Sunday, July 2, 2023
আমার প্রিয় ডাক্তার
গতকাল ডাক্তারের ওপর মাস্টারী পোস্ট দেবার কারণে আমার এক ঘনিষ্টজন কিঞ্চিত মনক্ষুন্ন হয়েছেন। তিনি বলেছেন, খারাপ অভিজ্ঞতাটা লিখলাম কিন্তু অধিকাংশ ডাক্তারের কাছ থেকে আমি যে ভালো ব্যবহার এবং সেবা পেয়ে আসছি সেটা নিয়ে কোনদিন লিখিনি।
তিনি সত্য কথাই বলেছেন। মানুষ, বিশেষ করে বাঙালী মাত্রেই অকৃতজ্ঞ। কেউ আমার ৫০০ টাকার ক্ষতি করলে সেটা আমাদের বুকে দাগ রেখে যায়, কিন্তু কেউ ৫০,০০০ টাকার উপকার করলে সেটা ভুলে যেতে দেরি করি না। এখানেও তাই ঘটেছে।
সত্যি কথা বলতে গেলে, দুয়েকটি ঘটনা বাদে আমার সাথে এ যাবত পরিচয় হওয়া প্রায় সব ডাক্তারই খুব চমৎকার। আমার বাবার যুগে আমাদের একজন পারিবারিক ডাক্তার ছিলেন। তিনি সাধারণ এমবিবিএস ছিলেন, কিন্তু তাঁর মতো অসাধারণ ডাক্তার আমি খুব কমই দেখেছি। একটা ওষুধের দোকানের পেছনে ছোট একটা কক্ষে তাঁর গোছানো চেম্বারটি ছিল। তাঁর সাথে পরিচয় ঘটেছিল এক মধ্যরাতে যখন পরিবারের একজন সদস্য অসুস্থ হয়ে পড়ে। কোথাও ডাক্তার না পেয়ে দিশেহারা হয়ে এলাকার এক ওষুধের দোকানে খোঁজ করতে তারা এলাকায় নতুন আসা এক ডাক্তারের বাসার ঠিকানা দিলেন।
আমরা একেবারে অচেনা হলেও তিনি সেই মধ্যরাতে ঘুম থেকে উঠে ব্যাগ নিয়ে আমাদের বাসায় এসে চিকিৎসা দিয়েছিলেন। সেই থেকে তিনি ধীরে ধীরে আমাদের পরিবারের ছোটবড় সবার ডাক্তার হয়ে ওঠেন। শুধু ডাক্তার নন, তিনি আমাদের পরিবারের একজন সদস্যের মতো আপন হয়ে ওঠেন। তিনি অতি মানবিক ডাক্তার ছিলেন। আমার এখনো মনে পড়ে তিনি ১০০ টাকা ভিজিট নেবার পর সেখান থেকে ৫০ টাকা আলাদা করে রাখতেন। সে টাকা তিনি গরীব মানুষদের সাহায্যে ব্যয় করতেন। তিনি এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন যে আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড়ে বিসিক মার্কেটের চেম্বারে রোগীর ভিড় দেখার মতো ছিল। বয়স হবার পর তিনি অবসরে গিয়ে শুধু জনসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন। সেই সময় আমরাও আগ্রাবাদ ছেড়ে নতুন এলাকায় চলে আসি।
নতুন এলাকায় আসার পর পাঁচলাইশ এলাকায় আরেকজন মানবিক ডাক্তারের সন্ধান পেয়ে যাই। তিনি একজন অধ্যাপক শ্রেনীর বিলেতের ডিগ্রীধারী ডাক্তার। নিরিবিলি আবাসিক এলাকায় নিজের বাড়ির একতলায় তিনি রোগী দেখতেন। প্রথমবার গিয়েই ডাক্তারের ব্যবহারে খুব মুগ্ধ হয়ে গেলাম। দেখলাম এই ডাক্তারের রোগীর ভিড় বেশি নেই। যেখানে ভিড় বেশি, আমি সে ডাক্তার এড়িয়ে চলি। তিনি সময় নিয়ে, মন দিয়ে রোগীর সাথে আলাপ করেন। ধীরে ধীরে ওই ডাক্তারের সাথেও সুসম্পর্ক হয়ে গেল। তিনিও আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক হয়ে ওঠেন। যে কোন সমস্যার জন্য প্রথমে তাঁর কাছে গিয়ে প্রাথমিক পরামর্শ নেই কোন পথে গেলে ভাল হবে। তিনি সবসময় সৎ পরামর্শ দিয়ে এসেছেন।
একসময় তিনি পেশাগত প্রয়োজনে ঢাকায় চলে গেলে আমাকে আরেকজন চিকিৎসা পরামর্শকের খোঁজ করতে হয়। ভাগ্যক্রমে সেটাও পেয়ে যাই। তেমন পরিচিত বা বিখ্যাত নন কিন্তু যত্ন করে রোগীর কথা শোনেন, রোগীকে কথা বলতে দেন। অনেক ডাক্তার রোগীকে ঠিকমত কথা বলতে দেন না, কথা বলার আগেই টেস্ট লিখতে শুরু করেন, এই ডাক্তার সেরকম নন। ফলে অল্পদিনে তিনি আমাদের পরিবারের ডাক্তার হয়ে ওঠেন। সময়ের হিসেব করতে গেলে গত চল্লিশ বছরে আমাদের পরিবার বিশেষ প্রয়োজন বাদে অধিকাংশ সময় মাত্র তিনজন ডাক্তারের ছায়ায় কাটিয়েছে।
সেই পারিবারিক ডাক্তারগুলোর বাইরেও আমার বেশ কয়েকজন শুভাকাঙ্খী ডাক্তার আছেন যাদেরকে আমি সময় অসময়ে বিরক্ত করি, পরামর্শ নেই যে কোন বিপদে পড়ে। করোনার সময় সেই ডাক্তারগুলো আমার পরিবারকে টেলিফোনে যত্ন করে এমন পরামর্শ দিয়েছেন আমাকে অনেক বড় বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছে। বিপদের বন্ধু নামে ডাকি আমি তাঁদের। এখনো তাঁরা প্রতিনিয়ত আমাকে যে কোন বিপদে ভরসা এবং পরামর্শ দুটোই দিয়ে যাচ্ছেন।
তাঁরা আমার ফেসবুকে আছেন তাই আমি আলাদা করে কারো নাম বলে বিব্রত করতে চাই না। সেইসব ডাক্তারের ঋণ শোধ করার ক্ষমতা আমার নেই, যাদেরকে কোনদিন এক টাকার ভিজিটও দেইনি। এক কাপ চা খাওয়ানোরও সুযোগ হয়নি। শুধু বাতিঘর সংলগ্ন এলাকায় আড্ডা দিয়েছি দুয়েকবার। তাদের প্রতি প্রকাশ্যে কোনদিন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিনি। আজ এই পোস্টের মাধ্যমে করলাম।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment