বয়েস তখন বিশের কোটায়। আমার এক বন্ধু পারভেজ। কথাবার্তায় খুব দুষ্টু। ওর প্রতিটি বাক্য একেকটা কৌতুক, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তে হয়। ওকে কেউ কিছু বলে সারতে পারে না, তাৎক্ষনিক জবাব রেডী, একটা কথাও মাটিতে পড়তে দেয় না। ফলে সবার প্রিয় ছিল আর বন্ধুবান্ধবও ছিল অগনিত।
ওর বাসাটা ছিল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে প্রিয় আড্ডাখানা। ওর বাবা মা ভাই বোন এত আন্তরিক ছিল যে আমরা ওটাকে নিজের ঘরের মতো ব্যবহার করতে পারতাম। ওর রান্নাঘরে ঢুকে ডেকচি উল্টিয়ে মাছ তরকারী নিয়ে খাচ্ছি এটা খুব স্বাভাবিক একটা দৃশ্য ছিল। খাওয়া ঘুম আডডা সব চলতো, কেউ কেউ রাতেও থেকে যেতো বেশী দেরী হয়ে গেলে। পাড়ায় আমাদের ১৬ জনের একটা ম্যারাথন আড্ডা গ্রুপ ছিল। তাছাড়া অতিথি আড্ডাবাজরাও প্রতিদিন আসতো শহরের কোন না কোন অংশ থেকে।
এত বেশী বন্ধুবান্ধব ওর বিয়ের দাওয়াতের সময় একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দাওয়াতের লিষ্টে বন্ধুর সংখ্যা একশ ছাড়িয়ে যাওয়াতে ইচ্ছাকৃতভাবে অনেক দুরের বন্ধুকে বাদ দিতে হয়। মজার ব্যাপার হলো বিয়ের দিন বিনা দাওয়াতেই প্রায় অর্ধশত বন্ধু এসে হাজির। এবং দাওয়াত না দেয়াতে কেউ কোন মাইন্ড করে নাই। বরং বলছিল, তুই দাওয়াত দিতে ভুলে গেছিস সেটা আমরা বুঝি, কিন্তু আমাদের তো একটা দায়িত্ব আছে !
পাড়াতে বেশ কয়েকজন কট্টর শিবির কর্মী ছিল। শিবিরের অতি তৎপর একটা দায়িত্ব হলো মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া। একবার দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে এলাকার শীর্ষ শিবির নেতা কামাল ভাই আড্ডায় আসলেন। মোলায়েম ভাষায় ‘আসসালামুআলাইকুম’ বলে বসে গেলেন একপাশে। উনি মাবুর পরিচিতি সুত্রে এসেছেন দাওয়াতী কাজে। কিন্তু এখানে ঢুকেই পড়ে গেলেন পারভেজের পাল্লায়। আম্বো তাম্বো গল্পের ঠেলায় দুদিনের মাথায় দ্বীনের দাওয়াত ভুলিয়ে দিল পারভেজ। এক সপ্তাহ পর দেখা গেল কামাল ভাইও মেয়েদের ‘ঠেকা’ দেয়ার পদ্ধতি নিয়ে জমিয়ে আলাপ করছে। দ্বীনের দাওয়াতের কোন খবর নেই আর।
আমাদের আড্ডার একটা বৈশিষ্ট্য ছিল মাঝে মাঝে একেকজনের উপর ভর করে পাড়ার হোটেলে পরোটা, চপ, হালিম ইত্যাদির শ্রাদ্ধ করা। একবার কামাল ভাইয়ের পালা এলো। সহজে রাজী হয় না। শুনেছিলাম হাড় কন্জুস। তবু প্রথমে লজ্জায় ‘হ্যাঁ’ বলে রাজী হলেও রওনা দেয়ার পর যতই হোটেলের কাছাকাছি হচ্ছিলেন ওনার পা যেন ভারী হয়ে উঠছিল। হোটেলের ১০০ গজের মধ্যে পৌছে পুরো শক্ত হয়ে গেল কদমযুগল, আর নড়ে না। ব্যাপার কী? কামাল ভাইকে জিজ্ঞেস করা হলো। কামাল ভাই মিন মিন করে বললেন “একটু বাসায় যেতে হবে যে। মানিব্যাগটা ফেলে এসেছি বোধহয়।”
চেহারা দেখে সন্দেহ করলাম পালানোর ফন্দী করছে। এভাবে ছাড়া যাবে না। আমরা দ্রুত বললাম সাথে যা আছে তাতেই চলবে, ৫০ টাকা এমনকি ২০ টাকা হলেও চলবে, বাকীটা আমরা দেবো, দরকার হলে লোন দেব। কিন্তু তিনি অনড়। আমরা লক্ষন বুঝে দুজন দুহাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে চাইলাম। কিন্তু নড়ানো গেলনা। ছাগলের মতো পা দুটি মাটি কামড়ে আটকে রইল। যতই সামনে টানি ছাগলের মতো উনি উল্টা দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। (ওনার পরে আরো দুজন শিবির নেতা আমাদের আড্ডায় যোগ দিয়েছিল, প্রত্যেকটা হাড় কন্জুস এবং প্রত্যেকের সাথে খাওয়ার পর্বে এসে প্রায় একই অভিজ্ঞতা। হোটেলের কাছাকাছি এলেই নড়ানো যেত না, পায়ে খুটা লেগে যেত। যারা জীবনে একবারও ছাগলের দড়ি হাতে নিয়েছে তারা জানে ছাগলের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দড়ি যেদিকে টানবেন তার উল্টা দিকে হাঁটবে সে।)
কামাল ভাইকে ছাগলের মতো খুটা পায়ে আটকে থাকা দেখে তখুনি পারভেজ এগিয়ে এসে বললো, “দুর ব্যাটা, তোরা তো ছাগল ধরাও শিখলি না। কিভাবে নিতে হয় জানিস না। বাবু আয়তো, তুই বাম পাটা ধর আমি ডান পা ধরি। ত্যাড়া ছাগলকে চ্যাংদোলা করে নিতে হয় ” তিন সেকেন্ডের মধ্যেই চার জোড়া হাতের উপর কামাল ভাই ভাসতে লাগলেন।
সেই আট হাতের দোলনায় কামাল ভাই যখন হোটেলের সামনে পৌছালো, লোকজন বুঝে গেছে আজকের হোষ্ট কে। খাওয়া শেষে কামাল ভাই বেজার মুখে অন্তর্বাসের ভেতর থেকে লুকানো ছোট্ট মানিব্যাগ বের করলো। সেদিনের পর থেকে আড্ডায় যাওয়া কমিয়ে দিলেন তিনি। বুঝলেন দুনিয়াতে ফ্রী বলতে কিচ্ছু নাই। এমনকি আড্ডাও না। সেদিন থেকে প্রকাশ্যে দাওয়াতী কাজের সমাপ্তি ঘটলো পাড়ায়।
No comments:
Post a Comment