Sunday, July 2, 2023

ডাক্তারের ওপর মাস্টারী



সপ্তাহখানেক আগের কথা। আমার এক ছোটভাই প্রচণ্ড পেট ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। একের পর এক ডাক্তার সার্জন এসে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যাচ্ছেন। রোগ নির্ণয় হয়েছে কিন্তু ব্যথার উপশম ঘটছে না। অপারেশনও করা যাচ্ছে না ডাক্তারদের মতানৈক্যের কারণে। জটিল হয়ে যাচ্ছিল পরিস্থিতি। আমি নিজেও বছরখানেক আগে ভুক্তভোগী ছিলাম, সে কারণে বিষয়টা সম্পর্কে একটু ধারণা ছিল। আমার কাছে ব্যথাটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল, তাই আমি হাসপাতালের ডাক্তারদের অনুরোধ করছিলাম আরো দুয়েকটা বিশেষ পরীক্ষা করার জন্য। একাধিকবার অনুরোধ করার পর ডাক্তার খুব বিরক্ত হয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে আমাকে বললেন, “আপনি কী ডাক্তার? আপনি ডাক্তারের চেয়ে বেশী বুঝেন? এসব গ্যাসের ব্যথা। ওষুধ চলছে। সেরে যাবে”।
কিন্তু এক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকার পরও সমস্যার সমাধান না হওয়াতে অবশেষে বাইরের একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে ডাকা হলো। তিনি আমার কথিত সেই টেস্টটা দিলেন এবং দেখা গেল গুরুতর একটা সমস্যা পাওয়া গেছে। টেস্টের রেজাল্ট পাওয়ার পর ডাক্তাররা বললেন সমস্যাটা খুব গুরুতর, তাঁর হাতে সমাধান নাই। চট্টগ্রামে কেউ অপারেশন করবে না।
তারপর দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে রোগীকে অনেক কষ্ট করে ঢাকা এভারকেয়ারে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে পরদিনই অপারেশন করা হলো। ভয়ংকর একটা অবস্থা থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পাওয়া গেল।
এখন আমার একবার ইচ্ছে হয় ওই ডাক্তারকে গিয়ে বলি আমি আপনার চেয়ে বেশি বুঝেছিলাম।
আসলে সব ডাক্তার এক নয়। পরিস্থিতি আর মানসিকতার কারণে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করে। ওই একই হাসপাতাল আমার মায়ের জটিল অসুস্থতার সময় সারিয়ে তুলেছিল দুবছর আগে। সে কারণে তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
ডাক্তারের চেয়ে আমরা সাধারণ মানুষেরা বেশি বুঝবো না, এটা ঠিক। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে যদি আমরা যদি একটু বেশি বুঝি সেটাকে একদম ফেলনা মনে করা উচিত না।
প্রায় ১৮/১৯ বছর আগের একটা বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বলি।
ডাঃ শামসের উদ্দিন(ছদ্মনাম) তখন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের একটা বিভাগের প্রধান এবং অধ্যাপক। প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখেন সন্ধ্যা ছটা থেকে। এক সন্ধ্যায় সিরিয়াল নিয়ে তাঁর চেম্বারে গেলাম ঘনিষ্ট একজনের বিরল একটা রোগ নিয়ে অনুসন্ধানের জন্য। রোগটি খুব বেশী পরিচিত নয় বলে আমি নিজে ইন্টারনেট ঘেঁটে কিছু তথ্য যোগাড় করেছিলাম। সেটা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করার জন্যই যাই। উনি জানালেন এখানে ওই রোগ সম্পর্কে খুব বেশী ডাক্তার পড়াশোনা করেনি। তবু পরদিন মেডিক্যাল কলেজে যেতে বললেন অন্য সব সিনিয়র ডাক্তারের সাথে আলাপ করে যতটা সম্ভব সাহায্য করবেন।
অধ্যাপক শামসেরের এই মহানুভবতায় আমি মুগ্ধ। পরদিন মেডিকেল কলেজে গেলে তিনি আমার সংগৃহিত তথ্যগুলো দেখতে লাগলেন মনোযোগ দিয়ে। সেই ফাঁকে আমি ওই রোগ সম্পর্কে এবং চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে ইন্টারনেট ঘেঁটে যা জেনেছি তা নিয়ে ছোটখাট একটা লেকচার দিলাম। নিতান্ত সাধারণ জ্ঞানই বলা যায়। কিন্তু তিনি আমার সেই সাধারণ জ্ঞানকে অসাধারণ গুরুত্বের সাথে নিয়ে বললেন, 'আপনি একটু বসুন আমি অন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদেরও ডাকছি। সবার জানা দরকার বিষয়টা'।
খানিক পরেই আধডজনের মতো সহকারী অধ্যাপক এবং সহযোগী অধ্যাপক পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এসে হাজির হলেন।
সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে প্রফেসর শামসেরউদ্দিন আমাকে বললেন, 'একটু আগে আমাকে যা বলেছেন, সেগুলো আবার বলেন তো ওনাদের'।
উপস্থিত ডাক্তারদের উদ্দেশ্যে বললেন, 'উনি যা বলবেন আপনারা একটু নোট করে নেন কষ্ট করে। সবার জানা দরকার ব্যাপারটা।'
বলে কী? আমি লেকচার দেবো এতগুলো বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের উদ্দেশ্যে? উইকি আর গুগল গুঁতিয়ে যে ক'পাতা পড়েছি তা নিয়ে এই সুখ্যাত মেডিক্যালের বাঘা প্রফেসরদের উদ্দেশ্যে আমি একটা রোগ নিয়ে বক্তৃতা দেবো? ধরনীকে দ্বিধা হতে বলতে পারতাম। কিন্তু অধ্যাপক সাহেবের তাগাদায় লেকচারটা আবারো দিতে হলো।
লেকচার শেষে উপস্থিত এক ডাক্তার পাশের বইয়ের আলমারী থেকে মোটা একটা চিকিৎসা পুস্তক নামিয়ে আমার সামনে এনে পাতা খুলে দেখালেন সেই রোগ সম্পর্কে যা যা লেখা আছে। দেখলাম ওই রোগ সম্পর্কে বিশ বছর আগে প্রকাশিত সেই বইটিতে মাত্র দশ লাইনের একটা প্যারা আছে। বললেন, ওনারা ওইটুকুই পড়েছেন শুধু। এখন বুঝলাম এর বাইরে আর কিছু পড়া হয়নি এদের, তাই আমার সংগ্রহ করা বাইশ পাতার সাধারণ জ্ঞান ওনাদের কাছে মহাভারত মনে হচ্ছে।
লেকচার পর্ব শেষ হবার পর আমাকে চা নাস্তা খাইয়ে প্রফেসর সাহেব বিদায় দিলেন। বের হবার পর মনে পড়লো আমার নিজের কাজটাই তো হলো না। আমি এসেছিলাম একটা রোগের চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ নিতে। কিন্তু পরামর্শ তো পেলাম না, উল্টো ডাক্তারদের জ্ঞান দিয়ে গেলাম সেই রোগ সম্পর্কে। ব্যাপারটা হাস্যকর এবং অবিশ্বাস্য।
অতএব মাঝে মাঝে এটাও মানতে হবে যে বিশেষ কোন পরিস্থিতিতে রোগীও ডাক্তারের চেয়ে বেশি বুঝতে পারে। সেটাকে সম্মান করলে দুপক্ষেরই লাভ হতে পারে।

No comments: