Sunday, November 2, 2008
যখন শিবির ছিলাম
১৯৮২-৮৩ সালের কথা। ক্লাস নাইন-টেনে পড়ি। আগ্রাবাদ সি.জি.এস. কলোনীতে থাকতাম। সবে হাফ প্যান্ট ছেড়ে ফুল প্যান্ট ধরেছি। পরীক্ষার আগে আগে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার একটা হুজুগ ছিল তখন। একদিন মসজিদ থেকে বেরিয়ে ফর্সা সুন্দর একটা মানুষের দেখা পেলাম। দেখা পেলাম মানে উনি যেন অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য, মুখে মিষ্টি হাসি। কাছে এসে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেন। এত মোলায়েম সুরে কথা বললেন প্রথম দর্শনেই আমরা মুগ্ধ। পরদিন থেকে প্রায়ই দেখা হতে লাগলো ওনার সাথে। দেখলেই এত আন্তরিকভাবে কথা বলতেন যেন আমরা আপন ছোট ভাই। মাসখানেকের মধ্যে মিল্লাত ভাই আমাদের খুব কাছের মানুষ হয়ে গেলেন। আমাদেরকে নিয়মিত মসজিদে যাবার উপদেশ দেন, মিলাদে-ইফতার পার্টিতে দাওয়াত দেন।
আমরা বন্ধুরা প্রায় প্রত্যেক দাওয়াত রক্ষা করতাম, তবে নিজস্ব নিয়মে। আলোচনা অনুষ্ঠান ইত্যাদির প্রতি বরাবরই অভক্তি থাকাতে মিলাদে যেতাম মোনাজাতের একটু আগে, ইফতারে যেতাম মসজিদে আজান দিলে। ফলে আগে কি আলোচনা হয়েছে তার কিছুই জানতাম না। মিল্লাত ভাই বলতেন নামাজের পরে আরো কিছু সময় মসজিদে কাটাতে। কারন ওখানে দ্বীনি আলাপ-আলোচনা করে বড় বড় মানুষেরা। দাওয়াতী অনুষ্ঠান। কিন্ত খাওয়ার অনুষ্ঠানে আমাদের যেরকম নিয়মিত দেখা যায় দাওয়াতের অনুষ্ঠানে মোটেই না। খাবার কোন পর্ব না থাকলে নানান ছুতোয় দাওয়াত এড়িয়ে যেতাম। তবে প্রায়ই দেখতাম এশার নামাজের পর কিছু ফর্সা দাড়িওয়ালা লোক ওখানে বসে ফুসুর ফসুর আলাপ করছে। বুঝতাম না ওসব কিসের কী। কোন মাথা ব্যথাও ছিলনা। কদিন পর মিল্লাত ভাই তার মতো আরো কিছু লোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। দেখলাম সবাই খুব মায়া নিয়ে কথাবার্তা বলছে আমার সাথে। এত বেশী আন্তরিক যে পরিচয় হবার থেকে যখনই দেখা হয়েছে রাস্তায়, দৌড়ে এসে দুহাতে জড়িয়ে ধরতো। হাতে হাত রাখতো। শুধু তাই না। একবার হাত ধরতে পারলে আর ছাড়াছাড়ি নাই।
মানুষে মানুষে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই এক নতুন জিনিস দেখলাম। হ্যান্ডশেক করে আমরা সাধারনতঃ ঝাঁকি করেই হাত ছেড়ে দেই, এরা কিন্তু আঠা, ছাড়তো না সহজে। ধরে রাখতো বিদায়ের আগ পর্যন্ত এবং ততক্ষন পর্যন্ত হাত দুটো নিয়ে অনবরত মোচরা-মুচরি করতো। আগে ভাবতাম ওটা কেবল মিল্লাত ভাইয়ের স্বভাব, পরে দেখলাম ওনার দলের সব লোকের এই স্বভাব। দল বলছি ঠিকই কিন্ত তখনও জানিনা দলের নাম কি? ছোট আর লাজুক ছিলাম বলে কিছু বলতাম না।
এক বন্ধু সাবধান করে বললো, এটা ‘পোয়া খোর’ স্বভাব। খবরদার, আড়ালে ডাকলে যাবি না। এটা শোনার পর থেকে ওদের দাওয়াতে যাওয়া কমিয়ে দিলাম সবাই। পারতঃপক্ষে হ্যান্ডশেক করতাম না দেখা হলে। তবু ভাটা পড়লোনা তাদের প্রেমে। একবার তাদের বড় কিছু নেতা এলো এলাকায়। পথে দেখা হলে মিল্লাত ভাই আমাকে দেখিয়ে বললেন, এইতো আমাদের এক কর্মী ভাই (ওনারা বড় ছোট সবাইকে ভাই ডাকে) যাচ্ছে। উনার পরিচয়? - নেতার জিজ্ঞাসা। মিল্লাত ভাই জানালেন উনি নোমান ভাই, কিছুদিন আগে 'কর্মী' হয়ে গেছেন।
আমি একটু থমকে গেলাম, কথার মাথামুন্ডু কিছু বুঝলাম না “কর্মী হয়ে গেছেন” মানে কী । আমি কি ওদের কামলা নাকি। মাথা গরম হয়ে গেল একটু। আসলে তখনো আমি বুঝিনি ‘কর্মী’ ব্যাপারটা। মিল্লাত ভাইদের দলটা যে ইসলামি ছাত্র শিবির এটাও পরে বুঝেছি। শিবির ক্যাডার ভিত্তিক সংগঠন। ওখানে প্রমোশন সিস্টেম আছে, প্রথমে সমর্থক হতে হয়, তারপর কর্মী, তারপর সাথী, তারপর সদস্য বা রোকন।
তখনও এসব শেখা হয়নি। কিন্ত তার আগেই আমি ‘কর্মী’। কখন আমি ‘সমর্থক হলাম, কখন প্রমোশন পেলাম-কী কৃতিত্বের জন্য কিছুই জানিনা। নেতাও খুশী নতুন কর্মী দেখে। মিল্লাত ভাইকে জিগগেস করলো, 'বায়তুল মাল' নিয়মিত আদায় করে তো? উনি হ্যাঁ-বোধক জবাব দিলেন। আমি আরো আজীব হয়ে গেলাম। ‘বায়তুল মাল’ আবার কী? আমি কখন আদায় করলাম। পরে জেনেছি এটা হলো কর্মী চাঁদার শিবির ভার্সন। আমার মনে তখন অনেক প্রশ্ন, কিন্ত আমি ব্যাখ্যা চাওয়ার আগেই আমাকে থামিয়ে দিয়ে কথা অন্যদিকে নিয়ে গেল। পরে আমি ব্যাপারটা ভুলে গেলাম।
মেট্রিক পাশের পর আমার বন্ধু-বান্ধব বাড়লো, আড্ডা বাড়লো। মিল্লাত ভাইদের সাথে দেখা হয় কম। উনি কিছুটা নাখোশ বোধহয়। আমাকে বিনা মূল্যে প্রমোশন দেয়ার পরও আমি আড্ডা দেই সেই বন্ধুদের সাথে যারা কমিউনিষ্ট, ছাত্র ইঊনিয়ন করে। যদিও আমার সব আড্ডা ছিল নেহায়েত ব্যাক্তিগত। আমি কোন রাজনীতির সাথেই ছিলাম না।
আমার ওপর ক্ষোভটা পরিষ্কার দেখা গেল একদিন জুমার নামাজের পর। মাত্র কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি তখন। মুখোমুখি দেখা হলে মিল্লাত ভাই শ্লেষের সাথে আমার দিকে আঙুল তুলে আরেক নেতাকে বলতে লাগল, "নোমান ভাইতো এখন ‘কমিউনিষ্ট’ হয়ে গেছে।" যেন একটা গালি দিল। আমার কিন্তু খুব আমোদ হলো কথাটা শুনে। আমি হাসলাম ওদের সারা গায়ে জ্বালা ধরিয়ে। মেসেজটা পেয়ে দারুন আনন্দিত। আমাকে ওরা আর ‘কর্মী’ মনে করছে না। তাহলে বায়তুল মালও খুঁজবে না আর। অনেক টাকা বাকী নিশ্চয়ই। কে দিয়েছে আমার দীর্ঘ সময়ের সমর্থক চাঁদা, কে দিয়েছে কর্মী চাঁদা। সবচেয়ে মজা পেলাম ভেবে যে আমার অজান্তেই বহিষ্কার করেছে আমাকে - যেভাবে একদিন আমার অজান্তেই নিয়োগ দিয়েছিল শিবির ক্যাডার হিসেবে।
সেই আমার প্রথম পরিচয় জামাত-শিবিরের রাজনৈতিক কুটিলতার সাথে।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment