মাহমুদের বাবা যখন হঠাৎ মারা যায় মাহমুদ তখন মাত্র বিএ পাশ করেছে। ৪ভাই ৩বোন আর মাকে নিয়ে জীবনের সর্ববিষয়ে অনভিজ্ঞ মাহমুদ সংসার সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে খেতে অবশেষে একটা চাকরীর সন্ধান পেল। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর চাকরীটা না পেলে গ্রামে গিয়ে হালচাষ করা ছাড়া উপায় ছিল না। এমনিতে গ্রামে বহুবছর যায়নি, পৈত্রিক সম্পত্তিগুলো চাচারাই দেখাশোনা ভোগদখল করে। চাকরীটা পাবার পর স্বস্তিকর জীবন শুরু হলো। কিন্তু নতুন জীবন শুরু হতে না হতেই একটা ভাই হঠাৎ মারা গেল দুঃখজনক এক ঘটনায়। বাবার পর ভাইকে হারিয়ে পাথর হয়ে গেল মাহমুদ। ওর চেহারার দিকে তাকানো যেতো না তখন। বোকা বোকা হয়ে গিয়েছিল। কিছুদিন পর আবার নতুন উদ্যমে শুরু। এই দ্বিতীয় যাত্রার প্রাক্কালে আমার সাথে মাহমুদের ঘনিষ্টতা জন্মায়। পড়াশোনার সুত্রে। মাহমুদ রাজনীতির পোকা ছিল। বাম রাজনীতির সক্রিয় কর্মী। ওর পুরো ঘর জুড়ে রাজনৈতিক বই। কালমার্কস, তাজউদ্দিন, মোনাজাতউদ্দিন থেকে শুরু করে রাজনীতি নিয়ে খ্যাত অখ্যাত যত বই দেখে সব কিনে। তবে সব পুরোনো বই। রেয়াজুদ্দিন বাজারে একটা পুরোনো বইয়ের দোকান আছে। অফিস শেষে প্রতিদিন বিকেলে ঘন্টাখানেক ওখানে কাটিয়ে বাসায় ফিরতো। আমারো বইয়ের নেশা ছিল বলে আমরা প্রতি সন্ধ্যায় বসতাম। বন্ধুদের মধ্যে আমরা দুজনই বাবাকে হারিয়েছিলাম সবার আগে। ফলে দুজনের মধ্যে সহমর্মিতা আর বোঝাপড়া ছিল বেশ।
সবকিছু যখন মোটামুটি স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছিল মাহমুদ একটা বোনের বিয়ে দিল ধুমধাম করে আমেরিকা প্রবাসী ছেলের সাথে। নিজের ভাল চাকরীর অফার পেতে লাগলো। ভাল পোষ্টে অফার পেয়ে নতুন একটা কোম্পানীতে যোগ দিল। তার কদিন পর শোনা গেল মাহমুদ বিয়ে করছে। আমরা অবাক। এমনকি ঘনিষ্ট বন্ধুরাও জানতো না। চাইনিজ হোটেলে বিয়ের চমৎকার অনুষ্ঠান হলো। মেয়েটা বয়স অল্প। ১৮/১৯ হবে। সুন্দরী তরুনী চটপটে বৌ পেয়ে মাহমুদ আমাদের প্রায় ভুলেই যায় আর কি। বিয়ের পরদিন থেকে বেশ কয়েকমাস দেখা নেই ওর সাথে। বেশীরভাগ ছেলে বিয়ের প্রথম দিকে বৌ নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে, রোমাঞ্চ, দাওয়াত, সামাজিক আচার। তাই আমিও সন্ধ্যাবেলার বইয়ের আড্ডাটা বন্ধ করে দিয়েছি।
একবার বন্ধুরা সবাই মিলে কক্সবাজার বেড়াতে গেলাম। যে কজন বিয়ে করেছে সবাই বৌ নিয়ে গেছে একমাত্র মাহমুদ বাদে। কক্সবাজার পৌছে দুপুরে হোটেলে খাওয়া গোসল সেরে ব্যাচেলর আমি ঘোষনা করলাম, মহেশখালী ঘুরে আসতে যাচ্ছি আমি। ব্যাচেলর যে কেউ চাইলে সঙ্গী হতে পারে। আমার ঘোষনা শুনে ব্যাচেলর তো বটেই, বিবাহিত দুতিনজনও বৌকে লুকিয়ে আমার সাথে যোগ দিল। রাতে অবশ্য তাদের এজন্য যথেষ্ট খেসারত দিতে হয়েছিল বৌয়ের কাছে। সে গল্প আরেকদিন। মহেশখালি পৌছে আদিনাথ পাহাড়ে ছবি তোলার সময় হঠাৎ খেয়াল করলাম মাহমুদ কেমন যেন একলা একলা থাকতে চাইছে। চেহারায় কেমন যেন মলিনতা। কারো সাথে গল্পগুজব করছে না। আড্ডার তোড়ে ব্যাপারটা ভুলে গেলাম শীঘ্রই। ফিরে আসার কয়েকদিন মাহমুদের সমস্যার কথা জানতে পারলাম জাহেদের কাছ থেকে।
মাহমুদের বিয়ে খুব সংকটে। প্রায় ভঙ্গুর আর কি। মাহমুদের বৌয়ের আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। মেয়েটা ঘর থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছিল একটা ছেলেকে। পরে বাবা মা ধরে এনে ডিভোর্স করিয়ে নিয়েছে। এখন আবার বিয়ে দিয়েছে মাহমুদের কাছে। মাহমুদ ব্যাপারটা জেনেছে বিয়ের ঠিক আগে আগে। বিয়ের কথাবার্তা চুড়ান্ত হবার আগে মেয়ের পরিবার মাহমুদকে মেয়েটার সাথে ঘনিষ্টতার সুযোগ করে দেয়। ঘনিষ্টতা চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌছানোর পর (পয়েন্ট অব নো রিটার্ন) মাহমুদ জানতে পারে মেয়েটার পুরোনো সম্পর্কের কথা। কিন্তু ততদিনে দেরী হয়ে গেছে, মাহমুদ মেয়েটার সাথে দারুন প্রণয়ে আবদ্ধ, একদম গভীরে ডুবে গেছে। তাছাড়া সে প্রগতিশীল ছেলে। এসব কোন ব্যাপারই না ওর কাছে। মানুষের একাধিক বিয়ে, প্রেম এসব হতেই পারে। আর মেয়েটা যখন পালিয়ে বিয়ে করেছে তখন ওর বয়স মাত্র ১৫ বছর। ওই বয়সে মেয়েরা ভুল করতেই পারে। তাই বর্তমানটাকেই গুরুত্ব দেবার সিদ্ধান্ত নেয় মাহমুদ। আর কারো সাথে পরামর্শের তোয়াক্কা না করে উদারতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে হুট করে বিয়ে করে ফেলে মেয়েটাকে। বিয়ের দিনের ছোট্ট একটা ঘটনা মাহমুদ পরে বলেছে আমাকে।
বিয়ের গাড়ী যখন মাহমুদের বাসার সামনে এল, মাহমুদের মা আগেই বাড়ীর দরজায় দাড়ানো, বৌমাকে সাদরে বরন করার জন্য। গাড়ীর দরজা খুলে নামতেই মা ছুটে গিয়ে বৌমার হাতটা ধরলো ঘরে নেবার জন্য। বৌ এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে বললো, "ছাড়েন, এসব ঢং আমার ভালো লাগে না।" কথাটা শুনে মা স্তব্ধ। মাহমুদ চুপ। সে ভাবলো বয়স কম, আর বিয়েবাড়ীর গরমে-ভিড়ে অতিষ্ট হয়ে মুখ ফসকে বলে ফেলেছে।
ছুটির কয়েকটা দিন টোনাটুনির মতো রুমের মধ্যেই কাটায় দুজনে। কিন্তু আরো কয়েকদিন যাবার পরও দেখা গেল, মেয়েটা রুম থেকে বোরোয় না। মাহমুদ ছাড়া কারো সাথে ভালো করে কথা বলে না। ঘরের কোন কাজকর্মের তো প্রশ্নই ওঠেনা। মাসখানেক পর একদিন বৌ বাপের বাড়ী বেড়াতে গেল। কয়েকদিন পর মাহমুদকে জানালো ওই বাসা তার ভালো লাগে না, আলাদা বাসা না নিলে সে আর ফিরে আসবে না। আরও বললো মা ভাইবোনদেরকে গ্রামে পাঠিয়ে দিতে। মাহমুদ যেন তার সিদ্ধান্ত জানায়। মাহমুদের মাথায় যেন বাজ পড়লো। যেখানে পুরো পরিবার তার আয়ের উপর নির্ভর, সব আশাভরসা তার উপর, সে ছাড়া পরিবারের আর কোন অবলম্বন নেই। মেয়েটা কীভাবে বলতে পারলো এমন কথা? মাহমুদ বৌয়ের কথায় রাজী হলো না। বৌ আসলো না।
ওদিকে নতুন যে কোম্পানীতে চাকুরী নিয়েছিল, তাদের ব্যবসা ভালো যাচ্ছিল না। চাকরীটা প্রায় চলে যাচ্ছিল তবু কোন মতে ঠেকালো বস ভালো ছিল বলে, তবে বেতন অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ। কোম্পানীর অবস্থা ভালো হলে বেতন দেয়া হবে। সে আশায় মাহমুদ চাকরীটা চালিয়ে যাচ্ছে। কয়েকমাস পর ডিভোর্সের নোটিশ পেল মাহমুদ বৌয়ের কাছ থেকে। সাথে ৩ লাখ টাকা কাবিনের দাবী। মড়ার ওপর খাড়ার ঘা। অনেক দেন দরবার হলো। কোন লাভ হলো না। টাকা না দিতে পারলে জেল খাটতে হবে। এমনিতে বেতন নেই, সঞ্চয়তো অনেক আগেই শেষ। ধার-কর্জ করে চলছে সংসার। এ অবস্থায় ভাগ্যের এই কষা থাপ্পড় কেমন লাগে? আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম সেই পুঁচকে মেয়ের ক্ষমতা দেখে। এক বছর সময় নিয়ে কিস্তিতে কিস্তিতে, আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় কোন মতে কাবিনের দাবী মেটানো গেল।
এই সময়ে মাহমুদ নিজেকে ভুলিয়ে রাখার জন্য বেশী বেশী করে রাজনীতির দিকে ঝুঁকলো। চাকরীতে বেতন পাওয়া শুরু হয়েছে, যদিও অর্ধেক। তবু কম কি, বেঁচে থাকতে পারলেই হলো। পায়ের নীচে খানিকটা মাটি পেয়ে দাঁড়াতে চাইল মাহমুদ। একদিন রমজানের সময় গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন, ঈদ বোনাস ইত্যাদির অধিকার নিয়ে আন্দোলনে মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছিল মাহমুদ। পুলিশের বেপরোয়া আক্রমন তেড়ে এল তাদের ওপর। গ্রেফতার হয়ে জেলে চলে গেল সে। এ ঘটনার পর পরিবারের উপর বিপর্যয়ের খাড়া নেমে আসলো। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি পড়ে গেলে যা হয় আর কি। মাহমুদের পরিবারের আর কোন আশ্রয়ই রইল না শহরে। ছোট ভাইবোনদের নিয়ে গ্রামের বাড়ীতে চলে গেল ওর মা। বিনা বিচারে প্রায় ছয়মাস জেল খেটে, জামিনে ছাড়া পেল।
দেখতে গেলাম আমি। কিন্তু এ কাকে দেখছি ? সে আর আমাদের পুরোনো হাসিখুশী মাহমুদ না। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখ দুটো বসা, মুখের দুই পাশে হাড্ডি বেরিয়ে গেছে, মাথায় চুল পড়ে অর্ধেক। বোঝা যায় জেলখানায় কী দুর্দশা গেছে। আশ্চর্য লাগে যে মানুষটার নিজের অধিকারেরই ঠিক নেই সে অন্য মানুষের জন্য আন্দোলন করে জেলে যায়! চা খাওয়ার পর সিগারেট অফার করলে মৃদু হেসে হাত নেড়ে বললো, সিগারেটে পোষায় না। বিড়ি ধরেছি। জেলে তো বিড়ি ছাড়া উপায় নাই। বিড়ির অভ্যেসটা হয়ে গেছে। আর বিড়ি তো জেলখানার অঘোষিত মুদ্রা। তোষকের নীচ থেকে আকিজ বিড়ির বান্ডিল বের করে ধরালো।
জেল থেকে ছাড়া পেল ঠিকই কিন্তু মামলাটা রয়ে গেল। নিয়মিত হাজিরা দিতে হয়। খরচ অবশ্য পার্টি থেকে দিচ্ছে। অফিসের বসটা ভালো ছিল বলে, চাকরিটাও ফিরে পেল আবার। বেতন যদিও অর্ধেক এখনও। তবু আবারো উঠে দাড়ানোর চেষ্টা। কিছুদিন পর গ্রামে গেল মাকে নিয়ে আসতে। গিয়ে আরেকটা নতুন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলো, ওদের সব জমি জমা চাচারা বেদখল করে ফেলেছে দীর্ঘ অনুপস্থিতির সুযোগে। ভাগ্যের চতুর্থ কামড়। মাহমুদ নিজেই গ্রামে চলে গেল দীর্ঘ ছুটি নিয়ে। এবারের ছুটি মানে চাকরী শেষ। কোন কোম্পানী এতবার এতদিন ছুটি দেয় না। গ্রামে গিয়ে মামলা মোকদ্দমা হয়রানি অপমান গ্লানি। শেষ হয় না কিছুতেই। ক্লান্ত ক্লান্ত মাহমুদ। তবু পরাজিত হয় না। আজীবন সংগ্রামী মাহমুদ ঘরে বাইরে যুদ্ধ চালিয়েই যায়। এখনও চলছে।
মাহমুদের জীবনটা নিয়ে মাঝে মাঝে ভাবি। এক সময় সব ছিল ওর, সুখের সব উপাদান। তারপর আস্তে আস্তে ঝরে পড়তে লাগলো একেকটা সুখ। ভাগ্য কিছু কিছু মানুষের প্রতি এমন নির্দয় হয় কেন? আরেকটু কম নির্দয় হলে কী এমন ক্ষতি হয়ে যেতো বিশ্বজগতের? যতই সে উঠে দাঁড়াতে চায়, ভাগ্য তাকে আবার আছড়ে ফেলে শক্ত মাটিতে। যেন তাকে উঠতে না দেয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে ভাগ্যবিধাতা!!
No comments:
Post a Comment