আমি অনেকক্ষণ ধরে ডাস্টবিনটার দিকে তাকিয়ে আছি। এখানে এসেছি প্রায় দুঘন্টা হলো। দুটো কুকুর তাদের প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান শেষ করে ফিরে গেছে অন্য কোন রাস্তায়। কয়েকটা কাক ঝগড়া করছে, নতুন কয়েকটা কাক এসে যোগ দিল, আগের কয়েকটা কাক উড়ে চলে গেল। কাকদের নিয়ে একটা সমস্যা। কোনটা নতুন কাক কোনটা পুরোনো কাক বোঝা মুশকিল। সবগুলো কাকের পোষাক একই। ওরা নিজেদের সনাক্ত করে কিভাবে? ধুত্তারি খামাকা কিসব ভাবনা।
আমার জন্ম এই ডাস্টবিনে। না ভুল হলো। আমাকে পাওয়া যায় এই ডাস্টবিনে। আমাকে আরো পঁচিশ বছর আগে যে মহিলা কুড়িয়ে নিয়েছিল তাকে আমি মা বলে জেনে এসেছি। নিঃসন্তান ওই মহিলা আমার কান্না শুনে রিকশা থামিয়ে আমাকে তুলে নিয়েছিল। তারপর তার স্বামীর কাছে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। তার স্বামী প্রথমে বিরক্ত হলেও কিছুদিন পরেই আমার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে চমৎকৃত হয়। আমার পিসু করার সময় হলে আমি মোচড় দিয়ে কোল থেকে নেমে যেতে চাইতাম। বাবা লোকটা বলতো এরকম শিশু এই জগতে বিরল। বড় হয়ে এ নিশ্চয়ই দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। মা আমাকে নিয়ে গর্ব করতো।
একটু বড় হলে আমাকে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হলো। গাড়িতে করে স্কুলে যেতাম গাড়ি করে বাড়ি ফিরতাম। আমি খুব ভালো রেজাল্ট করতে লাগলাম স্কুলে। আমার খেলাধুলার স্কোর ছিল লক্ষণীয় রকমের ভালো। আরো অনেক বছর পর আমি বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে চাইলাম। মা যেতে দিতে রাজী হলো না। বাবা লোকটা রাজী। আমি বাবার পক্ষে গেলাম। বাবা আমাকে বিদেশ যাবার ব্যবস্থা করলো। মা রাগ করে আমার সাথে কথা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমি যাবার দিন আমাকে বিদায়ও জানালো না। ঘরে দোর দিয়ে কাঁদতে থাকলো।
বিদেশে যাবার পর আমি মাকে ফোন করে পাই না। মা আমার সাথে কথা বলে না। সব খবর বাবার কাছ থেকে পাই। দিন মাস বছর যায়। প্রায় দুবছর মায়ের সাথে আমার যোগাযোগ নেই। মনটা কেমন করতে লাগলো। একদিন হুট করে আমি দেশে ফেরার জন্য তৈরী হলাম। কাউকে না জানিয়ে একদিন প্লেনে উঠে বসলাম।
বাসায় এসে কলিংবেল দিলাম। বুকের মধ্যে কেমন ধুকপুক করছে। মা আমাকে দেখে কেমন অবাক হয়ে যাবে। এতদিনে সব অভিমান ভুলে গেছে নিশ্চয়ই। ভেতর থেকে কে কে বলছে কেউ একজন। মায়ের কন্ঠ এমন কেন? এত বুড়িয়ে গেছে নাকি মা? কিন্তু দরোজা খুললো অচেনা এক মহিলা। আপনি কে, জিজ্ঞেস করলো আমাকে। আমি নাম বললাম, কিন্তু বুড়ি চিনতে পারলো না। দেখে মনে হলো বুয়া। এমন সময় ভেতর থেকে মায়ের কন্ঠ, কে এসেছে সাহারার মা? আমি ধাক্কা দিয়ে দরোজা খুলে এবার মায়ের কাছে ছুট। মা আমাকে দেখে প্রায় বেহুশ। মাকে জড়িয়ে ধরে আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম।
মা, তোমাকে কতোকাল পর দেখছি। মায়ের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে। আমিও কাঁদছি।
-বাবা কোথায়?
-সে এখানে থাকে না
-মানে?
-এখানে আমি একাই থাকি
-বাবা কোথায় থাকে
-এখনো বাবাকেই দরকার তোর?
-না মা, কেবল জানতে চাইছি, বাবার কি হয়েছে
-তোর বাবা আবার বিয়ে করেছে
আমার মাথায় কেউ যেন হাতুড়ির আঘাত করলো। গতমাসেও বাবার সাথে হাসিখুশী গল্প করেছি। বাবা কখন এই কাজ করলো?
-কি বলছো মা, কবে করলো, কেন করলো এমন?
-সে তো ছমাসের বেশী হলো। তারপর থেকে এ বাড়িতে থাকে না সে। আমি বলেছি আমার সাথে আর থাকতে পারবে না। মেনে নিয়েছে সে। এখন তুই কি আমার কাছে থাকবি নাকি তোর নতুন মায়ের কাছে যাবি?
-মা তুমিই আমার মা, আমি আর কোথাও যাবো না তোমাকে ছেড়ে
-ঠিকাছে আমার কাছেই থাক। কিন্তু আমি তোর সাথেও বেশীদিন থাকতে পারবো না।
-কেন?
মায়ের অসুখটার কথা জানতে পারলাম এই প্রথমবারের মতো। আমাকে বাবা লোকটা ঘুনাক্ষরেও জানায়নি। লোকটাকে আমি এই প্রথমবারের মতো ঘৃনা করতে শুরু করি। তারপর মা আমাকে যা বললো তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
-আমি তোকে কিছু কথা বলে যাই। মন দিয়ে শোন।
-বলো
-তুই বিদেশে চলে যা। দেশে আর ফিরিস না।
-কি বলছো মা, তোমাকে ছেড়ে, এই দেশ ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। পড়াশোনা শেষ হলে আমি ফিরবোই।
-আমি তো বেশীদিন নেই। আমি না থাকলে তোকে দেখবে কে? দেশটা তোকে দেখবে না, এদেশে তোর কেউ নেই।
-কি আবোলতাবোল বকছো মা?
-তোকে কোনদিন বলিনি, আমি তোকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম ওই ডাস্টবিনে। তোর বাবা ছাড়া আর কেউ জানতো না এতদিন। এখন তোর নতুন মা এসে জেনেছে সব। সে তোকে মেনে নেবে না বলেছে। তোর বাবাকে দিয়ে তোকে সমস্ত উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে।
-মা!! তুমি কি শোনালে এসব? আসলে কি সত্যি? তুমি গল্প করছো না তো? নিশ্চয়ই দুষ্টুমি করছো
-না রে বাবা। আমার জীবনের শেষভাগে আমি তোকে সত্যিটা জানিয়ে গেলাম। তোর বাবা মা কে আমি জানি না।
-এখন আমি কি করবো? কোথায় যাবো?
-তুই অবশ্যই বিদেশে চলে যাবি। ওখানেই তোর ভবিষ্যত। এদেশে থাকলে তোর নতুন মা তোকে বাঁচতে দেবে না। সে তাও হুমকি দিয়ে রেখেছে। আমি চাই তার সাথে দেখা হবার আগেই তুই দেশ থেকে চলে যা। আমি যতদিন বাঁচি এখানেই থাকবো।
-আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও পালাবো না মা।
-তুই না পালালে আমি যে তোকে চিরতরে হারাবো। তুই অনেক বড় হবি। দুনিয়াতে তোর অনেক নামডাক হবে। তুই বিদেশেই চলে যা সোনা! আমার মাথার দোহাই লাগে।
মা একবার যা বলে তার নড়চড় হয় না। খুবই জেদি আর অভিমানী আমার মা। আমার আর উপায় নেই।
আমি দেশ ছাড়বো আজ বিকেলে। তার আগে নিজের জন্মস্থান দেখতে এসেছি। প্রাণভরে দেখছি আর ভাবছি আমার সেই মা এখনো এই পৃথিবীর কোন প্রান্তে বসে আছে। সেই মায়ের হাসি কেমন? সে মায়ের চুলের গন্ধ কিরকম? সেই মা কি এখনো আমাকে মনে রেখেছে? আমাকে ফেলে দিল কেন? আমি কতটা ঘৃনিত মানুষ হয়ে জন্মেছিলাম? আমার জন্ম প্রক্রিয়ায় কি কোন ভালোবাসা ছিল না? আমি জানি যে কোন দুজন নারী পুরুষের মিলনের ফলে আমার জন্ম হয়েছে। সেই নারী পুরুষ দুজনের মুহুর্তের আনন্দের ফসল আমি। আনন্দ না হলেও তো শিশুর জন্ম হতে পারে। দুটি মানুষের পাশবিক মিলনের ফসলও হতে পারে একটা শিশু। কেবল পশুর মতো সঙ্গম করে দুর্ঘটনাক্রমে একটা সন্তানের ভ্রুন তৈরী করে ফেলেছিল হয়তো। তারপর তাকে ঝেড়ে ফেলার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর জন্মপ্রক্রিয়ায় আসতে হলো। শিশুটি আলোর মুখ দেখার পরই তাকে বর্জন করার আয়োজন। অতঃপর কোন নির্জন রাতে একটা পুটলি করে ছুড়ে দেয়া এই ডাস্টবিনে।
আমার তীব্র ঘেন্না হতে থাকে এই পৃথিবীর মানুষগুলোকে। সবগুলো মানুষকে একেকটা পশুর মতো লাগে। আমি ঘেন্নায় কুঁকড়ে যাই।
কুকুর দুটো ডাস্টবিনে ফিরে এসেছে আবারো। আমি মানুষকে ওই পশুদুটির চেয়ে উন্নত বলে ভাবতে পারি না। হাতে থাকা কেকের ঠোঙ্গাটা ছুড়ে দিলাম কুকুর দুটোর উদ্দেশ্যে। তারপর হাঁটতে শুরু করলাম এয়ারপোর্টের দিকে।
[অসমাপ্ত খসড়া]
No comments:
Post a Comment