বাঙালীমাত্রেই রাজনীতি প্রিয়। রিকশাওয়ালা থেকে শিল্পপতি পর্যন্ত সবারই নিজস্ব রাজনৈতিক পছন্দ অপছন্দ আছে। মাঝে মাঝে মনে হয় রাজনীতিতে মাথাটা আরেকটু কম ঘামালে দেশ আরো এগোতে পারতো। তবু খাওয়া-পরা-ঘুমের মতো রাজনীতি আমাদের প্রত্যেকের কিছু না কিছু সময় অধিকার করে রাখে প্রতিদিন। টিভিতে খবর দেখতে দেখতে কিংবা খাবার টেবিলে সপরিবারে রাজনৈতিক তর্ক খুব স্বাভাবিক দৃশ্য এদেশে।
জামাতে ইসলামীর নিবন্ধন নিয়ে নির্বাচন কমিশন নাটক করলো একটা। তা নিয়ে তোলপাড়। ব্যক্তিগতভাবে জামাতে ইসলামীকে অপছন্দ করি তিনটি কারনে। প্রথমতঃ ১৯৭১, দ্বিতীয়তঃ ইসলামের বিকৃতি, তৃতীয়তঃ ভন্ডামি। তবে আমার চোখে তাদের যেগুলো তাদের দোষ, সমর্থকদের চোখে সেগুলো গুন। আমি 'রাজাকার' বলি গালি অর্থে, কিন্তু জামাতের সমর্থক এটাকে ইসলামের সেবক মনে করে। জামাতের সংসদে আসন সংখ্যা বেশী না হলেও তাদের ভোট ব্যাংক তাদের যোগ্যতার তুলনায় অনেক বেশী। এর প্রধান কারন দলটির সাংগঠনিক দক্ষতা নয় বরং প্রধান কারন বিএনপি ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির ধারা। এই দুই দলের কল্যানে জামায়াত মোটামুটি ভালো অবস্থানে থাকে সব সরকারের আমলে।
বিএনপি আদর্শভিত্তিক কোন দল নয়। বরং দলটির মুল ভিত্তি আদর্শহীনতা। তবু দলটি গড়ে উঠেছে কিছুটা আওয়ামী লীগের ব্যর্থ শাসনে বিরক্ত মানুষের বিপরীত সমর্থনে, আর কিছুটা জেনারেল জিয়ার ব্যক্তিগত সামরিক ক্যারিশমার গাল-গল্পে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সকল প্রাক্তন মুসলিম লীগ, আওয়ামী আশীর্বাদ বঞ্চিত হতাশ সামরিক-বেসামরিক আমলা, রাজনৈতিক নেতা, জিয়ার অনুগ্রহভাজন হয়ে আলাদা একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরী করেছিল। সেই প্ল্যাটফর্ম পরবর্তীতে বিএনপি নামে পরিচিত হয়েছে। আদর্শ একটাই, আওয়ামী-বাকশালী ঠেকাও। ৭০-৭১ সালে আওয়ামী লীগের পেছনে সমবেত হওয়া মানুষের সমর্থন ৭৩-৭৫ সালে এসে ব্যপক হারে ধ্বসে পড়ে নিদারুন অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারনে। আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থা হারানো সেই বিশাল জনগোষ্টীকে জেনারেল জিয়া সামরিক ক্যারিশমায় নিজ আস্থায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন শীঘ্রই। জিয়ার সময়কালে সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার কারনে বিএনপির সমর্থন বাড়তে থাকে সারাদেশে। ঠিক সেই সময় জিয়ার বহুদলীয় রাজনীতির ছাতা মাথায় স্বাধীনতা বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রবেশ। পরবর্তীকালে আরেক লম্পট স্বৈরাচার হু.মু.এরশাদের ধর্মীয় ভন্ডামির রাজনীতি জামাতকে হৃষ্টপুষ্ট হবার সুযোগ করে দেয়।
১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর জামাতের প্রতি আশীর্বাদ প্রসারিত হয় আরো। গোলাম আজমকে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু বিএনপি আমলের শেষের দিকে ক্ষমতার রাজনীতির নীতিহীন ভাগাভাগিতে জামাত ও আওয়ামী লীগের মধ্যে অবৈধ প্রেমের ঘটনা ঘটে যায়। ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ ক্ষমতার স্বাদ পেলে জামাতের সাথে অবৈধ প্রেমের অবসান ঘটে আবার।
১৯৯৬ সালের পর থেকে জামাত নতুন পদ্ধতির রাজনীতির চাষ করা শুরু করে। হরকতুল জিহাদ, হিজবুত তাহরীর, বাংলাভাই, এরকম অগনিত আন্ডারগ্রাউন্ড দল ও পান্ডার জন্ম দেয় জামাত। শুরু হয় বোমা কালচার। লক্ষ্য সব প্রগতিশীল মঞ্চ। কিন্তু ভুলেও একটা বোমা বিষ্ফেরিত হয়না বিএনপি বা তাদের সমমনা কোন সংগঠনের অনুষ্ঠানে। ২০০১ সালে বিএনপির ওয়ার্কিং পার্টনার হিসেবে ক্ষমতার আংশিক স্বাদ পেয়ে বিএনপির কাঁধে পা ঝুলিয়ে বসে জামাত। ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার পরিকল্পনা এগিয়ে চলে। ২০০৬ এর শেষের দিকে যার চুড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে। যে কারনে ১/১১ কে বিধাতার আশীর্বাদ মনে হয়েছিল।
১/১১ এর পর বিএনপির চেয়ে জামাতের হতাশা ছিল লক্ষনীয় পরিমান বেশী। কারনটা কী? বাড়া ভাতে ছাই? কিন্তু পাতের ভাত কেড়ে নেয়া হলেও হাল ছাড়েনি জামাত। বসে থাকেনি একদিনও। ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে ব্যর্থ হয়ে এই ত্বত্তাবধায়ক সরকারের আমলে জরুরী অবস্থার অবসরে ঘরের- বাইরের সব নেটওয়ার্ক মেরামত-সম্প্রসারনে ব্যস্ত থাকে দুই বছর। সেই নেটওয়ার্কের মজেজায় দুর্নীতিবিরোধী সাড়াঁশি অভিযানেও অক্ষত থাকে জামাতের নেতাকুল। গ্রেফতারী পরোয়ানা মাথায় নিয়েও রাস্ট্রের সর্বোচ্চ কর্নধারদের সাথে হাসিমুখে সভা করে বেরিয়ে আসে তাদের নেতারা। মানুষ টিভিতে সেই মুখ দেখে প্রতি সন্ধ্যায়, অথচ পুলিশ তাদের খুঁজে পায় না।
হাসিনা-খালেদা-মুজাহিদ এই তিন জনের মধ্যে কে বেশী শক্তিশালী? উত্তরের জন্য বেশী ভাবতে হয় না এখন।
এমন শক্তিমান একটা দলকে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন দেবে না, এধরনের চিন্তা কি বাস্তবসম্মত? জামায়াত নিবন্ধন পাবে এটা নিশ্চয়ই পুর্বনির্ধারিত ব্যাপার। না হলে নির্বাচন কমিশনের শুনানীতে হাজির না থেকেও কিভাবে নিবন্ধন সার্টিফিকেট পেয়ে যায় জামাত। মাঝখানের প্রহসনগুলো সেই জলিল-মান্নান সংলাপ নাটকের মতো সময়ক্ষেপন। সরকার কি কোথাও অসহায়? কোথায়?
আমার এক উদারপন্থী বন্ধু বলে, ওরা রাজনীতি করলে অসুবিধা কোথায়, নির্বাচন করলে সমস্যা কোথায়, ওরাও তো দেশের নাগরিক।
বন্ধুকে বলি, ওরা এদেশের নাগরিক ঠিক আছে, তাছাড়া জামাত করে তো আমাদেরই কারো কারো মামা-চাচা-খালু-ভাই-বেরাদার। তাদের তো ফেলে দিতে পারবো না।
কিন্তু যে পতাকার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ১৯৭১ সালে লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তে লাল করেছিল এ দেশের মাটি, সে পতাকা ওদের গাড়ীতে উড়বে, এটা আমার সহ্য হয় না। যারা এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের দাওয়াত দিয়ে এনে লাথি মারার মতো দুঃসাহস দেখায় তাদের হাতে এ দেশের সংসদের চাবি কতটা নিরাপদ? যারা এখনো শ্লোগান দেয় 'একাত্তরের রাজাকার গর্জে ওঠো আরবার', তাকে আমি কী করে বুকে নেবো। সে আমার ভাই হোক আর খালুই হোক।
স্বাধীনতার এত বছর পরেও যাদের বিশ্বাসে এতটুকু পরিবর্তন আসেনি, যাদের আচার আচরনে একটুও অনুশোচনা দেখি না, সেই ঘাতকদের, দালালদের, রাজাকার-আলবদরদের এদেশের রাজনীতিতে, সংসদে হেসে খেলে বেড়াতে দেখলে সত্যিই বিবমিষা হয়।
No comments:
Post a Comment