Sunday, November 2, 2008

সন্ত্রাসের মুখোমুখি একটা দিন

গত জানুয়ারীর শেষের দিকের কথা। সকালে অফিসে কাজ করছিলাম। হঠাৎ মোবাইলে রিং হতেই দেখি, বউয়ের নাম্বার।

স্বভাবমত দুষ্টুমি করে বললাম “হ্যালো ডার্লিং, রং নাম্বার থেকে বলছি। আজ রাতে কী তোমার স্বামী বাইরে ঘুমাবে? আমি কিন্তু ফ্রী, মাঝরাতে আসবো?”
“ফাজলামি রাখো, এক ভদ্রলোক টিএন্ডটির নাম্বারে লাইনে আছে, তোমার মোবাইল জানতে চাচ্ছে, দেবো?”
“নাম কি?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“নাম বললো কামাল”
“এই নামে তো কাউকে চিনি না। তোমার পুরোনো বয়ফ্রেন্ডদের কেউ না তো?” ঠাট্টার স্বরে বললাম।
“তোমার মাথা, দেবো কি না বলো।”
“আচ্ছা দাও” ভাবলাম হাউজিং প্রজেক্ট সংক্রান্ত কেউ হবে। ওরকম লোকই আমাকে খোঁজে বেশী।

দশ মিনিট পর। মোবাইলটা আবার বেজে উঠলো। তাকিয়ে দেখলাম অচেনা একটা নাম্বার। ভাবলাম, কে? ফোন রিসিভ করতেই অচেনা কন্ঠস্বর আমার নামটা বলে জানতে চাইল আমি সে-ই কি না। আমি বললাম, জী আমিই সে-ই। কন্ঠ বললো, একটু ধরুন বস্ আপনার সাথে কথা বলবে। আমি অবাক, বস্ কে?

নতুন একটা কন্ঠ ভারী গলায় বরিশাল অঞ্চলের টোনে কথা বলে উঠলো, “আসসালামু আলাইকুম। আমি আপনার একজন ভাই, আমার নাম তপন মালিথা। গরীবের জন্য কাজ করি। আপনাকে কিছু কথা বলবো, আপনি চুপ করে শুনে যাবেন, মাঝখানে কোন কথা বলবেন না। আর আমি যে আপনার সাথে কথা বলছি তা যেন আপনার পাশের কেউ না জানে। যদি জানে, তাইলে ভাই অসুবিধা হয়ে যাবে। আপনি কোথায় যাবেন আর আপনার পরিবার কোথায় যাবে আমি জানি না ভাই। আমরা আপনার সম্পর্কে সবকিছু জানি, সব খবর নিয়েছি। আপনার সাথে সাথে আমরা অনেকদিন ধরে আছি, কিন্তু কখনো বিরক্ত করি নাই। আমরা জানি আপনি ভাল মানুষ, গরীব দরদী। আজ এই ভাই বিশেষ প্রয়োজনে আপনার কাছে হাত পাতছে, আপনি ভাইয়ের হাত ফিরাইবেন না। কিন্তু ভাই কোন চালাকি করলে রক্তপাত হবে, আপনার বাসার সামনে আমাদের লোক দাড়িয়ে আছে। ফোনের লাইন কাটার চেষ্টা করবেন না তাহলে রক্তপাত হবে, লাশ পড়বে। যতক্ষন কথা বলছি ফোন ছাড়বেন না কাউকে কিছু ইংগিত দেবার চেষ্টা করবেন না।”

কী ঘটনা, বুঝলাম না। তপন মালিথা নামে কাউকে চিনিনা। চপল মালিথা নামে একজন কোন এক টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার। তার ভাইটাই না তো? চিন্তাটা বাতিল করে দিলাম তখুনি। কিন্তু এইসব শুনতে শুনতে বুঝতে বাকী রইলো না, একটা ঝামেলায় জড়িয়ে গেছি। মুখের ভেতর আঠা আঠা লাগছে। বাসার কথা ভাবলাম। বাসায় বউ, দেড় বছর বয়সের হাটি হাটি পা পা করা আমার মেয়ে আর মা আছে। বাসায় ফোন করা দরকার এখুনি। বাসাটা আমার একতলা, একাকী বাড়ী। বাবার তৈরী করা অনেক পুরোনো। দরজাগুলো নড়বড়ে হয়ে গেছে। তাছাড়া বড় রাস্তার একদম লাগোয়া। সম্ভাব্য আক্রমনের কথা ভেবে ঘেমে উঠলাম। ফোন রাখতে পারছি না বলছে রাখলে গুলি করবে বাসার যে কোন একজনকে। কথাটা বিশ্বাস করবো নাকি অবিশ্বাস করবো দ্রুত ভাবছি। কিন্তু ফলাফল শুন্য। জীবনে এমন পরিস্থিতিতে পড়ি নাই। আগে পত্রিকায় পড়তাম এসব। আজ বৃত্ত ছোট হয়ে আসতে আসতে আমাকেই ঘিরে দাড়িয়েছে।

মুখে বললাম, “কিন্তু ব্যাপারটা কি, খুলে বলেন। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

কন্ঠ বললো, ” আমরা পুর্ব বাংলা কমিউনিষ্ট পার্টির লোক। বাংলাদেশ র‌্যাবের সাথে বন্দুক যুদ্ধে আমাদের অনেক কর্মী আহত হয়। তাদের চিকিৎসার করার জন্য সবসময় অনেক টাকা লাগে। এই মুহুর্তে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় কর্মী ‘ময়না’ কোলকাতার হাসপাতালে মৃত্যূর সাথে লড়াই করছে। তার চিকিৎসার জন্য ২২ লাখ টাকা লাগবে। কিছুটা যোগাড় হয়েছে। আরো লাগবে। আপনি ভাই হিসেবে আমাদের কিছু দিবেন। ভাই বইলা আপনের কাছে হাত পাতছি ভাই, কিন্তু যদি কোন চালাকী করেন ভাই তাইলে আপনার মেয়ে কিডন্যাপ হয়ে যাবে, খুন হয়ে যাবে। পুলিশ টুলিশের কাছে গিয়ে কোন লাভ নাই। সবখানে আমাদের লোক আছে। আমার ‘ময়না’ যদি চিকিৎসার অভাবে মারা যায়, কেউ বাঁচাতে পারবে না আপনাকে। পুরো পরিবারকে জবাই করে ফেলা হবে। গতকাল মাঝরাতে আমরা আপনার বাড়ীর দেয়ালের ভেতর গিয়েও বাসায় ঢুকি নাই আপনেরে ভদ্রভাবে সুযোগ দেয়ার জন্য। এখন আপনি মানবতার জন্য দান করেন, আপনার কোন ক্ষতি হবে না।”

অনবরত কথা বলে চলছে এই লোক। ফোন ছাড়ছে না বা আমাকে চিন্তা করার সুযোগ দিচ্ছে না। নিদারুন মানসিক চাপে পড়লাম। কথাগুলো সত্যি মিথ্যা যাচাই করার জন্যও সময় দরকার। বারবার মনে পড়ছে, বাসাটা অরক্ষিত। স্ত্রী, দেড় বছরের শিশু কন্যা, মা ছাড়া কেউ নেই। বাইরের গেট বন্ধ থাকলেও দরজা প্রায়ই খোলা থাকে, পাড়ায় প্রায় স্থানীয় হওয়াতে কোনদিন ভয় পেতে হবে ভাবিনি। কিন্তু এই কন্ঠ যা বলছে তা যদি সত্যি হয়, তাহলে ঘটনা ঘটলে ঠেকানোর উপায় নেই। আমি অফিস থেকে পৌছাতে পৌছাতে অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে। গলার স্বর শুনে বুঝতে পারছি পেশাদার সন্ত্রাসী।

আমি বললাম, “ঠিক আছে ভাই আর্তমানবতার জন্য আমি কিছু দিবো। হাজারখানেক আছে আমার কাছে”

কন্ঠ বললো, “আমাদেরকে ফকির মিসকিন মনে করছেন ভাইজান? আমরা ঠাট্টা করছি না আপনার সাথে। আধাঘন্টা সময় দিলাম। এর মধ্যে মোটা অংকের টাকা যোগাড় করে দেবেন। বন্ধু-বান্ধব-কলিগ যেখান থেকে পারেন। কিন্তু দেরী করলে, উল্টাপাল্টা কিছু করলে রক্ত দেখবেন। কার রক্ত দেখবেন জানি না” আমার চোখে আমার মেয়ের ফুটফুটে চেহারা ভেসে উঠলো।

নরম সুরে বললাম, “ভাই আমি চাকুরীজীবি মানুষ। মোটা অংকের টাকা কোথা থেকে দেবো এখুনি। তবু আপনি যখন বলছেন ধার-কর্জ করে দশ হাজার পর্যন্ত হয়তো পারবো।”
কন্ঠ উত্তপ্ত স্বরে বললো, “মশকারী করেন নাকি আমাদের সাথে? আমাদের চিনেন নাই? লাশ পড়লে বুঝবেন। বাসার কাছাকাছি আছে আমার লোক। গুলি করে মশকারি ঢুকিয়ে দেবে।”

আমি তখন কিংকর্তব্যবিমুঢ়। এ সময় পাড়ায় পুরুষমানুষ থাকে না তেমন। ফোনও করতে পারছি না কোথাও। কারন ফোনের লাইন কাটলে গুলি করবে বাসায়। সত্যি করতো কি না জানি না, কিন্তু রিস্ক নিতে পারছি না। সবচেয়ে দরকার বাসায় একটা ফোন করে অন্ততঃ দরজা জানালাগুলো বন্ধ করানো। তারপর পুলিশ-র‌্যাবে খবর দেয়া। কিন্তু পুলিশ আসার আগেই ঘটনা ঘটে যাবে। বাংলাদেশের পুলিশের অবস্থা জানা আছে। হয়তো পুলিশও ম্যানেজ হয়ে বসে আছে। কি করবো বুঝতে পারছি না।

আমি একহাতে ওদের ফোনে রেখে অন্য হাতে টিএন্ডটির ফোনে হাত দিলাম। বাসায় ফোন করতেই বউ ধরলো। জিজ্ঞেস করলাম, কেউ এসেছিল বা কাউকে দেখেছে কিনা বাসার সামনে। বউ বললো, দেখেনি। আরো বললো, মা গেছে আমার ছোট বোনের বাসায়। দুপুরের পর আসবে। বাসায় ও এখন একা মেয়েকে নিয়ে। শুনে আরো নার্ভাস আমি। বললাম দরজা জানলা বন্ধ করে দিতে। হুমকির কথা বললাম আর আমি এখুনি বাসায় আসছি বলে জানালাম। ওদিকে মোবাইল কন্ঠ অবিরাম হুমকি দিয়ে চলছে, কথা অমান্য করলে কাকে কীভাবে জবাই করা হবে , কোথায় গুম করে ফেলা হবে, বাড়ীঘর জালিয়ে দেয়া হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। শুনতে ভালো লাগছিল না। আমি সাহস করে ‘ধুত’ বলে ফোনটা কেটে দিলাম। তারপর বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজনের কাছে ফোন করে খবরটা দিতে চাইলাম। কিন্তু না, আমার মোবাইলে অনবরত নানান নাম্বার থেকে ফোন আসা শুরু হলো। আমি কিছুতেই আউটগোয়িং কল করতে পারছি না। এই প্রথম কল ফ্লাডিং করে মোবাইল ব্লক করা দেখলাম। উপায় না দেখে তাড়াতাড়ি অন্য কলিগের মোবাইল ধার নিয়ে রওনা দিলাম বাসায়। বাসা একটু দুরে অফিস থেকে। পথে যেতে যেতে ফোন করছি বন্ধুবান্ধবের কাছে, বলছিলাম ঘটনার কথা। বাসার কাছে যারা আছে তাদের বললাম গিয়ে একটু খোজ নিতে, আবার ভয়ও হলো ওদেরকেও যদি গুলি করে।

কিছুদুর যাবার পর বউয়ের ফোন। কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, “তুমি কোথায়, কিছু লোক বাসায় ফোন করে বলছে ১২.০০টার মধ্যে মধ্যে নাকি তোমার লাশ বাসায় পৌছাবে।” বউ আরো বললো আমি যেন এখন বাসার দিকে না আসি, অন্য কোথাও চলে যাই। আমি বলি, “মাথা খারাপ, তোমাদের বিপদে রেখে আমি অন্য কোথাও যাবো? আসছি আমি।” আবার রওনা দিলাম। কিন্তু মাঝপথে আবার বউয়ের ফোন। বললো, বাসায় আত্মীয়-বন্ধুরা এসে পড়েছে। ওদেরকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিতে চেষ্টা করছে। কিন্তু সন্ত্রাসীরা বাইরে আছে। ঘরের সামনের রাস্তায় অচেনা সন্দেহজনক লোকজনের গতিবিধি দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় আমি ওখানে গেলে নিশ্চিত ধরা পড়তে হবে ওদের হাতে। আমার এক কাজিনও অনুরোধ করলো, আমি যেন অফিসেই ফিরে যাই। র‌্যাব-আর্মি কাজ শুরু করেছে, কিন্তু ওদের হাতে ধরা পড়ে গেলে সব ভেস্তে যাবে।

আবার মাঝপথ থেকে আমি আবার অফিসে ফিরে গেলাম। কিন্তু ফোনটা অনবরত বেজেই চলেছে। নানান নাম্বার থেকে। ধরছি না। আবার বন্ধও করতে পারছি না। কারন সবাই এই নাম্বারে যোগাযোগ করবে। তবে অচেনা ইনকামিং নম্বরগুলো টুকে রাখছি একে একে। সবগুলো দিলাম এক আত্মীয়কে যিনি যৌথ বাহিনীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। কয়েক ঘন্টা এই থ্রিলিং চলার কিছুক্ষন পর কাজিন ফোনে জানালো, আমার পরিবারকে নিরাপদে ওনার গাড়ীতে করে দুরে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আপাততঃ চিন্তার কিছু নেই। র‌্যাব আর যৌথবাহিনী নাম্বারগুলো নিয়ে কাজ করছে। গত ৫ ঘন্টায় এই প্রথম প্রানভরে পুরো একটা দম ফেললাম, আহ্। পরিবার নিরাপদ এখন। নিরাপত্তাবোধের অনাবিল আনন্দ। বুকে সাহস বেড়ে গেল বহুগুন। আয় শালারা লাগা এবার!

সন্ধ্যায় যৌথবাহিনীর এক কর্নেল দেখা করতে বললেন। সার্কিট হাউসে গেলাম। উনি বললেন, নাম্বারগুলোতে ফোন করে উনি কথা বলেছেন। আর্মি অফিসার পরিচয় দেবার পরও ওনার সাথে জঘন্য দুর্ব্যবহার করেছে ওরা। খুব ডেসপারেট গ্রুপ বোঝা যায়। বললেন, “আপাততঃ আপনার প্রধান কাজ হলো, ওদের কাছে ধরা না পড়া। অফিস, বাসা আর নিজের পরিচিত জায়গাগুলো থেকে সরে থাকা কয়েকদিন। থানা পুলিশের কাছেও যাবার দরকার নেই আপনার। যা কিছু করার আমিই করবো।”

প্রায় এক সপ্তাহ অন্য জায়গায় আত্মীয়ের বাসায় ছিলাম সবাই। পরে নতুন জায়গায় বাসা বদলে ফেলি। র‌্যাব-যৌথ বাহিনী কাজ শুরু করার পর সন্ত্রাসীরাও গা ঢাকা দেয়। অনেকদিন পর একদিন পত্রিকার হেডিং দেখলাম, তপন মালিথা ওরফে দাদা তপন ক্রসফায়ারে মারা গেছে। মনে পড়লো, আরে এই নামেই তো হুমকি দিয়েছিল। ফোনে চাঁদা আদায় করার গডফাদার। দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক ছিল তার। এমনকি বাচ্চা ছেলেরাও তার সন্ত্রাসী গ্রুপে কাজ করে।

আজ জানার উপায় নেই সেদিন আমার পিছু নিয়েছিল সত্যিই দাদা তপন, নাকি তার কোন সাগরেদ। কীভাবে আমার নাম ওদের কাছে গিয়েছে তাও জানিনা। হয়তো কোথাও ভুল হয়েছে হিসেবে। কারন তাদের ক্ষুধা মেঠাবার মতো অর্থ আমার নেই। ওদের চোখে পড়ার মতো এমন কিছু নেই আমার। সাদাসিদে জীবনযাপন করি। তবু উপলব্ধি করেছি এই দেশে বাস করতে হলে কোন কোন দিন এসবের মুখোমুখি দাড়াতে হবে। পুরো দেশেইতো সন্ত্রাসের সদর্প আনাগোনা।

নগরে আগুন লাগলে দেবালয়ও অক্ষত থাকে না। ভুলি না সে কথা।

No comments: