Sunday, April 17, 2016

শাহীন আখতারের 'ময়ূর সিংহাসন' পাঠ শেষে ভাবনাগুলো

ইতিহাসের প্রতি একটি ঐতিহাসিক উপন্যাসের দায়িত্ব কতটুকু? প্রশ্নটি প্রতিবারই খোঁচা দেয় যখন কোন ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়তে বসি। ইতিহাসের প্রতি আমার অল্পবিস্তর আগ্রহ আছে সে কারণে ওই বিষয়ে তাত্ত্বিক লেখার বাইরে পছন্দসই ফিকশন পেলেও পড়ার চেষ্টা করি। পাঠক হিসেবে আমি খুব বেশী ক্রিটিক্যাল না, ভাষার ঝলমল আলোটা যদি ভালো লাগে গড়গড় করে পড়ে ফেলি।

তবে ঐতিহাসিক উপন্যাস জাতীয় কিছু পড়তে গেলে বারবার 'সত্য' এসে জিজ্ঞেস করে, তাতে সে কতটুকু উপস্থিত আছে?

সম্প্রতি পড়লাম শাহীন আখতারের 'ময়ূর সিংহাসন'। বইটির মূল উপজীব্য বিষয় আওরঙ্গজেবের ভয়ে শাহ সুজার আরাকান পলায়ন এবং আরাকান রাজার হাতে সপরিবারে করুণ পরিণতি বরণ। বইটিতে কথক হিসেবে একাধিক চরিত্র আছেন যাদের মুখে আমরা সম্পূর্ণ উপন্যাসের ঘটনাগুলো শুনি। সেই চরিত্রসমূহের কিছু বাস্তব কিছু কাল্পনিক। কথকদের সবগুলো গল্প সত্যি না, ইতিহাসের সাথে গল্প মিশিয়ে পরিবেশিত হয়েছে সম্পূর্ণ উপন্যাসটি।

সব ঐতিহাসিক উপন্যাসকে এই কাজটি করতেই হয়। কেননা ইতিহাসে শুধু ঘটনা থাকে, কোন গল্প থাকে না। ইতিহাস থেকে ফ্রেমটা ধার নিয়ে তার খোপে খোপে গল্প বসিয়ে সম্পূর্ণ ছবিটা শেষ করতে হয়। যদি গল্পগুলো সেই ফ্রেমের বাইরে চলে না যায় তাহলে আমরা বলি উপন্যাসটি বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে। আবার যদি গল্পগুলো বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা না যায়, তখন আমরা বলি উপন্যাসটি ব্যর্থ হয়েছে। একশো ভাগ সফল ঐতিহাসিক উপন্যাসের নজীর পৃথিবীতে খুব কমই আছে। কোন না কোন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সমালোচনার অবকাশ থাকেই। সেটা সিনেমা হোক বা উপন্যাস হোক।

এই উপন্যাসটি পড়তে আমার সমস্যা হয়নি। পড়া শেষ করে বলতে পেরেছি, বাহ বেশ একটা আনন্দ পাঠ হয়ে গেল। প্রধানতঃ তিনটি কারণে আমার ভালো লেগেছে বইটি।

প্রথম কারণ, এর কথক চরিত্রদের গল্প বলার ধরণটা আকর্ষণীয়। ছোট ছোট পর্বে সাজানো গল্পগুলো প্রতিটি আলাদা আলাদা চরিত্রের মুখে হলেও সমন্বয়হীন মনে হয়নি তেমন কোথাও।

দ্বিতীয় কারণ, মোগলদের ভাইবেরাদরের ঝগড়াঝাটি বিষয়ে ইতিহাস বইয়ের কাঠখোট্টা আলোচনায় যা বুঝতে পারিনি, এই বইটি তা জলের মতো পরিষ্কার করে দিয়েছে।

তৃতীয় কারণ, বইটিতে বানোয়াট কোন ইতিহাস প্রবিষ্ট করানো হয়নি বলে মনে হয়েছে। ইতিহাসের ফাঁকগুলো যথাযথ গল্প দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। গল্পগুলোর মান নিয়ে হয়তো প্রশ্ন উঠতে পারে। তা উঠুক কিন্তু বইটিতে আমি Infotainment (এর সঠিক বাংলা কী আমি জানি না) ব্যাপারটাই সবচেয়ে বেশী উপভোগ করেছি। গল্পের ভেতর দিয়ে ইতিহাস পড়ে নেয়া যেন।

শেষ অংশে শাহসুজার পরিণতি বিষয়ে ইতিপূর্বে কিছু পড়া থাকলেও এই বইটি পড়ার পর কিছুটা ক্রস রেফারেন্স হিসেবে আরো কিছু পড়াশোনা করেছি যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সপ্তদশ শতকের ফরাসী পরিব্রাজক বার্নিয়ের এবং ইতালীয় নাগরিক নিকোলো মানুচ্চির বিবরণ। এই দুজনই ওই সময়কালে মোগল সম্রাটের চাকরী করেছেন এবং অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। সেই বিবরণ অনুযায়ী উপন্যাসের আরাকান পর্বটি মোটামুটি সমন্বিত বলা চলে। যদিও ওই সময়কালের অনেক ঘটনা ধোঁয়াশা আর গুজবে পরিপূর্ণ। সেই ধোঁয়াশার মধ্যে সত্যমিথ্যা যাচাই করা খুবই কঠিন কাজ। তবু গুরুতর কোন তথ্য বিচ্যুতি ঘটেনি বলে এই অংশটি খুব বেশী অবিশ্বাস্য মনে হয়নি।

তবে শেষমেষ মনে রাখতেই হয় এটি একটি ফিকশন বা উপন্যাসই। যারা উপন্যাসে ইতিহাসের উপাত্ত অনুসন্ধান করেন এই বই তাদের না পড়াই ভালো।

সুতরাং শুরুতে করা প্রশ্নের উত্তরটি লিখি এবার। এই বইটি কি ঐতিহাসিক উপন্যাসের শর্ত পালন করেছে? সবগুলো হয়তো করেনি। কিন্তু যেটুকু করেছে পাঠক হিসেবে আমার কাছে যথেষ্ট মনে হয়েছে। তাই মোগল ইতিহাস নিয়ে, শাহ সুজার আরাকান পরিণতি নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে, সেই সব সাধারণ পাঠকদের বইটি পড়তে বলবো।

No comments: