আমি ভালো আছি৷ রাতভর সুখের অনিদ্রা বাদে সব ঠিক৷ দিব্যি খাই দাই পড়ি লিখি কাজ করি দিন কেটে যায়৷
অথচ বলা হচ্ছে ভালো নেই৷ আরো ডাক্তার আরো নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে হাজির হতে হবে৷ শেষ রাতের ঘুমে মিনিটে একবার কেঁপে ওঠা হৃদযন্ত্রের প্রেমময় চুম্বন বলে অনুমিত হচ্ছে৷
এখনো কত কী করার বাকী! কত কী দেখার রয়ে গেছে! চট্টগ্রামের ভৌগলিক ইতিহাস নিয়ে কাজটা মাত্র শুরু করেছি৷ কত সময় দরকার আরো! আসলে এইসব আধুনিক চিকিৎসা প্রতিক্রিয়া মানুষকে কেমন অচল করে দেবার চেষ্টা করে ! তার চেয়ে হাওয়া বদল ঢের ভালো৷
রাতে অনিদ্রা সময়ে চোখ বন্ধ করে একটা খড়ের চালের ঘরে চলে যাই৷ গুটিশুটি একা শুয়ে থাকি খড়ের বিছানার ওমে৷ চারিদিকে শুধু সোনালী খড়ের মেলা৷ ধান শুকানো উঠোনের ঘ্রাণে ভেসে যায় পৃথিবীর সম মেলা৷ কোথাও কেউ নেই, কোন শব্দ নেই৷ যাবতীয় সবকিছু থেকে মুক্ত আমি৷ আছে শুধু অনন্ত শান্তির নির্মল স্পর্শ৷
এরকম কোন একটা সময়েই কী জীবননান্দ লিখেছিলেন-
গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার;
তাকিয়ে দেখলাম পান্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া
গুটিয়ে নিয়েছে যেন
কীর্তিনাশার দিকে।
ধানসিঁড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম পউষের রাতে-
কোনোদিন আর জাগব না জেনে
কোনোদিন জাগব না আমি কোনোদিন জাগব না আর-
হে নীল কস্তুরী আভার চাঁদ
তুমি দিনের আলো নও, স্বপ্ন নও,
হৃদয়ে যে মৃত্যুর শান্তি ও স্থিরতা রয়েছে,
রয়েছে যে অগাধ ঘুম
সে-আস্বাদ নষ্ট করবার মতো শেলতীব্রতা তোমার নেই,
তুমি প্রদাহ প্রবহমান যন্ত্রণা নও-
জানো না কি চাঁদ
জানো না কি নিশীথে,
আমি অনেক দিন-
অনেক অনেক দিন
অন্ধকারের সারাৎসারে অন্তত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে
হঠাৎ ভোরের আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব বলে
বুঝতে পেরেছি আবার;
ভয় পেয়েছি,
পেয়েছি অসীম দুর্নিবার বেদনা;
দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে
মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য
আমাকে নির্দেশ দিয়েছে;
আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায় বেদনায় আক্রোশে ভরে গিয়েছে;
সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি কোটি শুয়োরের আর্তনাদে
উৎসব শুরু করেছে।
হায়, উৎসব!
হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে
আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি,
অন্ধকারের স্তনের যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে
থাকতে চেয়েছি।
কোনোদিন মানুষ ছিলাম না আমি।
হে নর, হে নারী।
তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনোদিন;
আমি অন্য কোনো নক্ষত্রের জীব নই।
যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গতি, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ
সেখানেই সূর্য, পৃথিবীর, বৃহস্পতি, কালপুরুষ, অনন্ত আকাশগ্রন্থি,
শত শত শূকরের চিৎকার সেখানে,
শত শত শূকরীর প্রসব বেদনার আড়ম্বর;
এই সব ভয়াবহ আরতি!
গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;
আমাকে কেন জাগাতে চাও?
হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া
আমাকে জাগাতে চাও কেন।
অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠব না আর;
তাকিয়ে দেখব না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর থেকে
অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে
কীর্তিনাশার দিকে।
ধানসিঁড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকব-ধীরে-পউষের রাতে।
কোনদিন জাগব না জেনে-
কোনোদিন জাগব না আমি-কোনোদিন আর।
................................................................
(অন্ধকার - জীবননান্দ দাশ