একজন সাধারন নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানতম নেতাদের যেভাবে দেখেছি, সে স্মৃতির সংক্ষেপিত বর্ননা।
শেখ মুজিবুর রহমান
১৯৭৪ বা ১৯৭৫ সাল হবে। এক সকালবেলা বাবা আমাকে নিয়ে বেরুলেন। বললেন, আজ শেখ মুজিব আসবে, চল দেখে আসি। কলোনী ছেড়ে আগ্রাবাদের বড় রাস্তায় এসে দেখি লোকে লোকারন্য। আমি পেছনে পড়ে যাওয়ায় রাস্তার কিছুই দেখছিলাম না। সামনে সাদা শার্ট আর পান্জাবী পড়া লোকজন। হঠাৎ একটা শোরগোল। হুইসেলের শব্দ। আমি লোকজনের পায়ের ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করছি। কিন্তু সুবিধা হলো না। আমি বাবার আঙুল ধরে টান দিলাম মনোযোগ আকর্ষন করার জন্য। বাবা কি ভেবে আমাকে চট করে কাঁধের ওপর নিয়ে নিলেন। সামনে একটা উঁচু বাঁশের মঞ্চ। সেখান থেকে মাইকে গম গম শব্দ ভেসে এলো। দেখলাম সাদা পান্জাবী পরা দীর্ঘ চওড়া একটা মানুষের অবয়ব মঞ্চের ওপর। বাবা বললেন ইনিই শেখ মুজিবুর রহমান। আমি অপলক চেয়ে রইলাম কয়েক মিনিট। মহান শব্দটা বললে এখনও সেই সাদা অবয়বটা কেন যেন ভেসে ওঠে আমার চোখে।
জিয়াউর রহমান
১৯৭৯-৮০ সাল হবে বোধহয়। জিয়াউর রহমান তখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। একদিন আমরা স্কুলে ক্লাস করছি। আগ্রাবাদ সরকারী কলোনী হাই স্কুল। হঠাৎ স্কুলের গেট পেরিয়ে সেনাবাহিনীর কয়েকটা জীপ ঢুকলো। কয়েকজন সেনা অফিসার জীপ থেকে লাফিয়ে নামলো । একজনের চোখে কালো চশমা। হাতে ছোট একটা লাঠি। দৃঢ় পায়ে এগিয়ে আসছে স্কুল বিল্ডিংয়ের ভেতর। হুলস্থুল পড়ে গেল পুরো স্কুলে। কিছুক্ষনের মধ্যে জেনে গেলাম উনি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। রোমাঞ্চিত রীতিমতো। জিয়ার প্রেমে পড়ে গেলাম সেদিন থেকে।
হু. মু. এরশাদ
৮৬-৮৭ সালের দিকে কথা। চট্টগ্রামের নামকরা এক মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে নিয়ে গেছেন এক মুরব্বী। মসজিদ মাঠ সব লোকে লোকারন্য। কী একটা ধর্মীয় অনুষ্টান ছিল বোধহয়। ভেতরে জায়গা না পেয়ে গেইটের বাইরে রাস্তায় কোনমতে একটা জায়গা নিয়ে বসলাম। নামাজের খোতবা চলছে এমন সময় কাছেই খুব ধাক্কাধাক্কি চলছে দেখলাম। মারামারি লাগলো নাকি। মসজিদে জায়গা পাওয়া নিয়ে হাতাহাতি সাধারন ব্যাপার। কয়েকজন হৈ হৈ করে জানান দিল এরশাদ এসেছে, নামাজ পড়বে এখানে। তখন এরশাদের মসজিদ ভন্ডামির কাল। প্রায়ই মসজিদ স্বপ্নে দেখতো আর হঠাৎ নামাজ পড়তে চলে আসতো। হঠাৎ দেখি এরশাদের লোকজন পথ করে নিয়ে আসছে সোজা আমার দিকে মানে গেটের দিকে, আমাকে প্রায় মাড়িয়ে দেয় আরকি। আমি ঝট করে উঠে দাঁড়ালাম। দাঁড়াতে গিয়ে এরশাদের পেটের সাথে আমার কনু্ইর হালকা ধাক্কা লাগে। দেখতে দেখতে ফর্সা কপাল কুঁচকানো চেহারাটা এগিয়ে গেল ভিড় ঠেলে সামনের দিকে। পরে বাসায় এসে চাপা মেরেছিলাম, স্বৈরাচার এরশাদকে আমি কনুইয়ের গুঁতো দিয়েছি আজ।
খালেদা জিয়া
১৯৮৯ সালের কথা। এরশাদের শেষের দিক প্রায়। খালেদা হাসিনার ঐক্য প্রক্রিয়া তখনো পুর্নতা পায়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় বন্ধ থাকতো নানান হাঙ্গামায়। আমরা প্রতিদিন কলোনীর মাঠের কোনে একটা ঝাঁকড়া গাছের নীচে বসে আড্ডা দিতাম। সকাল-বিকাল-রাত। সেদিন দুপুর বেলা অনেকগুলো গাড়ীর শব্দ ভেসে এল দুর থেকে। তাকিয়ে দেখি একটা শোভাযাত্রার মতো আসছে। সামনে মোটর সাইকেল, তারপরে বেশ কয়েকটা কার, জীপ ইত্যাদি। আমরা দেখানে বসেছিলাম তার শ'খানেক গজ দুরে এসে শোভাযাত্রাটা থামল। গাড়ী থেকে নামলো লম্বা-ফর্সা এক মহিলা। দৌড়ে গেলাম। কে এই সুন্দরী মহিলা। কাছে যেতে না যেতেই উনি সামনের এক বাসায় ঢুকে গেল। ছাত্রদলের নাজিম ভাইয়ের বাসা ওটা। নাজিম ভাইকে কয়েকদিন আগে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা বেদম পিটিয়েছে। জানলাম যিনি দেখতে এসেছেন উনি খালেদা জিয়া। অবাক হয়ে গিয়েছিলাম এমন সৌম্য সুন্দর ব্যক্তিত্ব দেখে। সেদিন থেকে নাজিম ভাইয়ের জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল। আর ঘুরেছিল সৌন্দর্যে মুগ্ধ আমার কয়েক বন্ধুর রাজনৈতিক মোড়।
শেখ হাসিনা
১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হবার পর চট্টগ্রামে সার্কিট হাউসে ব্যবসায়ী ও সুধী সমাজের সাথে প্রধানমন্ত্রীর কুশল বিনিময়ের একটা আয়োজন করা হয়। প্রত্যেক কোম্পানীর জন্য একটা করে আমন্ত্রনপত্র আর গাড়ির নিরাপত্তা পাশ দেয়া হয়। আমার কোম্পানী থেকে আমাকে নির্বাচিত করা হয় যোগ দেয়ার জন্য। পৌঁছে দেখি সব রুই-কাতলার মেলা। আমি একা পুঁটি মাছ। একপাশে জড়সড় হয়ে বসে আছি। অনেকক্ষন পর শেখ হাসিনা এলেন, পরনে সুতীর শাড়ি। সবার সাথে ঠাট্টা মশকারী করলেন স্বভাবমতন, সৌজন্য আলাপ। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে মেলানোর চেষ্টা করলাম মহান নেতার সাথে। চেহারায় বেশ মিল থাকলেও তেমন মিল পেলাম না ব্যক্তিত্বে। তবু কথা শুনে আমরা হাততালি দিলাম মুগ্ধ শ্রোতার মতো। তারপর খেয়ে বিদায় হলেম সবার আগে।
No comments:
Post a Comment