোঁজ করেছিলেন কিনা। খোঁজ করে না পেলে হয়তো ভাববেন আমি সত্যি সত্যি ১৮ জন আদম পাচার করে হাওয়া হয়ে গিয়েছি।
[ফটোক্রেডিট: ১৮ জনের কেউ একজন। সম্ভবত প্রিয় সহকর্মী মনজুর-এ-ইলাহী]
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment