Thursday, December 20, 2012
সংরক্ষণ-১
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/47253
লেখাটা গোছালো হয়নি যদিও, কিন্তু মূল বক্তব্যটার সাথে আমি একমত। সাথে উপরি পাওনা মন্তব্যগুলো। সংরক্ষণের জন্য লেখাটা এখানে এনে রাখলাম।
Wednesday, December 19, 2012
অসমাপ্ত বৃত্ত
মানুষের জীবনে ধারাবাহিকতা থাকাটা কি আবশ্যক? অথবা ধারাবাহিকতা কি স্বাভাবিক বিষয়? সিনেমায় দেখা নায়কের চরিত্রগুলো সম্পর্কে আমরা জানি ছেলেবেলা থেকেই যে ছেলেটা সুবোধ মানবিক দর্শনীয়, বড় হয়ে সেই ছেলেটিই সিনেমার মধ্যমনি। আর যে দুষ্ট ছেলেটি ছেলেবেলায় স্কুলের বন্ধুদের মেরে রক্তাক্ত করতো, বড় হয়ে সে ভিলেনই হয়। উপন্যাসেও একই জিনিস দেখি। নায়কের মধ্যে শুধুই সাধুতা, ভিলেনের মধ্যে কেবলই মন্দতা। ফরমূলাতে সীমাবদ্ধ। জীবন কি তেমন ধারাবাহিক নিয়ম মানে? কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে জীবনে ধারাবাহিকতার স্থান নেই। জীবন হলো একটা ওলট পালট সিনেমার স্ক্রিপ্ট। যেখানে একই মানুষের জীবনে অনেক মানুষের গল্প। যেখানে একই মানুষকে ঘিরে রচনা হতে পারে একাধিক উপন্যাস। একই মানুষ কখনো নায়ক, কখনো ভিলেন, কখনো চরম অকাল কুষ্মাণ্ড। যে মানুষটা বাজারে গিয়ে স্মার্ট, সে মানুষ অফিসে ভোদাই। যে মানুষ বন্ধুদের সাথে ধূর্ত শেয়াল, সেই মানুষ বউয়ের কাছে ভেজা বেড়াল। এমনকি একই সময়েই একটা মানুষ কয়েক রকমের জীবন যাপন করে।
মিনহাজকে তো চিনেছেন। সেই যে ঘর পালানো ছেলেটি। মায়ের সাথে ঝগড়া করে বন্ধুর বাড়িতে তিনদিন লুকিয়ে থেকে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। ঘুষখোর বাবার থেকে ২০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায় করে তারপর ঘরে ফিরেছিল সে। সেই ছিল তার শুরু। বাবার উপর প্রতিশোধ নেয়া। বাবা লোকটা ভালো ছিল না। সবার বাবা ভালো হয় না। তার বাবা তাস খেলে, মদ খায়, ক্লাবে গিয়ে টাকা ওড়ায়, বাড়িতে এসে মাকে পেটায়, এরকম আরো নানান কুকীর্তির সাথে জড়িত। বড় হতে হতে সব জেনে গেছে মিনহাজ। ছেলেবেলায় যে বাবাকে মিনহাজের নায়ক মনে হতো, বড় হতে হতে লোকটা হয়ে গেল ভিলেন। বাবার এই পরিবর্তন মিনহাজকেও পরিবর্তিত করতে শুরু করে।
ছেলেবেলায় মিনহাজ খুব দুষ্টামি করলে মা প্রচণ্ড রাগ করে বলতো, "তোর বাবার মতো হচ্ছিস? খবরদার সেরকম দেখলে আমি তোকে লাথি দিয়ে বের করে দেবো! শুয়োরের ঘরে শুয়োরের বাচ্চা হয়েছে!" মায়ের মুখ খুব খারাপ হয়ে যায় রেগে গেলে।
মিনহাজের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল বাবার মতো হওয়া যাবে না। তাই সে ভালো হবার চেষ্টা করে। নলিনী স্যারের কাছে প্রাইভেটে বীজগণিত পাটিগণিত বাংলা ইংরেজী গ্রামার মুখস্ত করে যখন মেট্রিকে হায়ার সেকেন্ড ডিভিশন পেল তখন সত্যি সত্যি মনে হলো সে বাবার চেয়ে ভালো কিছু হতে যাচ্ছে। সে ইংরেজি শেখার জন্য TOEFL বই কিনে পড়তে শুরু করে, ভর্তি হয় YMCA স্পিকিং কোর্সে। কলেজে পড়ার সময় শিক্ষার গতিবেগ যতটা হওয়া দরকার তার চেয়ে বেশীই ছিল।
কিন্তু একদিন বাসায় ফিরে দেখলো বাবা স্যাণ্ডেল দিয়ে মাকে বেধড়ক পেটাচ্ছে আর অকথ্য গালি বিনিময় হচ্ছে দুই পক্ষ থেকে। মায়ের মুখেও এসব শব্দ সে কল্পনা করেনি। সে গিয়ে থামাতে চাইলে কোন পক্ষই থামলো না। তারপর সে ডাইনিং টেবিল থেকে কাঁচের জগটা তুলে দেয়ালে ছুঁড়ে দিয়ে কিচেন থেকে দা নিয়ে ডাইনিং টেবিলে কোপাতে শুরু করলো তীব্র চীৎকার দিয়ে। খুন চেপে গেছে তার মাথায়। এবং সাথে সাথে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলো। বাবা ওর দিকে রক্তচক্ষু মেলে তাকিয়ে দরোজা খুলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। মা অনিশ্চিত দৃষ্টিতে মিনহাজের দিকে তাকিয়ে নিরুপন করার চেষ্টা করলো সে কোন পক্ষের হয়ে হুংকার দিল। কিন্তু মিনহাজ আজ কারো পক্ষে না। গোটা দুনিয়ার উপরই তার বিরক্তি চলে এসেছে।
সেদিন থেকে বাবার মতো হবে না, এই প্রতিজ্ঞার বিপরীত দিকে যাত্রা শুরু হলো তার। ফেন্সিডিল বন্ধুর অভাব ছিলনা, ছিল না গাজা চরস হেরোইন বন্ধুরও। সাথে যোগ হলো খারাপ পাড়ায় যাতায়াত। ইন্টার পরীক্ষার আগে বই খুলে লেখা যায় তেমন একটা কলেজে গিয়ে ভর্তি হলো। কোনমতে পাশ করলো। আর পড়ার ইচ্ছে নেই তার। পড়াশোনার ইতি সেখানেই। তারপর বছরের পর বছর আরো গভীর অন্ধকারে ঢুকে যেতে থাকলো ক্রমশঃ। সেই অন্ধকারের একজনের হাত ধরে সে একদিন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। শুধু ঘর নয়, তার পরিচিত সমাজের গণ্ডী ছেড়েও অনেক দূরে কোথাও চলে গেল। তাকে আর কখনো দেখা যায়নি এলাকায়। হালিশহরের মিনহাজ অধ্যায় ওখানেই শেষ হলো। কিন্তু তার নষ্ট হবার কাহিনীটা আরো কয়েক মাস মুখে মুখে থাকলো। একসময় তাও মিলিয়ে গেল।
২.
রিভারসাইড ক্লাবটা খুব সুন্দর। পদ্মা অয়েল কোম্পানীর গুপ্তখাল ডিপোর পাশে যে অফিসার্স কলোনী, সেখানেই ক্লাবটির অবস্থান। সবুজে ছাওয়া এলাকা। পতেঙ্গা রোডের তেলের গন্ধ পেরিয়ে ডানদিকের লোহার গেটের মধ্যে ঢুকলেই হঠাৎ একটুকরো স্বর্গের মতো মনে হয় এলাকাটিকে। বামদিকে টাইলসের সারিবদ্ধ বাংলো, ডানদিকে ছোটখাট একটা লেক বা পুকুর, লেকের ওপাশেই ক্লাবঘর, একটা সুন্দর কাঠের সেতু পেরিয়ে ওপাশে যেতে হয়। ছায়াময় কাঠের সেতুটাতে দাড়ালে নদীর বাতাসে জুড়িয়ে যায় শরীর মন। লেকের মধ্যে ফুটে আছে সাদা গোলাপী শাপলা। ছোটাছুটি করছে মাছের দল, লেকের চারপাশে ঘন গাছে ছাওয়া। পুরো এলাকাটাই যেন একটা পার্ক। সেতু পেরিয়ে ক্লাবের প্রবেশপথ। ডানদিকে দুটো দোলনা, তার একটু পর ভলিবল ব্যাডমিন্টন খেলার জায়গা, তার বায়ে গোলাকার জায়গা মাঝে একটা সিমেন্টের গোলাকার বেদী। আরো বায়ে বিশাল সবুজ একটা মাঠ। এত ঘন ঘাসে ছাওয়া মাঠ শহরে দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ।
এই ডিপোর ম্যানেজারের বাংলোতে কাজ করে নাসিমা। ঠিক বুয়া না হলেও ঘরের সব কাজ সে করে, পাশাপাশি বাচ্চা দুটো দেখাশোনা। ম্যানেজারের বউ নাসিমাকে বলেছে চাইলে তাদের বাগানের কাজ করতে সে তার স্বামীকে লাগাতে পারে। নাসিমার স্বামী পাশের একটা ডিপোতে সিকিউরিটির চাকরী করতো, তাকে ছাঁটাই করেছে কোম্পানীর মন্দার কারণে। এখানে চাকরীর জন্য নাসিমা বলে রেখেছিল। কিন্তু ক্যাজুয়াল বাদে স্থায়ী চাকরী দেবার ক্ষমতা ম্যানেজারেরও নেই। তাই ম্যানেজারের বউ নাসিমাকে এই প্রস্তাব দিল। নাসিমা খোদার কাছে বড় ধরনের শোকর করলো দ্বিতীয়বার। প্রথমবার করেছিল যেদিন মিনহাজ তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল।
দেবতা বলতে যা বোঝায় মিনহাজ তার চেয়েও বেশী কিছু। নাসিমাকে কি অবস্থা থেকে উদ্ধার করে এখনো পর্যন্ত আগলে রেখেছে সেটা কেবল উপরঅলা জানে আর জানে সে। মিনহাজ কেন এই কাজটা করলো সেটা আজো রহস্য। সে চাইলেই অন্যদের মতো কাজ সেরে চলে যেতে পারতো। কিন্তু কি একটা কারণে সে তার কাছেই ফিরে এসেছে। তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে, ঘর বেধেছে, ঘর ছেড়েছে, সেই সাথে ছেড়েছে সকল ধন সম্পদের হানছানি, ভবিষ্যত সম্ভাবনা, এমনকি নিজের পরিবারও। নাসিমার মধ্যে এমন কি আছে যে সে এত ভালোবাসার যোগ্য? যদি কেবল শরীরের আকর্ষণ থাকতো, সেটা মিনহাজ বিয়ে ছাড়াই পেতে পারতো। এমনকি যখন মিনহাজ তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় তখন সে রীতিমত অসুস্থ। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে নিজের হাতে সেবা করে সুস্থ করে তুলে, তারপর বিয়ে করা, এটা তার পেশার কেউ কখনো কল্পনা করেনি। এই মানুষকে দেবতা বললেও কম বলা হয়। বড়লোক বাবার সম্পদের মোহ ছেড়ে সে এখন বস্তি জীবনযাপন করছে গত দশ বছর ধরে। তাদের ঘরে দুটো সন্তান। স্কুলে ভর্তি করিয়েছে তাদের।
মিনহাজকে মাঝে মাঝে তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখতে বলে নাসিমা। তাদের বিয়ে মেনে না নিলেও তারা তো বাবা মা। যত রাগই থাকুক, সেই মায়ের গর্ভের তো জন্ম। তাকে বছরে অন্তত কয়েকবার গিয়ে দেখে আসুক। কিছুদিন গিয়ে সাথে থাকুক। অনেকটা নাসিমার পীড়াপিড়িতে কেবল মায়ের কাছে যায় বছরে দুয়েকবার। মা তার হাতে কিছু টাকাপয়সা তুলে দেয়। কয়েক বছর আগে ফরিদপুরের ওদের গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল মায়ের সাথে। মা গ্রামে বাড়ি করছে। ওখানে গিয়ে কাটাবে শেষ বয়সটা। মা বললো কিছুদিন গিয়ে বাড়ির কাজ দেখাশোনা করতে। নাসিমাকে জিজ্ঞেস করতে নাসিমা রাজী। তোমার তো এখন কাজকর্ম নেই, কিছুদিন থেকে আসো। নাসিমার হাতে কিছু টাকাপয়সা তুলে দিয়ে সে ফরিদপুরে চলে যায় তিন মাসের জন্য।
৩.
ফুফুরা আজ চলে যাবে। মন খারাপ লীনার। তাই কলেজে যায়নি সে। ফুফুরা আর কখনো তাদের বাড়িতে এতদিন থাকেনি। এবার থেকেছে বাধ্য হয়ে। ওরা তো গ্রামের কথা ভুলেই গিয়েছিল। তবু এতকাল পর কি মনে করে গ্রামে ফিরে আসার চিন্তা করছে কে জানে। একবার যারা গ্রাম ছেড়ে যায় তারা কখনো ফেরে না আর। অনেক দেখেছে সে। শহরে কি যাদু আছে, মানুষকে আটকে রাখে। পতঙ্গ যেমন আলোর চারপাশ ঘিরে উড়তে থাকে কোন এক বিভ্রান্তিময় কারণে, অথচ আলো পতঙ্গকে মৃত্যু ছাড়া আর কোন উপহার দিতে পারে না। শহরের মানুষগুলোকেও তার সেরকম লাগে। প্রত্যেকবার শহর থেকে যখন লাশ হয়ে একেকজন ফিরে আসে তখন তাই মনে হয়। গত তিন বছরে চারজনকে দেখলো সে। মৃত্যুর পরই যেন গ্রামের ঠিকানায় ফিরে আসা। একমাত্র মেজ ফুপুই ব্যতিক্রম। উনি বাড়ি করছেন এখানে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্যই। ফুফু শ্বশুরবাড়িতে না গিয়ে এখানে কেন বাড়ি করছে সেটা নিয়ে অবশ্য তার কোন মাথাব্যথা নেই। ফুফু এখানে থাকবে, সে ফুপুর সাথে সারাক্ষণ ঘুরঘুর করবে, এটা সেটা এগিয়ে দেবে, আর বকুল ভাইয়ের চটকানা খাবে যখন তখন এটাতেই আনন্দ তার। বকুল ভাইয়া একটা কেমন যেন। সে এখন বড় হয়েছে না? তবু তাকে ছেলেবেলার মতো গাধিনী বলে ডাকবে।
আচ্ছা এত বছরেও বকুলভাই বিয়ে থা করেনি কেন? এটা নিয়ে তার একটা গোপন কৌতুহল আছে। কিন্তু কাকে জিজ্ঞেস করে? বকুলভাইয়ের বয়স কমসে কম ত্রিশ হবে। ও মা! এত বুড়ো হয়ে গেছে বকুল ভাই? কি একটা ভেবে আপন মনে লজ্জা পায় সে। ভাবনাটা কাউকে বলার মতো না, কাউকেই না। এটা সে নিজে নিজে ভেবে সুখ পায়। এমন করে আর কাউকে ভাবেনি সে। তারা তো আত্মীয়ই। এমন করে ভাবা কি ঠিক? তার চেয়ে বকুলভাই ১২ বছরের বড়। এত পিচ্চি একটা মেয়েকে পাত্তা দেবে না বকুলভাই। সেরকম দেয়ও না। এই বয়সী মেয়েদের দেখলে পুরুষরা অন্য চোখে দেখে, কিন্তু বকুলভাই কেমন অন্যরকম। তাকে যেন দেখেও দেখে না। আচ্ছা, শহরে বকুলভাইয়ের কেউ নেই তো? শহরের ছেলেরা অনেক সহজে প্রেমট্রেম করে। ধুরো বকুলভাই সেরকম না। ফুপুর সাথে বাড়ির কাজ তদারকি করার পাশাপাশি কেবল রেডিও ঘুরায়, গান শোনে। এদিক সেদিক নজর দেয় না। সেরকম কেউ থাকলে বকুলভাই নির্ঘাত উদাস হয়ে যেতো মাঝে মাঝে। এখানে আছে আজ দুমাসের বেশী। একবারও সেরকম মনে হয়নি।
আজ ফুপুরা নিজের বাড়িতে উঠবে। বাড়িটা ওদের ১০০ গজের মধ্যেই। তবু মনে হচ্ছে ওখানে গেলে বকুলভাইকে আর পাবে না। এখানে এই কদিনের যে খুনসুটি, মায়া গড়ে উঠেছিল, সেসব কি আর থাকবে? বকুলভাই নিশ্চয়ই এরপর শহরে ফিরে যাবে। আবার কবে দেখা হবে। ততদিনে যদি ওর কিংবা বকুলভাইয়ে বিয়ে হয়ে যায় তখন কি আর......ভাবতে পারে না লীনা। তার দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসে। রান্নাঘর থেকে মা ডাকছে। আজকে ওদের জন্য বিশেষ বিদায়ী খানাপিনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাবা বলেছে আরো কদিন ওদের জন্য এ বাড়ি থেকে খাওয়া যাবে। ফুপুর যেন কষ্ট না হয়। বাবা তার এই বোনটাকে বেশী পছন্দ করে।
বিকেলটা মেঘলা। বৃষ্টি হবে আজ রাতে। আকাশের সাথে লীনার মনটাও একই সুরে কাঁদছে। প্রতিদিন রাতে শোবার আগে সে বকুলভাইয়ের ঘরে এক গ্লাস পানি রেখে আসে। ওটা একটা অজুহাত। আসলে বকুলভাইকে শেষবার দেখে ঘুমোতে যাওয়া। গত দুমাস ধরে এই রুটিনে আজকে ব্যাঘাত ঘটলো। আজকে কি দেখে ঘুমাবে সে? রাতে পানি খাবার অভ্যেস বকুলভাইয়ের। এখন কে দেবে পানি? তার চিন্তার বহর দেখলে বাচ্চাছেলেও হাসবে। তবু সে পাগলামি চিন্তা করে। হাতে চিড়াভাজা নিয়ে মা আসে। হঠাৎ করে বলে বসে-
-আচ্ছা বকুলকে তোর পছন্দ হয়?
-মানে?
-বয়সটা একটু বেশী হয়ে যায়। কিন্তু এত ভালো ছেলে তো আর হয় না।
-মা তুমি কি বলছো বুঝতে পারছি না।
-কদিন আগে কথায় কথায় আপা তোর প্রশংসা করছিল। তারপর তোকে চেয়েছে বকুলের জন্য অবশ্য তুই রাজী থাকলে।
মাথাটা কেমন ঘুরে ওঠে লীনার। এসব কি শুনছে সে। নিশ্চয়ই এটা সত্যি না। এটা স্বপ্ন। সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। তাদের বাগানের সবজিতে মুখ দিয়ে কচকচ করে খাচ্ছে পাশের বাড়ির ছাগলটা। অন্যসময় হলে চিৎকার করে উঠতো সে। এখন মা এসব কি বলছে। ছাগলটাও কি স্বপ্নের অংশ?
-কি রে চুপ রইলি কেন? তোর বাবাকে বলেছি, তুই রাজী না থাকলে আমি না করে দেবো।
-না মা, আমি এসব কি জানি, আমি বুঝি না
-তবু তোর যদি খারাপ লাগে আমি মানা করে দেবো। আমি জানি তুই ওকে বড় ভাইয়ের মতো দেখিস।
-না মা সেজন্য না, আমি আসলে....
-তোর আপত্তিটা কোথায় তাইলে?
-আ....আমার... আমার আপত্তি নাই। তোমাদের যা ভালো মনে হয় করো
অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে আর কোন সমস্যা নেই। খুব বেশী ধুমধাম না। বাইরের কাউকে দাওয়াত দেয়া হলো না। শুধু এ গ্রামের আত্মীয় স্বজনকে নিয়েই বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে গেল। এমনকি ফুপাও আসতে পারেনি। ফুফু বললো তার অফিসের কি ঝামেলায় সে আসতে পারছে না। লীনার তাতে কোন সমস্যা নেই তার শুধু বকুল ভাইকে পেলেই হয়। আচ্ছা, এখন তো বকুল ভাই ডাকা যাবে না। কি ডাকবে সে? মিনহাজ সাহেব? বাসরঘরে হিহি করে হেসে উঠলো মনে মনে। একটু পরেই তিনি আসবেন। এই ঘর থেকে নতুন বাড়ির চুনকাম করা গন্ধটা এখনো যায়নি। বাসরঘরের ফুলের গন্ধ ছাপিয়েও সেই গন্ধটা নাকে এসে লাগছে।
৪.
ঢাকায় এসে মিনহাজ ট্রেন বদলে তুর্না নিশীথায় উঠলো। সে একাই ফিরছে। মা ওখানেই থাকবে। সাথে লীনা। মাকে কথা দিয়েছিল অন্ততঃ একটা কথা রাখবে তার। কেউ জানে না বাবার সাথে মার সেপারেশান হয়ে গেছে বছরখানেক আগে। মা গ্রামে একা থাকবে। কিন্তু এই বয়সে একজন সঙ্গী দরকার তার। মা একটা বউ চেয়েছিল তার কাছে। চেয়েছল মায়ের পছন্দের একটা মেয়েকে বিয়ে করুক সে। অনেক ঠান্ডা যুদ্ধের পর রাজী হয়েছে লীনাকে বিয়ে করতে। গ্রামের কেউ জানে না মিনহাজের শহরের অধ্যায়। তাই বিয়েটা নিয়ে কোন ঝামেলা হয়নি। যদি সব জানাজানি হয় একদিন? মিনহাজ ওসব নিয়ে ভাবতে চায় না। সে আর কখনো গ্রামে ফিরবে কিনা সন্দেহ আছে। নাসিমার কাছেই তার সব। তার দুটো সন্তান নাসিমার গর্ভেই। ওদের ছেড়ে অন্য কিছু ভাবতে পারবে না সে। লীনাকে নিয়ে তার কোন আবেগ নেই। সে ওকে বিয়ে করেছে মায়ের ইচ্ছে পুরন করতেই। বাকী জীবন লীনা কি করে কাটাবে সেটা নিয়ে তার কোন ভাবনা নেই। ওটা মায়ের বিষয়। মা নাসিমাকে কোনদিন মেনে নেবে না। সুতরাং মায়ের জন্য আর কিছু করার নেই তার। তার দুটো সন্তানকে মা একবারও দেখতে চায়নি। কত নিষ্ঠুর। নাসিমা খারাপ বলে তার সন্তানও খারাপ হয়ে যাবে? সারারাত মিনহাজের ঘুম আসে না এসব ভেবে। অনেকদিন আগে সে একটা জীবনকে রক্ষা করেছিল। এখন আরেকটা জীবন নষ্ট করলো।
৫.
মিনহাজ অনেক শুকিয়ে গেছে। গ্রামের পরিশ্রমে কালো হয়ে গেছে সে। কি খেয়েছে, কোথায় খেয়েছে কে জানে। চিন্তিত নাসিমা দেখে তার চেহারার মধ্যে কি একটা পরিবর্তন। কেমন একটা বিষন্নতা। আগের মতো ছেলেমেয়েদের নিয়ে আহলাদ করছে না। মাকে নিয়ে চিন্তা করছে হয়তো। মা গ্রামে একা আছে সেজন্যই। হাজার হলেও আপন মা তো। নাসিমা কি করবে বুঝতে পারে না।
৬.
আরো আট মাস পর মিনহাজ খবর পায় লীনা একটা ছেলের মা হয়েছে। এই সংবাদে তার ভ্রু কুঁচকে ওঠা ছাড়া তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। মা তার কাছে একটা নাতিও চেয়েছিল। তাও পূরন হলো। এই সংবাদ পাবার পর ওদিকের সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করে দেয়। মাকে দরকার নেই তার। লীনাকেও না। জীবনের ওই অংশটাকে সে মুছে ফেলতে পারলে এই অংশে কিছুটা সুখী হতে পারে। নইলে এপার ওপার করে তার জীবনটা অতিষ্ট হয়ে যাবে।
৭.
বাগানের কাজটা নিল মিনহাজ। নাসিমা খুব খুশী। এখন স্বামী স্ত্রী দুজনেই এক জায়গায় কাজ করতে পারবে। এই ম্যানেজার যতদিন আছে চাকরী নিয়ে ততদিন চিন্তা নাই। কোন একদিন স্বামীর চাকরীটা পার্মেন্ট হয়েও যেতে পারে।
৮.
লীনা জানে না তার অপরাধ কি। পছন্দ না হলে কেন বিয়ে করতে গেল তাকে। তাকে তো জোর করেনি। বিয়ে করে তার একটা সন্তান হলো, চার বছরে তার মুখ দেখতেও একবার এলো না। কেমন মানুষ সে? ফুফু মানে শাশুড়িও এখন তার কোন খোঁজ জানে না। গত চার বছর কোথায় মিলিয়ে গেছে সে। বেঁচে আছে না মরে গেছে জানে না লীনা। কেউ কোন খবর দিতে পারে না। লীনার এখন নিজেকেই ঘেন্না লাগে। ইচ্ছে করে পালিয়ে গিয়ে নিজেকে নষ্ট করে প্রতিশোধ নেয়। শুধু ছেলেটার দিকে তাকিয়ে এখনো টিকে আছে সে।
৯.
অতএব মিনহাজ বৃত্তান্ত অসম্পূর্ন হয়েই থাকে। প্রতিটি জীবিত মানুষের বৃত্তান্তই অসমাপ্ত। বাকী জীবনে মিনহাজ কোন পথে হাঁটবে আমরা জানি না। কিন্তু বৃত্ত সম্পূর্ন হবার আগে মিনহাজকে কোন সংজ্ঞায় ফেলা যায়?
ভেজাল
কিন্তু একদিন খবির উদ্দিনের টেবিলে একটা কম্পিউটার বসানো হলো ইন্টারনেট সহকারে। সে জীবনে কোনদিন কম্পিউটার ধরেনি, ভাবতো এটা হলো অপারেটরের কাজ। এই বুড়া বয়সে কম্পিউটার নিয়ে কাজ কি। সে না জানে টাইপ, না চেনে প্রোগ্রাম। কিন্তু সরকারের হুকুম। দেশটা ডিজিটাল হচ্ছে, ঘরে ঘরে কম্পিউটার এখন। খবিরউদ্দিনের টেবিল কেমনে খালি থাকে। মুশকিলে পড়ে গেল খবির। কম্পিউটার বসানোর পর থেকে ওটা বসেই আছে। ওটায় তার কোন কাজ নাই। একটা কালো বোরকা পরে টেবিলের উপর বসে থাকে জড়োসড়ো হয়ে।
একদিন বড় সাহেব অফিসে উঁকি দিতে আসলেন। সবাই তটস্থ, যার যার টেবিলের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে দ্রুত। খবিরুদ্দিনের তেমন কাজ থাকে না, বসে বসে পত্রিকা পড়ে সারাদিন। পত্রিকা পড়ে খবরাখবর সংগ্রহ করে সময় সময় বড় সাহেবের কাছেও গালগল্প করে। বড় সাহেবের পত্রিকা পড়ার সময় নাই। মন্ত্রী সচিবের গুঁতো সামলাতে হিমশিম। খবিরউদ্দিনই বড় সাহেবের সংবাদ সুত্র। তাই বড় সাহেবকে আসতে দেখে পত্রিকার গভীরে ডুবে যায় আরো। বড় সাহেব সমস্ত অফিসে চক্কর দিয়ে তার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়-
-খবিরউদ্দিন সাহেব
-জী স্যার!
-কি করেন?
-স্যার, মিচ্যুয়াল ফাণ্ডের ইন্টারেস্ট রেটে বড় একটা ছাড় দিয়েছে, এইমাত্র পড়লাম
-কোথায় পড়লেন?
-এই তো স্যার, এই পত্রিকায়
-আপনার কম্পিউটার কি নষ্ট?
-না স্যার, একদম নতুন এখনো, আমি তো ব্যবহার করি না তেমন
-ব্যবহার করেন না কেন? টেবিলে কম্পিউটার দেয়া হয়েছে কি জন্য?
-স্যার.....মানে.. ওখানে তো আমার কাজ নেই...তাই
-পত্রিকা পড়াও তো আপনার একটা কাজ
-জী স্যার
-পত্রিকা কম্পিউটারে পড়েন না কেন?
-কম্পিউটারে স্যার, কি করে পত্রিকা পড়ে আমি ঠিক জানি না
-জানার চেষ্টা করলেই জানবেন
-আচ্ছা স্যার
-কাল থেকে অফিসে পত্রিকা নেয়া বন্ধ। কম্পিউটারে বিনামূল্যে পত্রিকা পড়া যায়।
-জী স্যার
বিপদে পড়ে গেল খবিরউদ্দিন। কম্পিউটারে পত্রিকা পড়া শিখতে তো তার বছরখানেক লেগে যাবে। এত জটিল বোতাম, সারা জীবনেও মনে হয় এতসব মুখস্থ হবে না। সে তার জুনিয়র সহকারীকে ডেকে কম্পিটারে পত্রিকা খোলার ব্যবস্থা করতে বললো। সহকারে এসবে চটপটে। সে দুমিনিটে হাজির করে দিল পত্রিকাটা। আশ্চর্যের আশ্চর্য খবির উদ্দিন। এত কামেল জিনিস তার টেবিলে আছে অথচ সে ব্যবহারই করেনি এতদিন! সেদিন থেকে খবির উদ্দিন উঠে পড়ে লাগলো কম্পিউটার নিয়ে। কয়েক মাস পরে সে রীতিমত সিদ্ধহস্ত হয়ে গেল কম্পিউটারে। পত্রিকার পাশাপাশি সে অন্যন্য সাইটগুলো ভিজিট করে, ইউটিউব আর ফেসবুকের মতো জিনিসও খবিরউদ্দিনের আয়ত্বে চলে আসে।
মেয়েটার সাথে ফেসবুকেই পরিচয়। বয়সের পার্থক্য সত্ত্বেও মেয়েটার সাথে ঘনিষ্টতায় জড়িয়ে যায়। সুখ দুঃখের যাবতীয় আলাপ করে। একদিন দেখা গেল খবিরউদ্দিন তার জীবনের গোপনতম কথাটিও মেয়েটাকে বলতে শুরু করে। যা কোনদিন তার বউয়ের কাছেও ফাঁস করেনি। অবশ্য পুরাতন প্রেমের কাহিনী বউয়ের কাছে শেয়ার করার মতো সাহস সব পুরুষের থাকে না। কিন্তু মেয়েটা কেন যেন তার গোপন জগতের অধিকারী হয়ে গেল। মেয়েটারও কাহিনী আছে। সেও অবলীলায় তার কাহিনী খবিরউদ্দিনের কাছে বলতে থাকে। দুজনের গোপন কথা শেয়ার করতে গিয়ে খবিরউদ্দিনের মনে হঠাৎ করে রোমাঞ্চ খেলে যায়। সে মনে মনে ভাবতে থাকে মেয়েটা তার সাথে পরকীয়া করছে। পরকীয়া মানে নিষিদ্ধ ক্রিয়া। যে কোন নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের দুর্বার আগ্রহ। খবিরউদ্দিনেরও তাই হলো। সে পত্রিকা পড়া ভুলে এখন ফেসবুকে পড়ে থাকে। সারাদিন চ্যাট করে। মেয়েটাও প্রতিদিন তার জন্য বসে থাকে। এতকিছু হলেও মেয়েটার ছবি দেখেনি কখনো। ছবি দেখার কথা মাথায় আসেনি তার। তার ছবিও মেয়েটা কোনদিন দেখতে চায়নি। এরকম অসম বয়সে ছবি দেখাদেখি ব্যাপারটা কেমন যেন। তবু একদিন মেয়েটাকে দেখতে চাইল। ছবি পাঠালো মেয়ে। অপূর্ব মেঘলা চুলের একটা মেয়ে। দেখেই বুকের ভেতর রিনিঝিনি বৃষ্টি শুরু হলো। নস্টালজিক হতে হতে অনেক পেছনে চলে গেল খবিরউদ্দিন। আরো বছর বিশেক আগে........। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এর তার বুক চিরে।
প্রতিদিন কাজের চেয়ে মেয়েটার সাথে গোপন আড্ডায় বেশী সময় ব্যয় হতে থাকে খবির উদ্দিনের। মনে মনে অপরাধবোধ কাজ করে। এমন একটা মেয়েকে নিয়ে সে কেন এত আবেগ দেখাচ্ছে। মেয়েটাকে প্রতিদিন না দেখলে কেমন লাগে। ছুটির দিনগুলো তার ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে কাজের ছুতোয় অফিসে ছুটে যায়। কিন্তু খোলার দিনেই তার কাজ থাকে না, ছুটির দিনে কেমনে যায়। তবু বাজারের থলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে মাছ তরকারী কেনার সময়ও মন পড়ে থাকে মেয়েটার কাছে। বুড়ো বয়সের প্রেম বড় জ্বালা দেখি। তার আবারো তরুণ হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে।
একদিন ফোন নাম্বার বিনিময় হয়। ফোনের কন্ঠ শুনে খবিরউদ্দিনের বুকের জ্বালা ক্রমশঃ উর্ধমূখী। এবার শায়লাকে মুখোমুখি দেখার তৃষ্ণা জাগে তার। হ্যাঁ মেয়েটার নাম শায়লা শারমিন। সে আদর করে শাশা ডাকে আজকাল। খবির অনেক জোরাজুরি করে কিন্তু শাশা বলে সেটা ঠিক হবে না। ওরা একই শহরে বাস করে, অথচ কেউ কাউকে দেখবে না, এটা মানতে পারে না খবিরউদ্দিন। কিন্তু জোর করে কিছু বলতেও পারে না। যদি শায়লা তাকে খারাপ মনে করে?
বড় সাহেবের সাথে বড়লোকী এক দাওয়াতে যেতে হলো বিষুদবার সন্ধ্যায়। অথচ প্ল্যান ছিল বড় সাহেব চলে গেলে অফিসে বসে শায়লার সাথে কিছুক্ষণ ফোনপ্রেম করবে। কিন্তু নাছোড় লোকটা তাকে নিয়েই পার্টিতে গেল। পার্টিটা বিশাল একটা জায়গা জুড়ে। মেরিনার্স ক্লাবের লনটা যেন একটা সবুজ পার্ক। সেখানে নানান গাছের ঝোপঝাড়ের পাশে টেবিল সাজানো। বাগানজুড়ে আলোক সজ্জা। বড় সাহেব পার্টিতে ঢুকে জুড়ে গেল বড় সাহেবদের সাথে, খবির বেছে একটা মাঝারি ধরনের লোকের টেবিলে বসলো। বিশাল গোলাকার টেবিল। এক টেবিলে বারো জনের বসার ব্যবস্থা। সেখানে আরো কয়েকজন বসে গল্প করছে। খাবার দিতে দেরী আছে কিন্তু সবাই আগেভাগে টেবিলগুলো দখল করে বসে গেছে। খবিরের খুব বোরিং লাগছে, এখানে তার পরিচিত কেউ নেই। হঠাৎ ইচ্ছে হলো শায়লার সাথে কথা বলতে। ফোন করলো শায়লার মোবাইলে।
মিউজিক বাজছে মৃদুলয়ে। অচেনা পশ্চিমা কোন সঙ্গীত। এসব ভালো বোঝে না খবির। মিউজিকের পাশাপাশি মোবাইল টোনও যুক্ত হয়েছে। এদিক সেদিন বেজে উঠছে টুংটাং মোবাইল রিংটোন। এই টেবিলেও বাজছে কোন একজনের। খারাপ লাগছে না শুনতে। কি ব্যাপার ফোন ধরছে না কেন শায়লা। অনেকক্ষণ পর ধরলো সে।
প্রায় ফিসফিস করে খবির বললো- হ্যালো!
ওপাশ থেকেও ফিসফিস শব্দ এলো-হ্যালো!
খবির ফিসফিস করে বললো- আই মিস ইউ শাশা!
ওপাশ থেকে বললো-আমি একটা পার্টিতে এসেছি, পরে কথা বলি?
এপাশ থেকে খবির বললো- আমিও একটা পার্টিতে
ওপাশ থেকে বললো- তাহলে তুমিও পার্টি শেষ করো, তারপর কথা বলবো
এপাশ থেকে খবির বললো-পার্টিতে আমার কাজ নেই, তাই তোমার সাথে কথা বলি
ওপাশ থেকে বললো-কাজ আমারো নেই, কিন্তু এরকম ফিসফিস করে কথা বলতে পারবো না। বিশ্রী লাগে। আমার টেবিলের উল্টোদিকে এক হাঁদারাম মোবাইল নিয়ে প্রায় টেবিলের নীচে ঢুকে যাচ্ছে।
খবির খেয়াল করলো ফিসফাস করতে করতে মাথাটা একটু বেশীই নীচে করে ফেলেছিল। কিন্তু শায়লার সামনের লোকটাও? সোজা টেবিলের উল্টোদিকে বসা মোবাইল কানে মাঝবয়েসী মহিলাটাও ফিসফিস করে কথা বলছে। চোখ বড় বড় করে মহিলার দিকে তাকালো খবির। শায়লা ওপাশ থেকে বললো- হ্যালো রাখছি, বুড়ো হাঁদাটা এখন আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। খবির দেখলো মহিলা কান থেকে মোবাইলটা নামিয়ে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলো। ফেসবুকের তরুণী শায়লা কি এই মহিলাই? সর্বনাশ! এবার সে টেবিলটা ছেড়ে পালাবার পথ খুঁজতে থাকলো।
পরদিন থেকে খবিরউদ্দিনকে ফেসবুকে দেখা গেল না আর।
ডাস্টবিন
আমার জন্ম এই ডাস্টবিনে। না ভুল হলো। আমাকে পাওয়া যায় এই ডাস্টবিনে। আমাকে আরো পঁচিশ বছর আগে যে মহিলা কুড়িয়ে নিয়েছিল তাকে আমি মা বলে জেনে এসেছি। নিঃসন্তান ওই মহিলা আমার কান্না শুনে রিকশা থামিয়ে আমাকে তুলে নিয়েছিল। তারপর তার স্বামীর কাছে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। তার স্বামী প্রথমে বিরক্ত হলেও কিছুদিন পরেই আমার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে চমৎকৃত হয়। আমার পিসু করার সময় হলে আমি মোচড় দিয়ে কোল থেকে নেমে যেতে চাইতাম। বাবা লোকটা বলতো এরকম শিশু এই জগতে বিরল। বড় হয়ে এ নিশ্চয়ই দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। মা আমাকে নিয়ে গর্ব করতো।
একটু বড় হলে আমাকে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হলো। গাড়িতে করে স্কুলে যেতাম গাড়ি করে বাড়ি ফিরতাম। আমি খুব ভালো রেজাল্ট করতে লাগলাম স্কুলে। আমার খেলাধুলার স্কোর ছিল লক্ষণীয় রকমের ভালো। আরো অনেক বছর পর আমি বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে চাইলাম। মা যেতে দিতে রাজী হলো না। বাবা লোকটা রাজী। আমি বাবার পক্ষে গেলাম। বাবা আমাকে বিদেশ যাবার ব্যবস্থা করলো। মা রাগ করে আমার সাথে কথা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমি যাবার দিন আমাকে বিদায়ও জানালো না। ঘরে দোর দিয়ে কাঁদতে থাকলো।
বিদেশে যাবার পর আমি মাকে ফোন করে পাই না। মা আমার সাথে কথা বলে না। সব খবর বাবার কাছ থেকে পাই। দিন মাস বছর যায়। প্রায় দুবছর মায়ের সাথে আমার যোগাযোগ নেই। মনটা কেমন করতে লাগলো। একদিন হুট করে আমি দেশে ফেরার জন্য তৈরী হলাম। কাউকে না জানিয়ে একদিন প্লেনে উঠে বসলাম।
বাসায় এসে কলিংবেল দিলাম। বুকের মধ্যে কেমন ধুকপুক করছে। মা আমাকে দেখে কেমন অবাক হয়ে যাবে। এতদিনে সব অভিমান ভুলে গেছে নিশ্চয়ই। ভেতর থেকে কে কে বলছে কেউ একজন। মায়ের কন্ঠ এমন কেন? এত বুড়িয়ে গেছে নাকি মা? কিন্তু দরোজা খুললো অচেনা এক মহিলা। আপনি কে, জিজ্ঞেস করলো আমাকে। আমি নাম বললাম, কিন্তু বুড়ি চিনতে পারলো না। দেখে মনে হলো বুয়া। এমন সময় ভেতর থেকে মায়ের কন্ঠ, কে এসেছে সাহারার মা? আমি ধাক্কা দিয়ে দরোজা খুলে এবার মায়ের কাছে ছুট। মা আমাকে দেখে প্রায় বেহুশ। মাকে জড়িয়ে ধরে আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম।
মা, তোমাকে কতোকাল পর দেখছি। মায়ের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে। আমিও কাঁদছি।
-বাবা কোথায়?
-সে এখানে থাকে না
-মানে?
-এখানে আমি একাই থাকি
-বাবা কোথায় থাকে
-এখনো বাবাকেই দরকার তোর?
-না মা, কেবল জানতে চাইছি, বাবার কি হয়েছে
-তোর বাবা আবার বিয়ে করেছে
আমার মাথায় কেউ যেন হাতুড়ির আঘাত করলো। গতমাসেও বাবার সাথে হাসিখুশী গল্প করেছি। বাবা কখন এই কাজ করলো?
-কি বলছো মা, কবে করলো, কেন করলো এমন?
-সে তো ছমাসের বেশী হলো। তারপর থেকে এ বাড়িতে থাকে না সে। আমি বলেছি আমার সাথে আর থাকতে পারবে না। মেনে নিয়েছে সে। এখন তুই কি আমার কাছে থাকবি নাকি তোর নতুন মায়ের কাছে যাবি?
-মা তুমিই আমার মা, আমি আর কোথাও যাবো না তোমাকে ছেড়ে
-ঠিকাছে আমার কাছেই থাক। কিন্তু আমি তোর সাথেও বেশীদিন থাকতে পারবো না।
-কেন?
মায়ের অসুখটার কথা জানতে পারলাম এই প্রথমবারের মতো। আমাকে বাবা লোকটা ঘুনাক্ষরেও জানায়নি। লোকটাকে আমি এই প্রথমবারের মতো ঘৃনা করতে শুরু করি। তারপর মা আমাকে যা বললো তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
-আমি তোকে কিছু কথা বলে যাই। মন দিয়ে শোন।
-বলো
-তুই বিদেশে চলে যা। দেশে আর ফিরিস না।
-কি বলছো মা, তোমাকে ছেড়ে, এই দেশ ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। পড়াশোনা শেষ হলে আমি ফিরবোই।
-আমি তো বেশীদিন নেই। আমি না থাকলে তোকে দেখবে কে? দেশটা তোকে দেখবে না, এদেশে তোর কেউ নেই।
-কি আবোলতাবোল বকছো মা?
-তোকে কোনদিন বলিনি, আমি তোকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম ওই ডাস্টবিনে। তোর বাবা ছাড়া আর কেউ জানতো না এতদিন। এখন তোর নতুন মা এসে জেনেছে সব। সে তোকে মেনে নেবে না বলেছে। তোর বাবাকে দিয়ে তোকে সমস্ত উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে।
-মা!! তুমি কি শোনালে এসব? আসলে কি সত্যি? তুমি গল্প করছো না তো? নিশ্চয়ই দুষ্টুমি করছো
-না রে বাবা। আমার জীবনের শেষভাগে আমি তোকে সত্যিটা জানিয়ে গেলাম। তোর বাবা মা কে আমি জানি না।
-এখন আমি কি করবো? কোথায় যাবো?
-তুই অবশ্যই বিদেশে চলে যাবি। ওখানেই তোর ভবিষ্যত। এদেশে থাকলে তোর নতুন মা তোকে বাঁচতে দেবে না। সে তাও হুমকি দিয়ে রেখেছে। আমি চাই তার সাথে দেখা হবার আগেই তুই দেশ থেকে চলে যা। আমি যতদিন বাঁচি এখানেই থাকবো।
-আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও পালাবো না মা।
-তুই না পালালে আমি যে তোকে চিরতরে হারাবো। তুই অনেক বড় হবি। দুনিয়াতে তোর অনেক নামডাক হবে। তুই বিদেশেই চলে যা সোনা! আমার মাথার দোহাই লাগে।
মা একবার যা বলে তার নড়চড় হয় না। খুবই জেদি আর অভিমানী আমার মা। আমার আর উপায় নেই।
আমি দেশ ছাড়বো আজ বিকেলে। তার আগে নিজের জন্মস্থান দেখতে এসেছি। প্রাণভরে দেখছি আর ভাবছি আমার সেই মা এখনো এই পৃথিবীর কোন প্রান্তে বসে আছে। সেই মায়ের হাসি কেমন? সে মায়ের চুলের গন্ধ কিরকম? সেই মা কি এখনো আমাকে মনে রেখেছে? আমাকে ফেলে দিল কেন? আমি কতটা ঘৃনিত মানুষ হয়ে জন্মেছিলাম? আমার জন্ম প্রক্রিয়ায় কি কোন ভালোবাসা ছিল না? আমি জানি যে কোন দুজন নারী পুরুষের মিলনের ফলে আমার জন্ম হয়েছে। সেই নারী পুরুষ দুজনের মুহুর্তের আনন্দের ফসল আমি। আনন্দ না হলেও তো শিশুর জন্ম হতে পারে। দুটি মানুষের পাশবিক মিলনের ফসলও হতে পারে একটা শিশু। কেবল পশুর মতো সঙ্গম করে দুর্ঘটনাক্রমে একটা সন্তানের ভ্রুন তৈরী করে ফেলেছিল হয়তো। তারপর তাকে ঝেড়ে ফেলার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর জন্মপ্রক্রিয়ায় আসতে হলো। শিশুটি আলোর মুখ দেখার পরই তাকে বর্জন করার আয়োজন। অতঃপর কোন নির্জন রাতে একটা পুটলি করে ছুড়ে দেয়া এই ডাস্টবিনে।
আমার তীব্র ঘেন্না হতে থাকে এই পৃথিবীর মানুষগুলোকে। সবগুলো মানুষকে একেকটা পশুর মতো লাগে। আমি ঘেন্নায় কুঁকড়ে যাই।
কুকুর দুটো ডাস্টবিনে ফিরে এসেছে আবারো। আমি মানুষকে ওই পশুদুটির চেয়ে উন্নত বলে ভাবতে পারি না। হাতে থাকা কেকের ঠোঙ্গাটা ছুড়ে দিলাম কুকুর দুটোর উদ্দেশ্যে। তারপর হাঁটতে শুরু করলাম এয়ারপোর্টের দিকে।
[অসমাপ্ত খসড়া]
ডিসি হিল
পাহাড়ে উঠে গেছে পিচঢালা পথ। গাড়ি নিয়ে যে কেউ পাহাড়ের চুড়ায় উঠে যেতে পারে। এই পাহাড়ের চুড়ায় ওটার রাস্তা এখন জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। কৈশোরে আর তারুণ্যে আমরা এখানে ঘুরে বেড়াতাম। এখন পাহাড়ে পাদদেশে নজরুল চত্বর, চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক আসর বসে এখানে। মঞ্চের সামনেই ধাপে ধাপে উঠে গেছে পাহাড়। পাহাড়ের খাজগুলো লাল ইটের ছোট ছোট বেঞ্চে সাজানো। ওখানে বসে দর্শককুল। এখানে ওখানে বেঞ্চ বানানো আছে আরো অনেক। গাছের ছায়ায় ঘেরা একটা একটা সাংস্কৃতিক পার্কও বলা চলে। পার্কের একাংশে ফুলের বাগান, আসলে নার্সারি। শহরের সবচেয়ে বড় ফুলের সংগ্রহ। ফুলের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে বাধানো সরু পথ। সেই পথে প্রাতঃভ্রমণকারীদের ভিড়, মাঝে মাঝে সান্ধ্যভ্রমণেও কেউ কেউ। আমি তাদের কেউ নই।
সেই কখন থেকে বসে আছি এই পার্কে। একটার পর একটা সিগারেট নিঃশেষ হয়েছে। সর্বশেষ সিগারেটটা ছুড়ে ফেলার পর মনে হলো তুমি আর আসবে না। তুমি হয়তো ভুলে গেছ। অথবা ইচ্ছে করেনি। তোমার বাসা এখান থেকে দশ মিনিটের পথ। পায়ে হেটে গেলে বিশ পঁচিশ মিনিট। যদি জ্যাম থাকে বড়জোর এক ঘন্টা। তার বেশি কিছু হতে পারে না। কিন্তু আমি এখানে বসে আছি প্রায় আড়াই ঘন্টা। তোমার আসার আর কোন সম্ভাবনা দেখি না। আমি উঠলাম। ফোন করতে পারি কোথাও থেকে। নিউমার্কেটের ফোন বুথে এখন খুব বেশী ভিড় থাকবে না। কিন্তু ফোনটা তুমি না ধরে যদি অন্য কেউ ধরে, সেই ভয়ে করতে ইচ্ছে করছে না।
রাস্তার পাশের দোকানগুলিতে বাতি জ্বলছে। আমি খানিক এগিয়ে বোস ব্রাদার্সের সামনে দাড়ালাম। এই দোকানের রসগোল্লা শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত। কতোবার ভেবেছি এখান থেকে রসগোল্লা কিনে তোমাদের বাসায় যাবো। কিন্তু তুমি রাজী না। মিষ্টি হাতে আমাকে কোথাও যাওয়া মানায় না। আমিও জানি। এটা আমারো খুব অপছন্দের কাজ। রসগোল্লার হাড়ি নিয়ে বেড়াতে যাওয়াটাকে শ্বশুরবাড়ির সাথে তুলনা করা হয়। তোমাদের বাড়িটা আমার জন্য কোনদিনও শ্বশুরবাড়ি হবে না। তুমি কখনো মুখ ফুটে বলোনি, কিন্তু আমরা দুজনেই জানি। এবং মানি এই চরম আর পরম সত্যটাকে। সত্যটা তোমাকে খুব আহত করে তাই না? ওটা ভাবলে আমার কিছুই ভালো লাগে না। আমার তখন পৃথিবী ভালো লাগে না, চাঁদ ভালো লাগে না, ফুল পাখি সমুদ্র পাহাড় কিছুই ভালো লাগে না। গোটা মানব সভ্যতাকে অসহ্য লাগে। তোমাকে ছাড়া আমার আর আছে কি?
আছে কি? সব আছে। গাড়ি আছে, বাড়ি আছে, এক গন্ডা ভাইবোন আছে, বাবা মা চাচা ফুপু খালা মামা আছে। হৈ হৈ একটা পরিবার আছে, ডজনখানেকের একদল ফাজিল বন্ধু আছে, আর কি চাই? এত এত মানুষ আছে চারপাশে। তবু আমি একা বলি কেন? আমি তোমার মায়ার লোভেই কি একটা? কি আছে তোমার মায়ায়? কেন জড়াও তুমি? আসলেই কি জড়াও? নাকি বোঝার ভুল। তুমি জানো এ হবার নয়, তবু ডেকেছিলে কেন? যখন ডেকেছিলে তখন কি জানতে না এ হবার নয়? তুমি কি না হবার জন্যই ডেকেছিলে? না হবার জন্য কেউ কি ডাকে? তুমি যখন ডাকোনি আমি তখন কারো অপেক্ষায় ছিলাম না। আমি জানতাম না কেউ আমাকে ডাকবে। ক্যাম্পাস জুড়ে তখন তুমুল উত্তেজনা। ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। তুমি হলো থাকো। তোমার ফেরার সমস্যা নেই। সমস্যা আমারই ছিল। ক্যাম্পাস থেকে বাসায় যেতে ট্রেন কিংবা বাস দুটোর একটাও ছিল না সেদিন। গণ্ডগোলে সব পালিয়েছিল। অথচ শহরে ফেরার জন্য আমার কোন বিকল্প ছিল না। বন্ধুরা কে কোথায় ছিটিয়ে গেছে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ঠিক তখনই তুমি শহরে যাবার লোক খুঁজছিলে। একটা জরুরী নোট পাঠাতে হবে শহরের বান্ধবীর বাসায়। আমি তখন বিকল্প রাস্তার সন্ধানে তোমাদের হলের সামনের রাস্তা পেরুচ্ছিলাম।
আমাকে দেখে এমন চিৎকার দিলে তুমি!! যেন আকাশের চাঁদ পেয়েছো। আমাদের চেনা ছিল মুখটা। খানিকটা কথাও ছিল। কিন্তু অমন চিৎকার দিয়ে ডাকার মতো কিছু ছিল না। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সাথে সাথে বুকের ভেতর কেমন অচেনা শিহরণ। তুমি ছুটে এলে। তোমাকে ছুটে আসতে দেখে আমি ভাবছিলাম তুমি কি ছুটে এসে আমার হাত ধরবে নাটকের মতো করে? নাকি সিনেমার মতো জড়িয়ে ধরবে, এতদিন কোথায় ছিলেন বলে। তুমি কিছুই করলে না। বললে-
-ঠিক যা ভেবেছি
-আপনারা হারবেন, এবং পালাবেন
-হেরেছি ঠিক, কিন্তু পালাচ্ছি কে বললো
-নয়তো এদিক দিয়ে কোথায়।
-গ্রামের রাস্তা খুঁজছি শহরে ফেরার জন্য
-বাহ চমৎকার বললেন তো গ্রামের রাস্তায় শহরে ফেরা?
-এই তো আমিও আপনাকেই খুঁজছিলাম।
-কেন?
-বাসার জন্য মন কেমন করছে, বাসায় যাবো
-সর্বনাশ এখন বেরুনো বিপদজনক। কোথাও কিছু নেই।
-আপনি কিভাবে ফিরবেন
-আমি হেটে যাবো কিছুদুর, তারপর রাস্তায় উঠে বাসটাস একটা কিছুতে ঝুলে পড়বো।
-আমিও হাঁটবো। তারপর আপনার সাথে ঝুলে পড়বো
-পাগল তুমি?
এই ছিল আমাদের শুরু। তারপর অনেকটা সময় গড়িয়ে গেছে। একসময় আমিই ঝুলে গেলাম তোমার সাথে। বছরের পর বছর কেটে গেল। যাত্রপথ শেষ হয়ে এলো আমাদের। কিছুদিন পর টের পেলাম তুমি আমার ঝুলে থাকা পছন্দ করছো না। আবার ঝেড়েও ফেলছো না। আমি ঝুলে আছি অনিশ্চয়তার দোলনায়। আশা নিরাশার দোল একই সাথে। তুমি আমাকে ডেকে ভুল করেছিলে। ভুল করে ডেকেছিলে হয়তো। অথব আমি ভুল করে সাড়া দিয়েছিলাম। কিন্তু ওটা ছিল অনিবার্যতা। আসলে সময়ের ডাকেই সাড়া দিয়েছিলাম আমি। সময় বলেছিল ওই মুহুর্তে তোমার হাত ধরতে। আমি কখনো সত্যিকারের হাত ধরিনি তোমার। তবে মনে মনে কতোবার ধরা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
তখুনি তোমাকে দেখা গেল একটা রিকশায় হুড ফেলে রাজরানীর মতো এগিয়ে আসছো। পরনে তোমার লাল টকটকে একটা কামিজ কি ফতুয়া। আমি তোমাকে দেখে রাস্তা পেরুবার জন্য ছুটে গেলাম। উল্টোদিক থেকে ছুটে আসা ট্রাকটা খেয়াল করা হয়নি।
দুই পা হারিয়েও জানে বেঁচে গেছি। বেঁচেছে দুটো হাত। দুটো চোখ আর অমলিন স্মৃতিগুলো। হিসেব চুকে গিয়েছিল সেদিনই। তোমারও করার কিছু ছিল না। তুমি না থাকলেও স্মৃতিগুলো আমাকে পাহারা দিয়ে রাখে। প্রতিদিন আমি ডুব দেই স্মৃতির কুয়াশায়।
(অসমাপ্ত খসড়া)
মিড অফিসের ঝামেলায়
সিরাজ আমাকে প্রথমে ঝামেলাটার কথা জানায়। আমাদের অফিসের পিয়ন। পিয়ন হলেও তার ক্ষমতার দৌড় অনেকের চেয়ে বেশী। কব্জা ঘুরিয়ে বিগ বসের রুমে যখন তখন ঢুকে যাবার সাহস একমাত্র তারই আছে। ওই্ বাঘের গুহায় ঢুকতে আমাদের যেখানে দশবার ঢোক গিলতে হয়, সেখানে সিরাজ দিব্যি হাসিখুশী মুখে আসা যাওয়া করে। সিরাজের উপর বিগ বসের ভরসা এত বেশী একদিন কার উপর যেন হুংকার দিয়ে বলেছে, তার কাউকে লাগবে না, এক সিরাজকে দিয়েই চলবে অফিস। সে পারে না এমন কোন কাজ নেই। সে যেতে পারে না এমন কোন গন্তব্য ঢাকা শহরে নেই। সেক্রেটারিয়েট থেকে বিদেশী দুতাবাস সবখানেই তার যাতায়াত। বঙ্গভবন আর সংসদ ভবনই তার যেতে বাকী আছে এখনো। ওদিকে তার কোন কাজ পড়েনি। মোদ্দাকথা সিরাজ হলো সেই হরফুন মওলা যাকে দিয়ে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবকিছুই সম্ভব।
বসের সেই হুংকারের পর আমরা এমনিতেই তটস্থ ছিলাম আমরা মিড অফিসের পাঁচজন। মিড অফিসের রেঞ্জ জেনারেল ম্যানেজার থেকে ম্যানেজার পর্যন্ত। বাকী অফিসার, সহকারী অফিসার সব লোয়ার অফিসে নীচতলায় বসে। ওখানে আবার হৈ হুল্লোড় আনন্দ ফুর্তি। দোতলার মতো তটস্থ হয়ে থাকতে হয় না কখনো। মাঝে মাঝে হিংসাই হয় ওদের। দুটো পয়সা বেশী পাই বলে বুকের ভেতরটা সারাক্ষণ কেমন চুন হয়ে থাকে। টক খাওয়া গলা আর জিহবার তালু। আমার চেয়ে বেশী খারাপ বেলাল সাহেবের। উনি ঘন ঘন চা খাচ্ছেন আর বাথরুমে ছোটাছুটি করছেন। কলিং বেল বাজলেই ওনার রীতিমত কাশি শুরু হয়ে যায়। বেলাল সাহেব আমার পাঁচ বছরের সিনিয়র। যার গর্দান যত এগিয়ে তার ভয় তত বেশী। ভয়ের সিজনেও আমি মুখ ফসকে হেসে ফেলি।
-হাসেন কেন? ফূর্তি লাগে?
-না স্যার, ফুর্তি লাগে না। ভয়ে হাসি
-ভয়ে হাসেন মানে? ফাজলামি করেন? আমি বুঝি না ভেবেছেন? সিরাজকে দিয়ে বসকে কি বলেছেন আমি জানি। আমি সত্য কথাই প্রকাশ করবো। আমার ভয় নেই।
আবার কাশি শুরু হয়। বয়স্ক মানুষ। ষাটের কাছাকাছি। কদিন বাদে এমনিতেই রিটায়ার্ড হবেন। চোখের সামনেই দেদারসে কামিয়েছেন। ঢাকার অভিজাত এলাকায় তিনটা ফ্ল্যাট। প্লট আছে কয়েকটা। ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট আছে কোটি টাকার উপর। তবু চাকরীকে এত ভয়। আমি ভয় করি সঙ্গত কারণে। আমার চাকরীর মেয়াদ আরো দশ বছর আছে বলা যায়। কিন্তু গত বিশ বছরের ইতিহাস ধরলে চুরিধারিতে আমি একেবারে অযোগ্য। একটা গাড়িও কিনতে পারিনি। আগামী দশ বছর কি গতিতে কামাতে পারবো বুঝতে পারছি না। এই বুড়োটা সরে না গেলে কামাবার রাস্তা পরিষ্কার হবে না। যত বড় বড় দান তার হাতেই খতম হয়। সে যদি বোয়াল মাছ ধরে আমি ধরি পুটি মাছ। সে যদি গলদা চিংড়ি কব্জা করে, আমি হাতড়াই কুঁচো চিংড়ি।
আর চলছে না। এবার বদলাতেই হবে। নিজে না বদলালে দেশ বদলাবে না। নিজের উন্নতি মানে দেশের উন্নতি। এরকম মহান একটা চিন্তা আমার মাথায় কাজ করে সবসময়। আমি যেন আমার সাথে বাংলাদেশের একটা মিল খুঁজে পাই। বাংলাদেশও প্রচুর সম্ভাবনাময় দেশ। কিন্তু কোথায় যেন উন্নতিটা আটকে আছে। আমিও প্রচুর সম্ভাবনাময় মানুষ। কিন্তু উন্নতিটা আটকে আছে বেলাল সাহেবের জন্য। তাহলে বাংলাদেশের বেলাল সাহেবটা কে? ওটা আর খুঁজে পাই না। তবে এটা বুঝি যে আমার রাস্তা পরিষ্কার হলে বাংলাদেশটা অনেক উন্নতি করবে। আমার উন্নতি, বাংলাদেশের উন্নতি। বাংলাদেশের গাড়ি হবে, বাড়ি হবে, জমি হবে, বিদেশভ্রমন হবে, বাংলাদেশ হবে ইন্টারন্যাশনাল। আমি হবো..........ডিং ডিং কলিং বেলের শব্দ শুনে দার্শনিক ভাবনা বাধা পেল। স্বপ্ন মুছে গিয়ে সেখানে ধড়ফড় ধড়ফড় শব্দ জায়গা নিল।
সিরাজ বসের রুমে ঢুকে কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই ফিরে এল। সোজা আমার চেয়ারের দিকে আসছে। হাসি হাসি মুখ তার। এবার কি আমাকে যেতে হবে ভেতরে? আমি বেলাল সাহেবের দিকে তাকালাম। আজকে ওনার কোন কাশি নেই। এটা আমাকে আরো বেশী চিন্তায় ফেলে দিল।
কিন্তু না, সিরাজ আমার দিকে হাসিমুখে এগিয়ে এসেও শেষ মুহূর্তে গন্তব্য পাল্টে বেলাল সাহেবের টেবিলে গিয়ে দাঁড়ালো। বেলাল সাহেব একসময় বিগ বসের খাস লোক ছিল। বাংলাদেশে তেল ঘিয়ের দামের উর্ধ্বগতি ও বাজার সংকটের জন্য বেলাল সাহেবকে কিছুটা দায়ী করা চলে। বিগবস আসলে তাঁর হাতদুটো পরস্পরকে ঘষতে এত বেশি তেল ঘি ব্যবহার করে, সেটা মাঝে মাঝে চুঁইয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে এবং একদিন আমি তাতে প্রায় পা পিছলে পড়েই যাচ্ছিলাম। কিন্তু দিন বদলেছে। পিয়ন সিরাজ এখন নতুন তেলের আড়তদার। শোনা যাচ্ছে তেলের বাজারে সে এত আলোড়ন তুলেছে যে বড়সাহেব তাকে অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বেলাল সাহেব সেই থেকে চিন্তিত। তিনিই সিরাজকে চাকরীতে ঢুকিয়েছেন এবং তার প্রশংসার গুনেই বড়সাহেবের খাসলোক হতে পেরেছে সিরাজ। সেই সিরাজই তাঁর শেকড়ে কাঁচি বসাবে কে জানতো আগে। এখন জেনেও লাভ নেই। বড়সাহেব বেলাল সাহেবের বদলে সিরাজের সাথেই সব পরামর্শ করেন আজকাল। আড়ালে বেলাল সাহেব এখন গালি দেয় - 'শালা বেনিয়া বানচোত বিদেশী, তুই কি বুঝবি এই দেশে মানুষের স্ট্যাটাস।'
এই সব দেখেশুনে বেলাল সাহেব ছেড়ে দিচ্ছিলেন আজকাল। তবু সেদিন এই অবস্থাতেও তিনি বড়সড় একটা ঘাপলা করে ফেলেছেন। ঘাপলাটা আমি জানি, আরো বেশী জানি আমাকে ভাগ না দেয়াতে। বড় সাহেবকে আমি কিছু বলিনি। এমনকি সিরাজকেও না। কিন্তু বেনামিতে একটা মেইল দিয়েছি বড়সাহেবকে, বলেছি সিরাজকে দিয়ে বেলাল সাহেবের নতুন বাড়ির নির্মান সামগ্রীগুলোর একটু খোঁজ নিতে। বড় সাহেব খোঁজ নিয়ে দেখলেন ওই বাড়ির সিমেন্টের বস্তা, ইটের কোম্পানী, রডের কোম্পানী সবগুলো আমাদের নতুন কারখানার।
নতুন কারখানা তত্ত্বাবধানের প্রধান দায়িত্ব ছিল বেলাল সাহেবের উপর। কথা ছিল তিনি ওখানে যা কামাবেন তা থেকে আমাকে ২০% ভাগ দেবেন। কিন্তু বেলাল সাহেব ধূর্ত লোক। তিনি পুরোটা মেরে দেবার জন্য নগদ না নিয়ে মাল নিলেন। মালের ভাগ আমাকে দেবেন কী করে। আমার তো বাড়ি তৈরী হচ্ছে না কোথাও। সেই অজুহাতে তিনি নিজেই পুরোটা গিলে ফেললেন। গিলে ফেললেও কি হজম করা এত সহজ? দিলাম জায়গামত গিট্টু লাগিয়ে। এই কদিন আমার ফূর্তি যাচ্ছে তাই। আমার রাস্তা পরিষ্কার। এখন সিরাজ এসে নিশ্চয়ই ফাইনাল খবরটা জানাচ্ছে বেলাল সাহেবকে।
আবারো বড় সাহেবের বেল বাজলো ডিং ডং। সিরাজ দৌড়ে গেল ভেতরে। মিনিটখানেকের মধ্যেই বের হয়ে এসে জানালো বিগবস দুজনকেই ডেকেছে। আমি এবার চিন্তায় পড়লাম। ভেতরে গিয়ে দেখি বসের মুড খারাপ। সামনে একটা ফাইল রাখা। সেখানে স্ট্যাম্পে সই সাবুদ করা কিছু কাগজ। তার একটা আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন পড়ো। আমি পাতা উল্টে যা দেখলাম তাতে আমার অন্ন হজম হয়ে গেল। বেলাল সাহেব আর আমার যৌথ বাড়ি প্রকল্পের চুক্তি। আমার নাম সাক্ষর সবই আছে। হুবহু। আমি বেলাল সাহেবের দিকে তাকালাম। তিনি হেসে বললেন, বুঝলেন না ব্যাপারখান? আমরা সেদিন যে চুক্তিটা করছিলাম আমাদের বাড়ির পরিকল্পনা নিয়ে, সেটা বস দেখতে চাইছিলেন। আমি দেখালাম।
আমাদের?
দুজনেরই চাকরী চলে গেল একসাথে।
খসড়া বাটপাড়ি
লোকটাকে দেখে মনে হয়েছে এরকম পড়ে যাওয়া লোক দেখে অভ্যস্ত না সে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুয়ে আছি চুপচাপ। পা দুটো টান টান। জুতোর শব্দ পেরিয়ে যাচ্ছে, থামার লক্ষণ নেই। না, জুতোর শব্দ ফিরে আসছে। আবারো যাচ্ছে। আবারো কাছে আসছে। লোকটা মনে হলো অস্থির, কাউকে ডাকার চিন্তা করছে। ভালো লক্ষণ। একটা রিকশা এসে দাড়ালো মনে হয়। লোকটা কথা বলে উঠলো-
-দেখো তো এই লোকটাকে, হঠাৎ কি হলো?
-কি হইছে তার, কি হইছে
-কেমন করে পড়ে গেল
-এমনে এমনেই পড়ে গেল?
-আপনা আপনি, বোধহয় অসুস্থ।
-মাওলার ইচ্ছা, আমি আপনি কি করুম, আমার ভাড়া মারতে হবে, যাই
-আরে লোকটা তো মরে যাবে, তুমি একটু দেখো তো, কি হইছে, নাকি হাসপাতালে নিবা
-কাজ নাই, বেহুদা ঝামেলা
-আরে শোনো, এই টাকাটা রাখো, কোন হাসপাতালে নিয়ে যাও
-আরে সাহেব আমি কি এম্বুলেন্স নাকি, আমার এসব ঝামেলার টাইম নাই
-তবু একটু দেখো না ভাই
রিকশাওয়ার প্রতি মেজাজটা চড়ে যাচ্ছে। উঠে হারামজাদাকে একটা চড় দিতে ইচ্ছে করছে। ভদ্রলোক তারে ভাই ডাকছে তবু দিল নরম হয় না। তোর বাবা টাকা দিচ্ছে আগে নিয়ে নে, তারপর কথা। তবু সে কুতর্ক করে। আমি চোখ খুলতে পারবো না জুতোর শব্দটা চলে না যাওয়া পর্যন্ত। হঠাৎ বাজে গন্ধ নাকে এল। শালার শালা আমাকে মৃগী রোগী মনে করছে, স্যান্ডেল ধরছে নাকের গোড়ায়। পুরান গুয়ের গন্ধ। মানুষের গু না। কুত্তার গু হবে। আরে দম বন্ধ হয়ে মরে যাবো তো। বাধ্য হয়ে নড়ে উঠলাম।
-এই তো নড়ছে
-হ আমি ঠিকই ধরছিলাম, মিরকি ব্যারাইম্মা।
-ঠিকাছে তুমি ওকে দেখো, আমি গেলাম।
জুতার শব্দ মিলিয়ে যেতেই তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠলাম। রিকশওয়ালাকে দেখলাম। বয়স বেশী না। ধুর্ত চেহারা। আমাকে উঠতে দেখেই হাত মুঠ করে ফেলছে। টাকাটা লুকানোর চেষ্টা।
-ওই তোর জুতার গুষ্টি মারি, শালার গন্ধে মরে যাই, টেকা দে?
-কিসের টেকা
-সাহেব টেকা দিছে না হাসপাতালে নেবার জন্য
-কে কইছে
-আমি নিজ কানে শুনলাম
-ওই মিয়া, তুমি তো অজ্ঞান ছিলা, শুনলা কেমনে?
-অজ্ঞান বলে কান বন্ধ নাকি, দে টেকা দে কইলাম
-মিয়া তুমি দেখি ধান্ধাবাজ, অসুস্থ হও নাই
-সেটা দিয়ে তোর কাজ কি, ওই টাকা আমার চিকিৎসার, আমি হাসপাতালে যামু
-টেকার কথা বলছে দেয় নাই।
-তোর হাত দেখি
-হাতে কিছু নাই
-ওই হাতের মুঠের ভিত্রে কি
-ওটা আমার টেকা না। একজনে পাইবে তারে দিতে যাই
-মুঠ খোল বলতেছি
-কসম, সাহেবের টেকা না ওটা
আমি খপ করে ওর হাতটা ধরে মুঠ থেকে একশো টাকার নোটটা কেড়ে নিলাম। রিকশাওয়ালা চিৎকার শুরু করছে
-তুই ব্যাটা চিটিং, বাটপার, সাহেবের সাথে চিটিংবাজি করে টাকা নিছস।
-আমি সাহেবের সাথে চিটিং করছি, তোরে ডাকি নাই
-সাহেব আমাকে ডাকছে
-ডাকলে তার কাছ থেকে ভিজিট নিয়া আয়
-আমার স্যান্ডেলের গন্ধে তুই উঠছিস
-স্যান্ডেল না, উঠছি তোর গুয়ের গন্ধে, শালা বিষ্ঠা একটা
-ওই গালি দিবি না
-চোপ!
টাকাটা পকেটে পুরে আমি হাসপাতালের বদলে হোটেলের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। হোটেলে একটা টেবিলে বসে অর্ডার দিয়ে হাতমুখ ধুতে গেলাম। সাবান দিয়ে হাত ঘসছি এমন সময় পাশ থেকে একজন সাবানটা চাইল। সাবান দিতে গিয়ে দেখি লোকটা আমার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে আছি। আমি টেবিলে খেতে বসলাম, গোগ্রাসে খাচ্ছি লোকটা তখনো পাশের টেবিল থেকে তাকিয়ে আছে। আমি খাওয়া শেষ করে একশো টাকার নোটটা বের করে বিল দিলাম। লোকটার দৃষ্টি সেই টাকাটার দিকে। তার সামনে রাখা ধোয়া ওঠা কাপটার চা জুড়িয়ে জল, তবু তার তাকানো শেষ হয় না।
এই লোকটাই কি টাকাটা দিয়েছিল? হাত বদল হলেই টাকার মালিকানা বদল হয়ে যায়। লোকটার এত অবাক হওয়ার কি কারণ তাকতে পারে আমার মাথায় আসলো না। আমি আজকে নিয়তিকে মার দিয়ে পেটপুরে খেয়ে নিলাম। এটাই সবচেয়ে বড় কথা। আর কিছু ভাবতে চাই না।
অনির্ধারিত বিবর্তন
-মারি আইসসোছ না? মারি ন আইউছ? মাইর হাইয়েরে মাইয়া ফোয়ার ডইল্লা ইক্কাই ইক্কাই হাঁদদদে না ব্যাডা? যা দুরো ইঁউত্তুন। মাইর হাইয়েরে আঁর হাঁছে নোয়াবি। চো**নীর ফোয়ার মাথা ফুডাই আঁর হাছে আবি।
তীব্র ঝাড়িতে ইউনুস মিয়া পাড়ার হাড় জ্বালানো সাত বছরের ইসহাক মিয়াকে দুর করে দেয়। ইউনুস মিয়ার বিচার আচারের কায়দা ছিল এরকম। কর্কশ। কুৎসিত। ছেলেটা বাপের আশকারা পাবার পর কদিন বাদে ইট মেরে একজনের মাথা ফাটিয়ে ঘরে এল হাসতে হাসতে।
-আজিয়া এক চো**নীর ফোয়ার মাথা ফুডাই আসসি।
বাপ তাকে গোল্ড মেডেল দেবার মতো আনন্দে দুহাতে কোলে তুলে নেয়।
-এই তো বাফর ব্যাডা। এন্ডইল্লা গরিলি গম লাগে। তুই নইলে বাঁশখাইল্লা ইনুইচ্চার ফোয়া ন।
১৯৮০
একদিন ইউনুস মিয়ার কাছে আইসক্রীম খাওয়ার টাকা চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে ইসহাক মিয়া। ঘর থেকে তাড়া খেয়ে রাস্তায় নেমে বাপের চোদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করছে সে। বাপ ঘরের মধ্যে লাটি হাতে বসে আছে। ইসহাক মিয়া ঘরে ঢুকতে পারছে না মারের ভয়ে। রাস্তায় দাড়িয়ে খিস্তি করেই যাচ্ছে। তার একটা চরম বাক্য হলো -"চো**নীর ফোয়া বাফর গুষ্টি মারি। তুই নমরিবি? তুই মইরলে তোর হবরত যাইয়েরে ফত্তিন উগ্গা গরি লাথি মাইরগুম।
১৯৮৫
কলেজ থেকে ফেরার পথে গলির মুখে মুখোমুখি হলাম ইউনুস মিয়ার বউয়ের। আলুথালু বেশ। সে ছুটে এসে বললো, "অবা তুই ইসহাকরে ইক্কিনি গরি ডাহ না। ইতে গরত ন আইয়ের। উন্দি গোস্বা অইয়েরে হারাই রইয়ে।" স্কুলে ইসহাক আমাদের সাথে পড়তো। কিন্ত ক্লাস এইটের পর তাকে আর স্কুলে দেখা যায়নি। বখে গিয়েছিল। পকেটে ছুরি নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। স্কুল সেখানেই ইস্তফা। এখন শুনছি ছিনতাইও করে। তবু এতদিনের প্রতিবেশী তাছাড়া আমাদের স্কুলে একই ক্লাসে পড়তো একসময়। ভয়ের কি আছে। গেলাম ডেকে আনতে। নালাপাড়া বাজারের মসজিদের কাছে গিয়ে দেখলাম এই ভর দুপুরে মদ খেয়ে দুলছে আর খিস্তি করছে অবিরাম। তার সাঙ্গপাঙ্গরা অশ্লীল ভঙ্গীতে হাসতেছে। ইসহাকের চোখ লাল। আমাকে দেখে চিনতে পারলো না বোধহয়। অচেনা এমন দৃষ্টিতে তাকালো, তাতে আমি শিউরে উঠলাম। তবু কাছে গিয়ে সাহস করে বললাম,"ইসহাক, তোরে তোর মা ডাকের।" কথা শুনে ইসহাক এমন একটা খিস্তি করলো, আমি কানে দুহাত দিয়ে একটা রিকশায় উঠে পড়লাম।
১৯৯০
খুন ধর্ষন ডাকাতি ছিনতাই ইত্যাদি অভিযোগে ইসহাকের দশ বছরের জেল হয়ে গেল। এলাকাবাসী স্বস্তি পেল।
২০০৫
সময় চমকে গেল একদিন। জেল ফেরত ইসহাক কয়েক বছরের মধ্যে হাজি ইসহাক মজুমদার হয়ে ইলেকশানে দাড়িয়ে গেল। হাজিসাব ইলেকশানে জিতে মসনদে আসীন হলো। চেয়ারম্যান সার্টিফিকেটের জন্য আমাকে একদিন তার দরবারে হাজির হতে হয়। বাল্য পরিচিত হিসেবে সার্টিফিকেটের সাথে এক কাপ চাও জুটে যায়।
ওভার ট্রাম
কিন্তু কিছুই হলো না। আমি সময়মতো মরলাম না। চাকরীর মেয়াদ শেষ হয়েছে পাঁচ বছর আগে, কিন্তু জীবনের মেয়াদ কতোদিন বাকী বুঝতে পারছি না। দিন দিন খরচ বাড়ন্ত। সংসারের উপর আমি একটা বোঝা হয়ে আছি। বোঝা হতাম না যদি শরীরের সবগুলো ফাংশন ঠিকঠাক কাজ করতো। এখন যেসব ফাংশন কাজ করে না তার মেরামতির জন্য ডাক্তার বৈদ্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ছোটাছুটি করতে হয়। সেই ছোটাছুটি করতে গিয়ে সংসার খরচে টান পড়ে যাচ্ছে। বউ ছেলেমেয়ে মৃদু অসন্তুষ্ট দেখে বোঝা যায়। ৬০ বছর পর্যন্ত ঠিক ছিলাম। চাকরীর মেয়াদ শেষ হলো ৬১ তে এসে। তারপর থেকে সমস্যার শুরু। ভাগ্য ভালো যে চাকরীর শেষ ভাগে সততা ঝেড়ে ফেলে বাড়তি কিছু কামাই করতে মন দিয়েছিলাম। নইলে এই অবসর জীবন কুকুরের চেয়ে অধম হতো।
শরীর একটু বেশী খারাপ লাগলে সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে যায়। চেহারায় মেঘের ছায়া ভাসে। কিন্তু মেঘের আড়ালে কি তা আমি জানি। ওদের চেহারা দেখে আমি দিব্যি অনুবাদ করতে পারি মনের ভাষা। ওরা চায় মরার আগে আমি সবকিছু ভাগ করে দেই। তারপর সময়মতো মরি। বউ চায় আমি যেন আমার ব্যাংক ব্যালেন্সের সমস্ত খবর ওকে জানাই। কিন্তু সেই যে ইনকামট্যাক্সের ভয়ে চোরাই একাউন্ট করেছিলাম কয়েকটা। সেগুলো এমনকি বউকে জানাতে ভরসা পাই না। মরার আগে ট্যাক্সের লোক এসে গ্যাঁক করে ধরুক তা চাই না। মরে যাবার পর তোরাই তো মালিক হবি সবকিছুর। এত চিন্তা কিসের। তখন তোদের এই টাকা ভোগ করতে সমস্যা হবে না। উত্তরাধিকারী সম্পদের উপর কোন ট্যাক্স নাই। নিজের মতো করে ভোগ করবি। আমি সবগুলো একাউন্টের খোঁজ খবর একটা দলিলে লিখে তালা মেরে রেখেছি। মরার পর তো সবই খুলে খুলে খুবলে খুবলে দেখবি।
কিন্তু আজকাল কলকব্জাগুলো যেভাবে নষ্ট হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে বেঁচে থাকতেই ওদেরকে আমার ব্যাংকের খবর জানিয়ে দিতে হবে। এখন একটা চেক সই করতে দশটা খসড়া করতে হয়। খালি হাত কাঁপে। কদিন পর ব্যাংক আর এই চেক গ্রহন করবে না। এটা নিয়ে চিন্তায় পড়লাম। উকিল সাহেবকে ডাকিয়েছিলাম সেদিন পরামর্শ করার জন্য।
উকিলের সাথে অনেক বুদ্ধি পরামর্শ করার পর দুপুরে খাওয়া দাওয়া করা হলো। খেয়ে দুজনে আমার ঘরে গল্প করছি এমন সময় উকিল ব্যাগ থেকে একটা স্ট্যাম্প বের করলো। লাল সবুজ দুই পাতা স্ট্যাম্প। আমি চশমা চোখে দিতেই চোখের সামনে যে বাক্যগুলো ভেসে এলো তাতে আমার মাথা চক্কর দেয়া শুরু করলো। উকিল সহজ করে জানালো এটা আমার স্ত্রী ছেলেমেয়ের সম্মতিতেই করা হয়েছে। পড়তে পড়তে দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় যাবার সাথে সাথে আমি চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করি। তারপর কিছু মনে নেই।
হাসপাতালের ধবধবে বিছানায় চোখ মেলার পর নার্স বাদে আর কাউকে দেখলাম না। মনে পড়লো সমস্ত পরিবার মিলে এমন একটা দলিল ড্রাফট করিয়েছে যে আমি স্বেচ্ছায় সকল সম্পত্তি টাকা পয়সা পরিবারের সদস্যদের দান করে বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাচ্ছি। এত বছরের সংসারের জোয়াল টানার পুরস্কার। আমি মোটামুটি বুঝে গেলাম আমার প্রতি পরিবারের কি মনোভাব। কিছুদিন আগেই খানিক আঁচ করেছিলাম। এখন নিশ্চিত হলাম। আরো জানা গেল ওরা একটা ডেভেলাপার কোম্পানী থেকে এক কোটি টাকা আগাম নেবার কথাবার্তা পাকা করে ফেলেছিল। এই অবস্থায় আমি আর ঘরে ফিরতে ভরসা পাচ্ছি না। খুন টুন হয়ে যাওয়া বিচিত্র না। কিংবা খাবারে বিষ। আমার তিন ছেলে দুই মেয়ে। সবচেয়ে ছোট ছেলে ভার্সিটিতে পড়ে। এতদিন ভাবতাম সেই আমাকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে। কিন্তু এখন নিশ্চিত না।
কিছু আত্মীয় স্বজন এলো বিকেলে। তার কিছুক্ষণ পর আমার স্ত্রী। সাথে বড় ছেলে। সে মাকে নামিয়ে দিয়েই চলে গেল কাজে। বউ প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে সবাইকে জানালো কিরকম দুশ্চিন্তায় ওদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে ওদের। আমি চশমা ছাড়া ভালো দেখি না। চশমাটা লাগিয়ে বউয়ের মুখে উদ্বেগের ছায়া খুঁজলাম। আমার জন্য শেষ করে উদ্বিগ্ন হয়েছে সেটা ভুলে গেছি। আরো বিশ বছর আগে হলে বিশ্বাস করতাম। আত্মীয়রা যাবার পর আমাকে পেছন দিয়ে বসলো বউ। আমার সাথে আর কোন কথা নেই। রাগ হয়েছে বুঝেছি। ভেবেছিল এ যাত্রা টিকবো না। টিকে গেছি বলে চরম অসন্তুষ্টি। আমার শরীরের চেয়েও ওকে নেবার জন্য কেউ আসছে না কেন সেটার জন্য বেশী চিন্তিত।
আমি বললাম, "রাতে এখানেই থেকে যাও"।
শুনে শিউরে উঠলো সে। "মাথা ঠিক আছে তোমার? আমি না থাকলে সংসার কি করে চলবে? ছেলে বউরা এখনো কি বোঝে? আমাকেই সব দেখতে হয়। সংসার যন্ত্রনায় অতিষ্ট হয়ে গেলাম। একটু যদি শান্তি পেতাম। মরলে তবু বেঁচে যেতাম"। শেষ বাক্যটা শুনে বুঝলাম না আমার কথা বললো নাকি তার কথা।
কনিষ্ঠ সন্তানটা এসে নিয়ে গেল ওর মাকে। আমি এখন থেকে একা। চোখ বন্ধ করে ভাবলাম এক জীবনের কথা। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছি, হঠাৎ একটা স্বপ্ন দেখে ধড়ফড় করে জেগে উঠলাম মাঝরাতে। বুঝতে পারছিলাম না এটা কোন জায়গা। আমি একা কেন? কিছুক্ষণ পর বুঝলাম একা থাকার রহস্য। বাতি জ্বালালাম। বাথরুমে গেলাম। শরীরটা অনেক হালকা এখন। বারান্দায় গিয়ে দেখি চারদিক চুপচাপ। সবাই ঘুমিয়ে। কে একজন হাসপাতালের গেটে দাড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। অন্ধকারে তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। আমি স্বপ্নটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলাম।
পরদিন ভিজিটিং আওয়ার শেষে ডাক্তার এলে তা কাছে একটা আবদার পাড়লাম। পরিচিত ডাক্তার। আবদারে কান দিল।
প্রায় এক সপ্তাহ পর রিলিজ করার দিন সবাই দল বেধে নিতে এল আমাকে। ঢং এর ফুলটুলও নিয়ে এসেছে কে জানি। ব্যাপক হৈ চৈ বাধিয়ে দিল। আমি হৈ চৈ থামতে বলে সবাইকে গোল হয়ে দাড়াতে বললাম আমার চারপাশে। তারপর বলতে শুরু করলাম......
"আমার প্রিয় পরিবার। আমি জানি তোমরা আমাকে কত ভালোবাসো, আমিও তোমাদের অনেক ভালোবাসি। ভালোবাসতে বাসতে আমরা সবাই একটু ক্লান্ত তাই আমাকে বিশ্রামের জন্য হাসপাতালে আসতে হলো। আমার এত বয়সে এই প্রথম হাসপাতালে আসলাম তার সমস্ত কৃতিত্ব তোমাদের(এখানে একটু গুঞ্জন উঠতে শুরু করলে আমি থামিয়ে দিলাম)। বুঝতে ভুল কোরো না। আমি এত বছর হাসপাতালে আসিনি তোমাদের যথাযথ নজরদারির জন্য। তোমরা সবসময়ই আমাকে অনেক যত্ন করেছো, গুরত্ব দিয়েছো আমার মতামতের। সেদিন আমি তোমাদের উপর নাখোশ হয়েছিলাম ভুল বুঝে, তাই অঘটন ঘটতে যাচ্ছিল। আমি হাসপাতালে কদিন একা একাই ঘুমিয়েছি। আমাকে সেই সুযোগ করে দেবার জন্য তোমাদের ধন্যবাদ আবারো। খুব বেশী মানুষ হাসপাতালে একা ঘুমাবার সুযোগ পায় না। এই কদিন একা একা শুয়ে আমার যা উপলব্ধি হলো তা তোমাদের সেদিনকার দলিলের বক্তব্যকে সমর্থন করে। অর্থাৎ আমি এখন হংস মাঝে বক। বাড়িতে থাকার যোগ্যতা আমার শেষ হয়ে গেছে। আমি তোমাদের ইচ্ছেমতো বৃদ্ধাশ্রমকেই থাকার জন্য বেছে নিলাম। (আবারো হৈ চৈ উঠে গেছে)। চুপ করো সবাই। সময় শেষ হয়ে আসছে। আমি গতকাল সমস্ত আইনী কার্যক্রম সম্পাদন করে রেখেছি। এখন আমাকে নেবার জন্য বৃদ্ধাশ্রম থেকে গাড়ি পাঠানো হয়েছে। আমি বাড়িতে না গিয়ে সেখানেই যাচ্ছি। আমি যতদিন বাঁচবো বাকীদিন ওই বৃদ্ধাশ্রমেই থাকবো, ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিটের আয় থেকে বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানায় মাসিক দশ হাজার টাকা পাঠানো হবে। বিশ হাজার টাকা পাঠানো হবে বাড়িতে। মৃত্যুর পর দাফনকাফন সবকিছু করার জন্য বৃদ্ধাশ্রমকে দায়িত্ব দেয়া গেল। আর সমস্ত সম্পত্তি আমার মৃত্যুর পর ভাগ ভাটোয়ারা হবে ইসলামী শরীয়ত মতে। ব্যাংকের কাছে একটা সার্টিফায়েড কপি পাঠিয়ে দিয়েছি। তোমাদের সবার জন্য একটা করে কপি করা আছে। আমার কথা শেষ। যারা আমাকে বিদায় জানাতে চাও আশ্রমের গাড়িকে অনুসরন করে আসো"
আমি নীচে নেমে 'সময়াক্রান্ত' নামক আশ্রমের গাড়িতে উঠে বসলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম না কেউ আসছে কিনা।
Thursday, December 6, 2012
হৃদয়ঘটিত
আমি একসময় চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতাম মানুষকে। শ্রীকান্ত পড়ার পর 'মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকাও ভালো' দর্শনে বিশ্বাসী হয়েছিলাম। একসময় তার বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে শুরু করি। বিশ্বাসের স্তম্ভগুলোর মধ্যে ফাটল ধরতে শুরু করলো। আমার ভিত নড়ে যাবার যোগাড় হলো। তখন বিশ্বাস অবিশ্বাস দুটোর মাঝামাঝি দর্শনে আসলাম। মানুষকে অবিশ্বাস করা একটা কষ্টকর কাজ। তাই প্রথম দেখায় যে কোন মানুষকে বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝামাঝি সংশয় অবস্থানে রাখি। সময় নিয়ে বিশ্বাস করি। ১০০% বিশ্বাস ব্যাপারটাই ভুল। খুব বিশ্বাসী মানুষও বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারে প্রতিকূল সময়ে। তাই পূর্ন বিশ্বাসেও ফাঁক রেখে দেই। ঠকলেও যেন একটা শান্ত্বনা থাকে। ১০০% বিশ্বাস করে ঠকার পর একটা গাধানুভুতি হয়। অন্ততঃ গাধার মতো ঠকতে চাইনা।
চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতাম ডাক্তার আর হাসপাতালের রিপোর্টকেও। একদিন সেই বিশ্বাসেও ফাটল দেখা দিল। সব ডাক্তার সঠিক কথা বলে না। সব ডাক্তারের পড়াশোনা আপডেট না। গুগলের সাথে বন্ধুতা হবার পর থেকে আমি ডাক্তারের অনেক প্রেসক্রিপশানে ভুল পেয়েছি। ডায়গনস্টিক সেন্টারের রিপোর্টে প্রচুর ঘাপলা। একই রক্তের একই টেষ্টের রিপোর্ট দুটো ল্যাবে দুরকম আসে। কারটা সঠিক বিশ্বাস করা মুশকিল। এখানেও আমি সংশয়ে থাকি। আমার ডাক্তার বললেন আমার জন্য ডিম মাংস চিংড়ি মাছ খাওয়া হারাম। কিন্তু বৃটিশ হার্ট ফাউন্ডেশান আর আমেরিকান হার্ট ফাউন্ডেশান(নাকি এসোসিয়েশান) সুত্রে জানা গেল আগে ডিম হারাম ছিল ঠিকই, কিন্তু এখন আর হারাম নয়, কারণ ডিমের কোলেস্টেরল সরাসরি রক্তে মেশে না। সুতরাং ওটা সপ্তাহে কয়েকটা খাওয়া যেতে পারে। আমার চিংড়ির ব্যাপারে আমেরিকানরা বলছে ওটা খেলে ভালো কোলেষ্টেরল বাড়ে। সুতরাং ওটা খাওয়া জায়েজ। আমার মূল সমস্যা আসলে কোলেষ্টেরলে না, আমার সমস্যা ট্রাইগ্লিসারাইড বা টিজি। টিজি বেশী হয় কার্বোহাইড্রেট বা মিষ্টি জাতীয় খাবার বেশী খেলে। এটা আমি জেনেছি ইন্টারনেট ঘেটে দুনিয়ার বড় বড় সব হাসপাতাল ডাক্তারের চেম্বার ঘুরে। কিন্তু আমার ডাক্তার বিন্দুমাত্রও ইঙ্গিত দেননি যে কার্বোহাইড্রেট বর্জন করা উচিত। এরকম উদাহরন আরো দেয়া যায়। আমরা ডাক্তারের কাছ থেকে সঠিক তথ্য পাই না। আমাদের ডাক্তারগন রোগীর সাথে খোলামেলা আলাপে আগ্রহী না। রোগীর এত জেনে কাজ কি, ওষুধ দেবো সেই মতে খাবে ব্যস।
কদিন থেকে বুকের বামপাশটা ব্যথা করছে। ঠিক যেখানে ব্যথা করলে হার্টের সমস্যা সেখানে। কিন্তু আমি ডাক্তারের কাছে যেতে ভরসা পাচ্ছি না। চট্টগ্রামে এই বিষয়ে যে ডাক্তার আছে তাদের উপর আমার বিশ্বাস নষ্ট হয়েছে। ঢাকা হার্ট ফাউন্ডেশানে যেতে পারি। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। আমাদের যে খাদ্যাভ্যাস সবারই একসময় হার্ট কিডনী লিভার এসবের সমস্যা হবে। আমার আশপাশের অনেকের হয়েছে আমার বয়সেই। আগে যে সমস্যা হতো ৬০ পার হবার পর, এখন তা ৪০ পার হবার পরেই দেখা যায়। দেশ অনেক এগিয়েছে, দেশের মানুষও। ডায়গনস্টিক সেন্টারগুলোকে রোগীর ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়।
আজকাল কোনরকম চাপ সহ্য হয় না। সেদিন একটা বইতে পড়ছিলাম অধিকাংশ হার্টের সমস্যা হয় কোন না কোন মানসিক চাপের কারণে। খাদ্যের চেয়েও টেনশানের প্রতিক্রিয়া অনেক বেশী ক্ষতিকারক। আমার তেমন কোন টেনশান নেই। তবে কিছু চাপ আছে। মানসিক চাপগুলো এড়িয়ে থাকতে চাইলেও পারা যায় না। কাজের চেয়ে অকাজের চাপই বেশী।
নন্দলালের মতো কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবছি - চাপা চাপা ব্যথা, ঔষধ দিব কোথা!
করার কিছু নাই। যখন যা হবার হবে। হলে হোক, চলে যাবার হলে যাবো চলে। অবশিষ্ট পৃথিবী ফেলে।
Tuesday, December 4, 2012
জ্ঞানী কথা (!)
২. দূরত্ব কোন ব্যাপার না। কোন মেরুতে আছি সেটাই ব্যাপার। সূর্য শীতকালে নিকটে থাকলেও উত্তরগোলার্ধ সবচেয়ে বেশী ঠাণ্ডায় ভোগে।
৩. ভালো বন্ধু দূরে থাকাই নিরাপদ। নিয়মিত ক্যাচালের চেয়ে অনিয়মিত যোগাযোগ ভালো।
৪. নিজেকে নিজে কফিনে পুরতে পারো, কিন্তু নিজের কফিনের শেষ পেরেকটা অন্যকে ঠুকতে হয়।
৫. সকল শুভ্রতা আলোর নিশানা দেয় না। কুয়াশার মতো শ্বেত অন্ধকার আর কি আছে?
৬. সময়ের বয়স বাড়ে না
Monday, November 26, 2012
দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড
তোমার বুকে যা ঘটছে তা কোন দুর্ঘটনা নয়,
দুর্ঘটনামণ্ডিত হত্যাকাণ্ড।
......................
...............................
...............
...........................
.......................
মানুষের সাথে সাথে দাহ হয় মহাকালের বার্তা।
মানুষের সাথে সাথে থেতলে যায় মানবিকতা।
...............
...........................
.......................
আশুলিয়া থেকে বহদ্দারহাট-
মানুষ, তোমার চেয়ে অন্ধকার কেউ নয়।
Sunday, November 25, 2012
অতীত চর্বন-১
আমার একটা বাগান ছিল সেখানে কোনদিন গোলাপ ফোটেনি। আমার বাগানে আগাছারাই অধিক স্বচ্ছন্দ। আমি যখন পথে পথে হাটি, বনে বানাড়ে যাই, অবহেলিত বুনো ফুলেরা আমাকে হাতছানি দেয়। আমি সাজানো বাগানের চেয়ে অবহেলিত আগাছাদের মধ্যে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। ছেলেবেলায় একটা আগাছার বাগান ছিল আমার। দুটো আগাছা ফুলের ঝোপ ছিল আমার, আমি তাদের যত্ন করে রাখতাম। তাদের কোন নাম ছিল না বলে আমি দুটো নাম দিয়েছিলাম। অ্যালাবি চাইল্ড আর কেন্টাকি ফস্টার। একটায় হলুদ আরেকটায় বেগুনী ফুল ফুটতো। নামের কোন অর্থ ছিল না, কেবল বিদেশী নাম দিয়ে আগাছাদের সম্মান দিয়েছিলাম। ভেবেছি এই গাছ দক্ষিন আমেরিকার আমাজনে জন্মালে নিশ্চয়ই এরকম কোন নাম হতো। নামগুলো সেই বুনোফুলের মনমতো হয়েছিল কিনা কোনদিনও জানা যাবে না। তবু যে জীবন আগাছার, যে জীবন পরগাছার মানুষের সাথে তার কোন কোনদিন দেখা হয়েও যায়।
আমার একটা পোষা টিয়া ছিল। আমার সাথে তার ঝগড়া হতো খুব। আমাকে দেখলেই খাচার ভেতর থেকে আঙুল কামড়ে রক্তাক্ত করতে চাইতো। আমি তাকে কথা শেখাতে চেয়েছিলাম বলে সে হয়তো বিরক্ত। অথবা যে তাকে ধরে খাঁচায় পুড়েছে সে আমার স্বজাতি বলে। একদিন আমি তার খাঁচা খুলে মুক্ত করে দিলাম। কিন্তু ছাড়া পেয়েও সে কোথাও যায় না। খাঁচার বাইরে আসতে ভয় পায়। আমি তাকে জোর করে খাঁচা থেকে বের করে উড়িয়ে দিলাম। একটু উড়ে সে আবার খাঁচার ভেতরে ঢুকে যায় গুটিশুটি মেরে। সে ধরে নিয়েছে খাঁচার বাইরের জীবন নিরাপদ নয়, খাঁচার আশ্রয়েই তার গোটা জীবন।
Sunday, November 18, 2012
বান্দরবানের পাহাড়ি রিসোর্টে
রেস্তোরার সামনে একটা জালি দেয়া ঘরে বাচ্চাদের জন্য লাফালাফি করার একটা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ওটা পেয়ে ওশিনরা তুমুল উৎফুল্ল। সারাক্ষণ কেবল লাফাতেই আছে। আমরা আর কোথাও যাইনি। রিসোর্টেই পাহাড় জঙ্গল দেখে ঘুরে কাটিয়েছি। রেস্তোরায় বসে আড্ডা দেয়া, কটেজে ফিরে কিছুক্ষণ গড়াগড়ি। তারপর আবারো রেস্তোরা। পাহাড়ে একটু ঘোরাঘুরি। ছবি তোলাতুলি ইত্যাদি। দিনভর এই করেই কেটেছি। পাহাড়ের বাতাসটা এত মিষ্টি একদম নেশা ধরিয়ে দেয়। আর ইচ্ছে করে ওখানেই থেকে যাই দিনের পর দিন। হঠাৎ হঠাৎ মেঘ এসে ঘিরে ধরে আমাদের। তখন ঝাপসা দশ দিগন্ত। মেঘগুলো এখানে বড্ড নীচুতে ওড়ে। হাত দিয়ে ছুয়ে দেয়া যায় প্রায়।
মাত্র দুদিন আয়েশ করেছি পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে। ফিরে আসার পর মনে হচ্ছে যেন সাতদিন কাটিয়ে এলাম। তবু আবারো ফিরে যাবার হাতছানি। আরো দূর পাহাড়ে। এবার আরো দীর্ঘ সময়ের প্রতিশ্রুতি।
Monday, November 5, 2012
এই হেমন্তে
দিনের এই সময়টাতে মানুষের মনটা সবচেয়ে পবিত্র থাকে। এই সময়টাতেই প্রিয় স্মৃতিগুলো হাতড়ে বেড়াই। গান শোনার সাথে স্মৃতিচারণের একটা গভীর সম্পর্ক আছে। একেকটা গান একেক রকমের স্মৃতি ধারণ করে রেখেছে। আমি পুরোনো গানই বেশী শুনি। পুরোনো মানে বহুবার শোনা গানগুলো।
নতুন গান আমাকে তেমন টানতে পারে না যদি না চমৎকৃত হবার মতো কিছু না হয়। সেরকম একটা গান "আমার মতে তোর মতন কেউ নেই" লোপামুদ্রা গেয়েছে 'হেমলক সোসাইটি'র জন্য। ছবিটা দেখার আগেই গানটা পেয়েছিলাম এক বন্ধুর কাছ থেকে। ওটাও আমার দৈনিক পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে।
আমার দৈনিক সঙ্গীত পরিবারের সদস্য সংখ্যা দুইশোর মতো। এখানে বাংলা ইংরেজি হিন্দি অসমীয়া ভুটানী এরকম নানান জাতের নানান ছন্দের গান আছে। র্যান্ডম সিলেকশান দেয়া আছে গানের যন্ত্রে। কোন গানের পর কোন গানের উদয় হবে আগে থাকে জানা থাকে না বলে ওটাও একটা চমক। নিজেকে নিজে চমকে দেয়া যেন। দেখা যায় কোন একটা গান র্যান্ডম সিলেকশানে আমার কানে আসতে একমাসও লেগে যায়। অনেকদিন পর হঠাৎ ভালো লাগা কোন গান শুনলে অদ্ভুত ভালো লাগা ভর করে। গান শোনা আর বই পড়ার জন্য আমার একাকী সময় পছন্দ। কেউ পাশে থাকলে আমি স্বস্তি পাই না। যদি কেউ থাকে তাকে অবশ্যই চুপ করে বসে থাকতে হবে। কথা বললেই সব আনন্দ পন্ড।
সকাল থেকে সূর্যের দেখা নেই। এখন একটু আলোর রেখা মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে কোলাহল বাড়ছে। রাস্তায় যানজট শুরু হয়ে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে। ফুটপাতে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে একটা মানুষ। এরকম মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এদের কোথাও যাবার নেই। এদের কোন কাজ নেই। অন্ন বস্ত্র বাসস্থান সবখানেই কেবল 'নেই'।- আমাদের মতো সুবিধাবাদীরা এদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাই আর এদের জন্য বাধা গান শুনে উদাস হই।
Thursday, November 1, 2012
আমাদের সেই গ্রামের নামটি..........
Monday, October 22, 2012
মধ্যবিত্ত সংকট ভাবনা
মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংকটগুলো প্রায় একই। এরা একটা চক্রের মধ্যে আবদ্ধ থেকে যায় সারাজীবন। সেই একই ফর্ম, একই ফরমূলা। জীবনটা যেন একটা আগাম তৈরী করে রাখা টেমপ্লেট। নির্ধারিত ছকের বাইরে কেউ যেতে চায় না, কিংবা পারে না। কেউ কেউ, যারা এই আবর্ত ভেঙ্গে বেরিয়ে যেতে পারে, তারা জীবনের ভিন্নতার স্বাদ নিতে পারে। আমি নিজে কখনো কখনো ভেবেছি এই চক্র ভেঙ্গে বেরিয়ে পড়বো। পৃথিবী আমারে চায়.... রেখো না বেঁধে আমায়......।
না কেউ বেঁধে রাখেনি, ছাত্রজীবন শেষ হতে না হতেই নিজের শেকলে নিজেই আটকে পড়েছি। আর বেরুনো হয়নি চক্র ভেঙ্গে। জীবনের গতানুগতিক টেমপ্লেট ধরেই চলতে শুরু করেছি। একসময় আবিষ্কার করলাম আমি শেকল ছেড়ার স্বপ্ন ভুলে গিয়েছি। আমার আর কোন স্বপ্ন নেই। আমি সেই পুরোনো পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। যে পথে আমার পূর্বপুরুষ গিয়েছে। এই পথে তারা জীবনের নানান সময়ে সংকটে পড়েছে। মধ্যবিত্ত সংকটের মধ্যে দুটো প্রধান সংকট পারিবারিক এবং আর্থিক। পারিবারিক সংকট হলো বন্ধনের টানাপোড়েন আর ভারসাম্যের ত্রিকোনোমিতি। আর্থিক সংকট হলো যৌবনে উদ্দাম সুদিন কাটিয়ে পড়ন্ত বয়সে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ। এই দুই সংকটের বাইরে আমি কোন মানুষকে যেতে দেখিনি।
আমি এখনো কোন সংকটের মুখোমুখি হইনি। কিন্তু আমি যে টেমপ্লেটের আওতায় আছি সেখান এই সংকটের আগমন অনিবার্য। আজ হোক কিংবা দশ বছর পর হোক। বেঁচে থাকলে সেই সংকটের মুখোমুখি হতেই হবে। তবু দুঃসাহস নিয়ে ভাবি, আগামী প্রজন্মকে এই সংকট থেকে মুক্ত করার জন্য কি করা উচিত? সেরকম কোন ক্ষমতা আমাকে দেয়া হয়েছে? এই সংকট থেকে বেরুতে হলে দেশ ছাড়তে হবে। দেশ বদল করতে হবে। কিন্তু দেশ বদল করার মতো মানসিক শক্তি এখনো গড়ে ওঠেনি আমার। সতীর্থদের কেউ কেউ বদল করেছে। তাদের দিগন্তরেখা পাল্টে গেছে। তারা কি এখন সুখী? এতদূর থেকে এত কঠিন প্রশ্ন করার কোন মানে হয় না। উত্তর কক্ষচ্যুত হতে পারে। আজকাল মধ্যবিত্ত জীবনের সংকটগুলো খুব বেশী ভাবাচ্ছে।
Thursday, October 18, 2012
এই শহর জানে........
.
শহরের কোথাও উন্মুক্ত ময়দান অবশিষ্ট নেই। স্কুলের মাঠগুলো বাদ দিলে বাকী সবগুলো জায়গায় দালানকোঠা উঠে গেছে। পরিবার নিয়ে কোথাও গিয়ে দম ফেলার একটা জায়গা নেই। কয়েকটা এন্টারটেইনমেন্ট পার্ক আছে তাতে প্রকৃতিকে যতটা সম্ভব বিসর্জন দিয়ে কংক্রিটের সাম্রাজ্য বানানো হয়েছে। সেগুলোও গিজগিজ করছে মানুষ। কোথাও গিয়ে শান্তি নেই। এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের শহরে একটা গাছপালায় ভরপুর সবুজ পার্ক থাকতে পারতো না?
.
আমাদের ছেলেবেলা কেটেছে আগ্রাবাদে। সিজিএস কলোনীর সবুজ মাঠে হেসে খেলে কেটেছে আমাদের শৈশবের আনন্দময় দিনগুলো। এত সুন্দর শৈশব খুব বেশী মানুষ পায় না। যে কোন শিশুর শৈশব এরকম একটা সবুজ কলোনীতে হওয়া উচিত। বুক ভরে শ্বাস নিতে পারবে তেমন একটা জায়গা। এ যুগের বাচ্চাদের বন্দী থাকতে হয় কংক্রিটের খাঁচায়। বড় জোর ছাদের কংক্রিটে গিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে। তার সীমানা আটকে গেছে সেখানেই। টেলিভিশন, কার্টুন, আর কম্পিউটার গেমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ শৈশবের আনন্দ। আমি আমার শৈশবের দিনগুলো খুব মিস করি।
.
মিস করি বেপারীপাড়ার বাড়িটাকেও। বাড়ির চারপাশ উন্মুক্ত ছিল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ। প্রথম কয়েক বছর সেই সৌন্দর্য নিয়েই আমাদের দিন কেটেছে। শহরের মধ্যে জানালা খুলে বিস্তৃর্ণ ধানক্ষেত দেখার সৌভাগ্য খুব বেশী মানুষের হয় না। মগজের ভিডিওতে সব রেকর্ড করা আছে। প্রযুক্তি কখনো সেই ভিডিওকে কনভার্ট করার সুযোগ দিলে দেখাবো কী অসাধারণ সব দৃশ্য রক্ষিত আছে করোটির ভেতরে।
.
স্মৃতিতে আটকে আছি আমি। কাহলিল জিবরান বলেছিলেন, Remembrance is a form of meeting. Forgetfulness is a form of freedom.
.
আমি মুক্তি পেতে চাই না। তাই আমি ভুলি না। আমার শহর নিয়ে একটা স্মৃতিকথা লিখবো। ততদিন যেন মগজগুলো অক্ষত থাকে।
.
এই শহর জানে আমার প্রথম সব কিছু.....................
Wednesday, October 17, 2012
সরি মিনিষ্টার, আমরা বরং ভেজাল খেয়েই বাঁচি
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৪% এর মতো। কিন্তু ডাক্তারের চেম্বার বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে গেলে মনে হবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২০ শতাংশ বা তারো বেশী। পাঁচ বছর আগেও যেসব হাসপাতাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে বসার জায়গা পাওয়া যেত, এখন সেখানে দাঁড়াবার জায়গাও হয় না। যে ডাক্তারের কাছে দিনে ১০ জন রোগীও যেতো না, সেখানে এখন শতাধিক রোগী। রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে প্রত্যেকটা ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং প্রত্যেকটা মোটামুটি মানের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। এত রোগী হঠাৎ করে উদয় হলো কোত্থেকে? জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে তা বহুগুন বেশী। রাস্তাঘাটের জ্যামে যতগুলো গাড়ি দেখা যায়, তার বিরাট একটা অংশ ছোটাছুটি করছে হাসপাতাল ডাক্তার নিয়ে।
দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষ কিডনী লিভার পাকস্থলী আর হৃদযন্ত্রের জটিল রোগে আক্রান্ত। প্রায় প্রত্যেকটা রোগের জন্য দায়ী কোন না কোন খাবার। মানুষ বাঁচার জন্য খায়, আর বাংলাদেশের মানুষ মরার জন্য খায়। খাদ্যে ভেজাল অনৈতিকতার সর্বোচ্চ স্থান স্পর্শ করেছে। খাদ্যে ভেজালের জন্য কিছু গৌণ শাস্তি জেল জরিমানা থাকলেও তা ভেজালকরণের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করে না। ফলে অসাধু ব্যবসায়ীরা কিছু বেশী আয়ের লোভে মানুষের জীবনের উপর আঘাত করছে। আবার এমন নয় যে ভেজালকারী নিজে মুক্ত থাকছে। মাছের ফরমালিন কারিগর, সবজিতে ফরমালিন খাচ্ছে, সবজির ফরমালিন কারিগর খাচ্ছে মাছে। এভাবে একে অপরকে ভেজালের আওতায় এনে দেশের সব মানুষকে ভয়াল রোগাক্রান্ত করে ফেলা হয়েছে।
ভেজাল না করলে একজন ব্যবসায়ীর কতো টাকা ক্ষতি হয়? মাছ ফল কিংবা সবজি বিক্রেতা ছোট আয়ের মানুষ। ভেজাল না দিলে কি তাদের সংসার চলবে না? এই ভেজাল কি প্রাণের দায়ে নাকি টাকার লোভে?
সরকারের এক মন্ত্রী বলেছেন ভেজালকারীর বিরুদ্ধে মামলা করুন। কথাটা শুনে রেগে না গিয়ে হেসে দিলাম, রেগে গেলে আমার মস্তিষ্কের রগ ছিড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকলেও মন্ত্রীর ইয়েও ছিড়বে না। তাই হেসে দিলাম। মাননীয় মন্ত্রী মহাশয়, আপনি কি ভেজাল খান না? আপনি ক'খানা মামলা করেছেন? দৈনিক ক'খানা মামলা করতে হবে আমাকে? আমি দৈনিক ১০ খানা ভেজাল খাই ১০ দোকান থেকে। বছরে কমসে কম ৩৫০০ মামলা করতে হবে আমাকে। একটা মামলা করে একজন মানুষ কতোবছর ঝুলে থাকে আপনার জানা আছে? আমার মামলার খরচ আর সময় যোগাবে আপনার সরকার?
সরি মি. মিনিষ্টার। আমরা বরং ভেজাল টেজাল খেয়ে যতদিন পারি ধুঁকে ধুঁকে বাঁচি। কোর্টকাচারিতে ধুঁকে ধুঁকে সর্বশান্ত হয়ে মরার চেয়ে বেছে বেছে ভেজালের মধ্য থেকে সহনীয় ভেজাল খুঁজে বেঁচে থাকি। শাহজাহানের ট্রাকের চাকা এড়িয়ে, কার্বাইড-ফরমালিনের বিষ পেরিয়ে, আততায়ীর ঘাতক বুলেট সরিয়ে, গামছা মলমপার্টির আদর মাড়িয়ে যতদিন পারি বেঁচে থাকতে চাই।
Sunday, September 30, 2012
প্রায় দমবন্ধ কয়েকটা দিন
গরম পানি, গরম তরল বাদে আর যে কোন খাবার বন্ধ হয়ে গেল। রাতে ঘুম আসে না, গলাবন্ধ হয়ে নিঃশ্বাস আটকে যায় প্রায়। সমস্ত শরীর জুড়ে অস্বস্তি। মাথা কাজ করে না। গলা জিহবা থেকে কর্নকূহর পর্যন্ত ব্যথায় টনটন। বিছানায় একবার শুই আবার উঠে বসি। শুলে মনে হয় দম আটকে যাবে, বসলে মনে হয় মাথা ঘুরে পড়ে যাবো। ওষুধের কোর্স এগিয়ে যাচ্ছিল, দুবেলা দুটো করে দুই এন্টিবায়োটিক (Merocef 250)+ (Zox 500), দুবেলা দুটো পেইনকিলার (Coxia 120mg), তিন বেলা ভায়োডিন মাউথওয়াশ, আর একটা ঘুমের ওষুধ। কিন্তু ফলাফল শূণ্য থাকে তিনদিন পর্যন্ত। বাড়ছিল হতাশা। বুঝতে পারছিলাম মানুষ কোন সময় আত্মহত্যার কথা ভাবে। শিশু সন্তান দুটোর কথা ভাবি। একজন ছয় আরেকজন তিন। ওদের বাকী জীবন কিভাবে কাটাবে আমিহীন।
নাহ। বাজে চিন্তা বাদ। সুস্থ হয়ে উঠতেই হবে। চারদিনের পর থেকে গলার একটু উন্নতি দেখা যায়। আগে ভোর ছটায় জেগে প্রথম বাক্যটি বের করার জন্য তিন ঘন্টা কসরত করতে হতো। এখন এক ঘন্টায় পারছি। আস্তে আস্তে বেঁচে উঠতে থাকি। তবে রাত হলেই আবার আতংক। ঘুম না আসলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু মৃত্যুদূতের নর্তন কুর্দন সহ্য হচ্ছিল না। একদিন দেখালাম আমাকে একটা গরম পানির ডেকচিতে চুবিয়ে রেখে সেই ডেকচির চারপাশ ঘিরে আট দশজন মৃত্যুদূত কুড়াল হাতে নাচতে শুরু করেছে। চমকে উঠে বসি। মৃত্যুদূতেরা একটু আড়ালে চলে যায়। আমি জানি চোখ বন্ধ করলেই ওরা ফিরে আসবে, তাই ভয়ে চোখ বন্ধ করি না।
এভাবে সাত দিন পার হবার পর আমি উঠে বসি। দশদিনের দিন বারান্দায় গিয়ে বিকেলের রোদ, রাস্তায় চলাচলরত গাড়ি, আর দক্ষিণাকাশে ঝুলে থাকা শাদা মেঘের পুঞ্জগুলি দেখতে থাকি। সেই দিনের আলোতেও একদিন দেখি একফাল অর্ধচন্দ্র এক রঙা ঘুড়ির মতো ভেসে আছে। এখনো আশা আছে বৈকি। জীবনের রূপরস নতুন করে গ্রহন করার জন্য আবারো তৈরী হই।
ওশিন এসে গলা জড়িয়ে ধরে চুপ করে থাকে। পেছন থেকে সোয়া তিনের শিহান এসে হাতের আঙুল ধরে টেনে টেনে বলতে থাকে - 'বাবা তিবি দ্যাকবো, তিবি দাও'!
ওর আবদারে অনেকদিন পর আমার মুখে হাসি ফোটে। আমি ফ্যাসফ্যাস গলায় কোনমতে উচ্চারণ করি - 'আমিও দ্যাকবো!'
এই দুটোর জন্য দীর্ঘসময় বেঁচে থাকার লোভ হয়।
[অসুস্থ সময়ে সবচেয়ে বেশী মনে পড়েছে ব্লগার অনার্য সঙ্গীতের কথা। তার প্রিয় ব্যাকটেরিয়া বাহিনীর কবলে আমি কেমন আছি জানাতে ইচ্ছে করছিল খুব। পোষ্টটা সে উদ্দেশ্যেই লেখা]
Thursday, September 27, 2012
তোমাকে সেদিনের শাড়িতে
রবিবার ২৩ মার্চ
-তুমি সেদিন একটা সাদা জামদানী পরেছিলে
-সাদা নয়, ঘিয়ে
-ঈদের শাড়িতে তোমাকে অপরূপা লাগছিল
-তুমি তাকাওনি বেশীক্ষণ
-আমি তোমাকে একান্তে চেয়েছিলাম
-বলোনিতো!
-একদিন বলেছিলাম
-কবে?
-আরো একদিন তুমি শাড়ি পরেছিলে রাস্তায় দেখা আমার সাথে
-তুমি আমাকে দেখতে এসেছিলে?
-আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছিলাম, শাড়িতে তুমি অপরূপা ছিলে
-আমার ভীষণ লজ্জা লাগছিল শাড়িতে
-তুমি জানতে না কতটা আলো ছড়িয়েছিলে তুমি সেই বিকেলে, আমি তোমাকে দেখতে চেয়েছিলাম আরো কিছুক্ষণ
-বলেছিলে, তবু আমি শাড়ি বদলাতে চলে গিয়েছিলাম
-সেই অপূর্ব শাড়ির রূপ আমি আর কখনো দেখিনি
-তুমি এত বছরে কখনোই কিছু বলোনি পরে
-সেদিনই বলেছিলাম, আরো একটু থাকতে যদি শাড়িটা পরে
-সেদিন আমি সসংকোচে জড়িয়ে যাচ্ছিলাম
-তোমাকে সেই শাড়িতে আরেকটু দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপ আমার সারাজীবনও যাবে না।
-এত কিছু মনে থাকে কেন এত বছরেও!
-কিছু কথা খোদাই করা থাকে স্মৃতির দেয়ালে।
মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ
-কাশবরন শাড়িতে যখন তোমাকে পৃথিবীশ্রেষ্ঠা দেখাচ্ছিল, তুমি আমাকে সেই দৃশ্য দেখা থেকে বঞ্চিত করলে
-আমি তখন পথের মাঝে, কোথায় দাঁড়াবো?
-তুমি আমার পাশে, আমার ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারতে না?
বৃহস্পতিবার ২৭শে মার্চ
-সেদিনের শাড়িতে তোমাকে অপরূপা লেগেছিল
-আমি আয়না দেখিনি সেদিন
-তুমি কার জন্য সেজেছিলে আমি জানি না
-আমি আমার জন্য সেজেছিলাম, তোমার সামনে পড়ে গিয়েছিলাম হঠাৎ
-আমি তোমার মতো শাড়িতে এত সুন্দর আর কোন রমনী দেখিনি
-তোমাকে পাইনি বলে আমি শাড়ি পরাই ছেড়ে দিয়েছি!
-কী চমৎকার লাগে এরকম মিথ্যেগুলো শুনতে!!
শুক্রবার ২৮শে মার্চ
-সেদিনের শাড়িতে তোমাকে দেখার তীব্র তৃষ্ণা জেগে উঠেছিল,আরো কিছুক্ষণ শাড়িতে তুমি থাকতে পারতে। বাঁক ঘুরতেই তোমার মুখোমুখি, নিরালা গলির শেষ প্রান্তে তোমাদের বাড়ি, তুমি নিমন্ত্রণ সেরে বাড়ি ফিরছিলে আর আমি তোমাকে দেখার জন্য যাচ্ছিলাম। আমি নিশ্চিত তুমি জানতে না আমি কেবল তোমাকে দেখার জন্যই ওই বাড়ির সিড়িতে পা রাখতাম। শাড়িতে তোমাকে অপরূপা দেখাচ্ছিল। আমি তোমাকে অমন শাড়িতে আগে কখনো দেখিনি। তুমি রূপ লুকোচুরি করতে, কখনোই সাজতে না আমার জন্য। তোমার সুন্দর দেখার জন্য এতটা তৃষ্ণার্ত ছিলাম আমি, তুমি খেয়ালই করতে না। সেদিনের শাড়িতে মুগ্ধতা ছড়িয়ে যখন আমি তোমাকে দেখছিলাম তুমি লজ্জায় মরে গেলে। তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে গিয়ে শাড়িটা বদলে সাধারণ হয়ে এলে। আমি তখন শাড়িতে তোমাকে দেখার তৃষ্ণায় তখন মরে যাচ্ছি। মুখ ফুটে বলা হয়নি কিছু। তুমি জানলে না তেইশের যুবক উনিশের তরুণীর জন্য কতখানি প্রেম জমা করে রেখেছিল গোপন খাঁচায়।
-প্রতিদিন প্রতিদিন একই কথা। শুনতে তবু কি যে ভালো লাগছে! বলো, আবার কি শাড়ি পরে দাঁড়াবো এসে?
-এখন সেই শাড়ি নেই, সেই সময় নেই, সেই তুমি নেই, সেই আমি নেই, কি হবে এখন এসে দাঁড়িয়ে?
-তবু তোমার বুকের ভেতরে দুই যুগ ভাঁজ করে রাখা শাড়িটা দিয়ে আমাকে একবার জড়িয়ে নেবে না?