একজন রাজাকারের গল্প বলি। তার নাম আবদুল আলীম। বয়স এখন প্রায় ৫৫/৫৬। আমার নিজের গ্রামের বাসিন্দা। বর্তমান পেশা পাহারাদার। ১৯৭১ সালে আবদুল আলীমের বয়স ১৮ বছরের কাছাকাছি। দারিদ্রপীড়িত পরিবারের সন্তান। পড়াশোনা করার সুযোগ হয়নি। নিয়মিত কোন কাজ নেই। মাঝে মাঝে দিনমজুর খেটে কোনমতে সংসার চালাত। বাবা মারা গেছে অনেক ছোট বয়সে। মা আর ছোট ভাই আমিনকে নিয়ে বাঁশের খুপড়ি ঘরে খেয়ে না খেয়ে দিন যাপন করছিল।
যুদ্ধের শুরুতে এলাকার মাতব্বর উকিল আহমেদ হোসেন পাকিস্তান রক্ষায় তৎপর হয়ে পড়েন। এলাকার লোকজনকে নিয়ে গড়ে তোলেন শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী। আবদুল আলীমকে ডেকে রাজাকার বাহিনীতে চাকরীর অফার দেন। মাসিক বেতন ১৫ টাকা। দ্বিতীয় চিন্তার চেষ্টা না করেই আবদুল আলীম রাজী। খবর পেয়ে খুশীতে ডগমগ আবদুল আলীমের পরিবার। আল্লায় মুখ তুলে চেয়েছে এতদিনে। তিন বেলা পেটপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা হল। কাজও তেমন কঠিন না, রাতের বেলা কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে গ্রামের সামনে মহাসড়কের সেতুটা পাহারা দেয়া। দিনে ঘুম, রাতে পাহারা।
ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হবার পর ভয়ে বেশ কিছুদিন পালিয়ে ছিল আবদুল আলীম। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসলে বাড়ী ফিরে আসে। এবং আবারও সেই পুরোনো কর্মহীন জীবন। অভাব, অনাহার, অর্ধাহার। না, স্বাধীনতা কোন পরিবর্তনই আনতে পারেনি তার জীবনে। বরং যুদ্ধের সময়টাই আরামের ছিল। যুদ্ধটা যদি আরো দীর্ঘায়িত হতো!
রাজাকার বাহিনীতে চাকরী করার কারনে কিনা জানি না, তাকে এলাকায় কোন কাজ কর্ম করতে দেখা যেতো না। মুখচোরা হয়ে থাকতো সবসময়। পরে কে যেন শহরে রিয়াজুদ্দিন বাজারে দারোয়ানের চাকরী যোগাড় করে দিয়েছিল, যা এখনো তার পরিবারের একমাত্র জীবিকা।
আমি গোলাম আজম-নিজামীদের ঘৃনা করি, উকিল আহমদ হোসেনকে ঘৃনা করি, কিন্তু আবদুল আলীমকে কখনো ঘৃনা করতে পারিনি। এমনকি সে যে রাজাকার ছিল সেটা আমার মনেও থাকে না। কারন তাঁর রাজাকার পরিচয়ের চেয়েও তাঁর অভাবী সংসারের পরিচয়টা অনেক বেশী প্রকট। তাছাড়া সে কখনো পাকিস্তান রক্ষার কুযুক্তির বানী শোনায়নি অথবা ইসলামের দোহাই দিয়ে তার রাজাকারী জায়েজ করারও চেষ্টা করেনি। বরং সে যে রাজাকার ছিল তার জন্য অনুতপ্ত হতে দেখেছি।
যদি কেউ বলে শেখ মুজিব রাজাকারদের সাধারন ক্ষমা করে মস্ত ভুল করেছিল, তখন আমার আবদুল আলীমের কথা মনে পড়ে যায়। বুঝতে পারি শেখ মুজিব কাদেরকে ক্ষমা করেছিল, কেন করেছিল। অসহায়, অভাবী মানুষ যারা নিজের দুর্দিন কাটাতে পাকিস্তানীদের চাকরী করতে বাধ্য হয়েছিল, তাদেরকেই ক্ষমা করেছিল শেখ মুজিব। চিহ্নিত ঘাতকদের নয়।
আবদুল আলীমদের ক্ষমার ফোকড় দিয়ে যখন নিজামী-মুজাহিদদের মতো আত্মস্বীকৃত গর্বিত রাজাকারেরা পিছলে বেরিয়ে যেতে চায়, তখন কী করা উচিত?
No comments:
Post a Comment