ভোরে অফিসে যেতে যেতে মানুষের পদচারনা দেখছিলাম। হেমন্তের মিষ্টি সোনালী ভোর, শিশির স্নাত ঘাস, পাখপাখালির কিচিরমিচির। বাঁয়ের পাহাড়ী সবুজে শীতলতার ছোঁয়া। স্কুলের বাচ্চারা মায়ের সাথে রিকশায় চলমান, ফুটপাতের পথশিশু পান্তার জন্য মায়ের আঁচল ধরে দন্ডায়মান। ডিসি হিলের বৃক্ষতলায় নানা বয়সী মানুষের বিলম্বিত ক্যালরি দমন। নিয়মিত দৃশ্য।
রাস্তায় তখনো যানজট শুরু হয়নি। রাইফেল ক্লাব ফেলে আরেকটু সামনে নিউমার্কেটের কাছে ফুটপাত বেদখল করে বসানো চৌকি দোকানগুলো এখনো শূন্য। রাস্তার মাঝখানে আইল্যান্ডে স্তুপ করে রাখা পুঁতিগন্ধময় ময়লার পাহাড়। সরকার বলে কিছু আছে? ডাষ্টবিনের জায়গায় দোকান, আইল্যান্ডের মাঝখানে ডাস্টবিন। তুলনা মিলবে না কোথাও। এটাও নিয়মিত দৃশ্য।
সময়টা গার্মেন্টস শ্রমিকদের। কর্মদিবসের শুরুতে দ্রুতপদে এগিয়ে চলা। ধাবমান পায়ের গতিতে ব্যস্ততা। বাংলাদেশ চলছে তাদের পায়ে পায়ে। ৫০ ডলারের পায়ে পায়ে বিলিয়ন ডলারের যোগফল। শিল্প এলাকার কাছাকাছি গিয়ে বাস-টেম্পুতে ঠাসাঠাসি মানুষ ট্রাফিক জ্যামে আটক। চোখ-মুখে বিলম্বিত কর্মপ্রবেশের উৎকন্ঠা। ইটের আধলা হাতে এক পাগলা রাস্তার এধার থেকে ওধারে ছুটছে আর বলছে "হে সাবধান, হে সাবধান......" এটা নিয়মিত দৃশ্য না।
তবে পাগলের সাবধান সংকেত আঘাত করে অন্য কোনখানে। অজানা উৎকন্ঠার হালকা কাঁপুনি ভেতরে। বাংলাদেশ কী ভালো আছে? স্বার্থপর আত্মমগ্নতার বাইরে এসে বোঝার চেষ্টা - বাংলাদেশের সমস্যা আমার নিজের সমস্যা আমার সমস্যা কিনা, অথবা আমার সমস্যা বাংলাদেশের সমস্যা কি না। সমীকরন মেলে না।
দরিদ্র বাংলাদেশের কতটুকু দারিদ্র দৃশ্যমান? চরম দারিদ্র কাহাকে বলে? বিশ্বব্যাংকের দারিদ্রের সংজ্ঞা আর বাংলাদেশের দারিদ্রের সংজ্ঞা কী এক? দৈনিক ১ ডলারেও অনেক খুশী বাংলাদেশের দরিদ্র। এমনকি সিকি ডলারেও বেঁচে থাকতে পারে বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষ। সেই সিকি ডলারের নীচে যাদের বসবাস, তাদের সংখ্যাও বাংলাদেশে বহু লক্ষ। বাজেটের বাইরে তাদের বসবাস, কেউ কেউ এমনকি গননারও বাইরে। সেই সব মানুষও বেঁচে আছে। তাহলে ভালো আছে বাংলাদেশ?
বাংলাদেশের খুব কাছের নিভৃতচারী দেশ ভুটান। দারিদ্রের সংজ্ঞাকে অর্থনীতির মাপকাঠির বাইরে আনতে সক্ষম হয়েছে এই একটিমাত্র দেশ। জাতীয় মোট আয়ের চেয়ে জাতীয় সামগ্রিক সুখকে প্রাধান্য দিয়েছে ভুটান। যার যা আছে তা নিয়ে সুখী হওয়া। বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের সাথে তার একটা মিল আছে। এদেশের দরিদ্র মানুষ খুব অল্পেই তুষ্ট। সে তুলনায় উচ্চবিত্তদের অতৃপ্তি লক্ষনীয়। উচ্চবিত্তদের বিত্ত টিকিয়ে রাখার কলা কৌশলের কাছে দরিদ্র মানুষ বারবার পরাজিত। বিত্তশালীদের উত্তরোত্তর সম্পদ বৃদ্ধির প্রতিযোগীতায় ধনী দরিদ্রের ব্যবধান দিন দিন বাড়ছে। চরম দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রার তুলনা করলে ভুটানের দরিদ্র বাংলাদেশের দরিদ্রের চেয়ে স্বচ্ছল। কিন্তু ধনবান শ্রেনীর তুলনা করলে দেখা যায় বাংলাদেশের ধনীদের জীবনযাত্রা আমেরিকার ধনীদের সাথে তুল্য।
বাংলাদেশে ধনী দরিদ্রের পার্থক্যের এই বিশাল ব্যবধান আমাদের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি সবখানেই প্রভাব বিস্তার করেছে। আমাদের গনতন্ত্রের অন্যতম দুর্বলতা ধনী-দরিদ্রের এই বিশাল ব্যবধান। এই দুর্বলতার কারনে দুষ্ট লোকেরা ভোটের রাজনীতির নিয়ন্ত্রন করছে খুব সহজে। কারন তারা জানে ক্ষুধা যখন প্রবল, নীতিবোধ তখন মৃত।
তাই নির্বাচন যত সুষ্টুই হোক, যত নিরপেক্ষই হোক, বাংলাদেশের সত্যিকারের গনতন্ত্রে উত্তরনের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীন। গনতন্ত্র বাংলাদেশে এখনো অনাগত এক অতিথি।
No comments:
Post a Comment