অনেক বছর পর হঠাৎ করেই আজ সুরাইয়া খানম সামনে এসে দাঁড়ালেন আবার। শেষবার দাঁড়িয়েছিলেন তিনি প্রয়াত হবার দুবছর পর ২০০৮ সালে। যখন তাঁকে প্রথম জেনেছিলাম সচলায়তনের লেখক মুহম্মদ জুবায়ের ভাইয়ের এক লেখায়। সুরাইয়া খানম জুবায়ের ভাইয়ের পরিচিত ছিলেন তাঁর বড় বোনের সূত্রে। জুবায়ের ভাইও চলে গেছেন এক যুগের বেশি সময় আগে। কিন্তু সেই পরিচয় পর্বটা রয়ে গেছে তাঁর লেখায়। সে কথায় যাবার আগে আজ কিভাবে সুরাইয়া খানম সামনে এসে গেলেন সে কথা বলে নিচ্ছি।
আজ সকালে পহেলা বৈশাখ ১৪৩০ ছুটির অবকাশে বাসায় বসে পাঁচ দশকের পুরোনো পত্রিকার আর্কাইভ দেখছিলাম। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের দৈনিক বাংলা, ইত্তেফাক, অবজার্ভার, বাংলাদেশ টাইমস ইত্যাদি পত্রিকা আলগোছে উল্টে পাল্টে তখনকার পহেলা বৈশাখ উদযাপনের খবরগুলো পড়ছিলাম। হঠাৎ করেই চোখ গেল ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায়। সেখানে সুরাইয়া খানমের একটি কবিতা। তারিখটা ১৪ এপ্রিল ১৯৭৬। কবিতাটা পড়ে জুবায়ের ভাইয়ের সেই লেখাটির কথা মনে পড়ে গেল। পনেরো বছর আগে সুরাইয়া খানম সম্পর্কে তিনি একটা ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করেছিলেন।
আমি জানতাম সুরাইয়া খানমের একটিমাত্র কবিতার বই। নাচের শব্দ। সেও প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালেই। এই কবিতা প্রকাশের দুমাস পর। নাচের শব্দে কবিতাটি থাকার কথা। বুকশেলফ থেকে ‘নাচের শব্দ’ খুঁজে নিয়ে দেখলাম ইত্তেফাকে ছাপা সেই কবিতাটি ওখানে নেই। সুরাইয়া খানমের অপ্রকাশিত কবিতা নিয়ে একটা সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। দেখলাম সেখানেও নেই। যারা সেই সংকলনটি প্রকাশ করেছিলেন কবিতাটি হয়তো তাঁদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল।
নীলপদ্ম মুখ তুলে থাকে
সুরাইয়া খানম
আমাদেরও ডাকঘর ছিলো, দরজায় বাঁধা থাকতো
রাশি রাশি পাগলা ঘোড়া
বস্তা বস্তা চিঠি নিয়ে ছুটে আসতো অন্ধ পিয়নেরা-
আমাদেরও অলৌকিক লোক মাধুরী এসে
নাচের শব্দে ঢেলে দিতো ঘড়াজল
দুয়ারের বাসি কড়া নেড়ে
আমাদেরও পুষ্প নিকেতনে সম্ভ্রান্ত রেশমকীট
ঘুরে ঘুরে জটলা পাকাতো-
দূরে কাছে পৌষমাস ক্রমাগত সর্বনাশ হয়ে উঠলো
চাবুকের মত তীব্র অসুখের ছোবলে ছোবলে
রক্তের প্রদীপ জ্বেলে ছুটে ছুটে চলে যায় সীমান্তের দিকে
বিষধর মোহনায় জল ডাকাতের মত দুলে গেলো
একবার উড়ুক্কু মাছেরা
ঘাই দিয়ে শুশুক কোম্পানী এসে সারেঙ্গী বাজায়
অথচ ফেরে না আজও অন্ধ পিয়নেরা- নীল পদ্ম মুখ তুলে থাকে
ওরা সব বসে থাকে বটতলার মৌচাকের ঝাঁকে
রোলড্ গোলডে্ চোখ ঢেকে পিতলের প্রবল জলসায়-
ডাকঘর / অঙ্ক পিয়ন/ পাগলা ঘোড়া
ওরা সব সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে আগুনের বৃক্ষের নিকটে
নীল পদ্ম মুখ তুলে থাকে-
…………………………………………………………………….
[দৈনিক ইত্তেফাক, পহেলা বৈশাখ, ১৪ এপ্রিল ১৯৭৬]
সুরাইয়া খানমের নিজের সৃষ্ট কবিতার সংখ্যা তেমন বেশি না হলেও আবুল হাসানের কারণে তিনি খুব পরিচিত ছিলেন সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে। আবুল হাসানের জীবনের ওপর লেখা কবি মোশতাক আহমেদের ডকু ফিকশন ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ প্রকাশের পর সে পরিচয় আরো বিস্তৃত হয়েছে। তাঁদের পরিবারের তিন বোনই বিখ্যাত ছিলেন। ভয়েস অব আমেরিকার দিলারা হাশেম, রক্তকরবীর নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করে খ্যাত দিলশাদ খানম এবং সুরাইয়া খানম -প্রত্যেকে ষাট দশকের এক একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র।
সুরাইয়া খানমের সাথে কবি আবুল হাসানের বন্ধুতার কথা সত্তর দশকে ঢাকা শহরে আলোচিত বিষয় ছিল। সেই সম্পর্কটা নিয়ে নানান রটনা ছিল। আহমদ ছফা সেইসব নিয়ে উপন্যাস পর্যন্ত লিখে ফেলেছিলেন। কিন্তু সুরাইয়া খানমের ওপর লেখা আমার প্রথম পঠিত স্মৃতিচারণটি ছিল একজন প্রত্যক্ষদর্শীর। তিনি আমার সহব্লগার অগ্রজ লেখক মুহাম্মদ জুবায়ের। ২০০৮ সালে সুরাইয়া খানমের ২য় মৃত্যুবার্ষিকীতে সচলায়তনে প্রকাশিত জুবাইয়ের ভাইয়ের সেই স্মৃতিচারণা তাই আজ আবারো সামনে এসে দাঁড়ালো।
১৯৭৬ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে আবুল হাসানের অন্তিমপর্বে সুরাইয়া খানমের একটি ঘটনার সাক্ষী ছিলেন জুবায়ের ভাই। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাঁর স্মৃতিচারণের খানিকটা অংশ পড়া যাক:
“১৯৭৩-এ আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় সুরাইয়া আপা ছিলেন না, শিক্ষক হয়ে এলেন ওই বছরের শেষের দিকে অথবা ৭৪-এর শুরুতে। ক্যামব্রিজে পড়া বিদুষী এবং অসামান্য রূপসী সুরাইয়া খানম সাড়া জাগালেন অবিলম্বে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে মহিলা শিক্ষকদের আপা বলে সম্বোধন করার প্রচলন ছিলো না। ম্যাডাম বলা হতো, সম্ভবত এখনো হয়। সেই হিসেবে সুরাইয়া খানমকে আমারও ম্যাডাম সম্বোধন করার কথা। হয়নি, তার পেছনে আমার ছোটো বোন ঝর্ণার খানিকটা অপ্রত্যক্ষ ভুমিকা ছিলো। ঝর্ণা থাকতো শামসুননাহার হলে, সুরাইয়া খানম সেখানে হাউস টিউটর হয়ে এলেন। তাঁর জন্যে আলাদা আবাস বরাদ্দ হলো না। অথবা করতে পারলো না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তিনি তখন সংসারী নন, একা মানুষ। তাঁকে থাকতে দেওয়া হয়েছিলো ছাত্রীদের জন্যে নির্ধারিত একটি কক্ষে। নম্বর ২৪০। ঠিক পাশেই ২৩৯-এর বাসিন্দা ঝর্ণার সঙ্গে তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠতা হয়। ঝর্ণার জন্যে তাঁর বরাদ্দ স্নেহ-প্রশ্রয়ের কিছু আমার ভাগে এসে পড়ায় তিনি সুরাইয়া আপা হয়ে গিয়েছিলেন। ক্লাসে আমার নিয়মিত অনুপস্থিতির ফলে বেশি যোগাযোগ ছিলো না, ছাত্র হিসেবে আমার নিতান্ত অনুজ্জ্বলতাও হয়তো একটি কারণ।
১৯৭৫-এর ২৬ নভেম্বর। সকালে ক্লাসে যাওয়ার পথে খবর পাওয়া গেলো, তরুণ কবি আবুল হাসান প্রয়াত। তাঁর কবিতা আমার প্রিয়। আবুল হাসান দীর্ঘকাল অসুস্থ ছিলেন, সরকারি উদ্যোগে চিকিৎসার জন্যে তাঁকে পাঠানো হয়েছিলো বার্লিনে। যতোদূর জানি, একজন কবির চিকিৎসার জন্যে সরকারি তৎপরতা ও সহায়তার ঘটনা বাংলাদেশে সেই প্রথম। ফিরে আসার পর হাসান অল্প কিছুদিন ভালো ছিলেন, তারপর তাঁকে আবার পি জি হাসপাতালে (এখন শেখ মুজিব হাসপাতাল) ভর্তি করতে হয়। চিকিৎসকরা আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন, সুরাইয়া আপা ছাড়েননি। আবুল হাসানের সঙ্গে সুরাইয়া আপার বন্ধুত্ব বা ততোধিক ঘনিষ্ঠতা হয়েছিলো, এই মর্মে কথাবার্তা শোনা যেতো। সেসব প্রসঙ্গ অবান্তর, কবির সেই শেষ সময়ে সুরাইয়া খানম অবতীর্ণ হয়েছিলেন মমতাময়ীর ভূমিকায়।
প্রিয় কবির মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ক্লাস করতে যাওয়া যায় না। পি জি হাসপাতালে পৌঁছে দেখলাম উদভ্রান্ত সুরাইয়া আপাকে, প্রয়াত কবির বিছানার পাশে দাঁড়ানো। তাঁকে অমন করুণ ও অসহায় আগে কোনোদিন দেখিনি। কিছু কিছু ছবি চিরকালের মতো হৃদয়কন্দরে জেগে থাকে, তাঁরে সেই মুখ আজও ভোলা হয়নি। কবির বন্ধু-আত্মীয়-ভক্তরা তখন ধীরে ধীরে সমবেত হচ্ছেন পি জি হাসপাতালে কবির অন্তিম শয্যাটিকে ঘিরে। অতো মানুষের সংকুলান সেই ছোট্টো কক্ষে হওয়ার কথা নয়, আমরা কেউ কেউ বাইরে বারান্দায় দাঁড়ানো। সুরাইয়া আপা হঠাৎ বেরিয়ে এলেন। কী ভেবে কে জানে, আমার হাত ধরে বললেন, ‘ওরা হাসানের লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়। তা কিছুতেই হতে পারে না, হাসানের খুব ইচ্ছে ছিলো তার কবর হবে রেসকোর্সের একপাশে। সে বলে গেছে। আমার কথা কেউ শুনছে না, তুমি একটু বুঝিয়ে বলবে ওদের?’
জীবনে একেকটা অসহায় সময় আসে যখন মানুষ খুব অবুঝ ও যুক্তিহীন হয়ে যায়। তখন অতি সামান্য কিছুকেও শক্ত অবলম্বন ভাবতে ইচ্ছে করে। না হলে এতো মানুষ থাকতে সুরাইয়া আপা আমাকে এই অনুরোধটি কেন করবেন? আমার কী ক্ষমতা, আমি তো সত্যিই কেউ না, আমার কথা কে শুনবে? তাঁর তখন সেসব বিবেচনা করার অবস্থা নেই। বুঝতে পারি, অনেকের কাছে প্রত্যাখ্যাত ও উপেক্ষিত হয়ে সবাইকে তিনি একই অনুরোধ করে যাচ্ছেন, হাসানের কবর যেন ঢাকায় হয়। হঠাৎ রাহাত খানকে দেখতে পাই। আমি সুরাইয়া আপাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাই। বলি, ‘রাহাত ভাই কিছু একটা করতে পারবেন হয়তো।’
নিজের অসহায়ত্ব নিয়ে সরে এসেছিলাম সেদিন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া আর কোনোদিন হয়নি। আমি পেরে উঠিনি। সুরাইয়া আপা একটিমাত্র অনুরোধ করেছিলেন, যা রক্ষা করার ক্ষমতা আমার ছিলো না।
[আমাদের সুরাইয়া খানম, মুহম্মদ জুবায়ের, সচলায়তন- ২৪ মে ২০০৮]
http://www.sachalayatan.com/zubair/15395
সুরাইয়া খানম ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব অ্যরিজোনাতে পিএইচডি করে সেখানকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। আমেরিকাতেই বাকী জীবন কাটিয়ে তিনি প্রয়াত হয়েছিলেন ২০০৬ সালের ২৫শে মে।
—-------------------------
(১৪ এপ্রিল ২০২৩, ১লা বৈশাখ ১৪৩০)
No comments:
Post a Comment