Thursday, December 6, 2012

হৃদয়ঘটিত

চল্লিশ পেরোবার পর স্বচ্ছল বাঙালীর ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি বেড়ে যায়। চোখে চশমা উঠবে, ব্লাড প্রেশার হবে, লিপিড প্রোফাইল খারাপ থাকবে, টিজি আর এলডিএল কোলেষ্টেরলের উচ্চমাত্রা থাকবে, ব্লাড গ্লুকোজের পরিমান বাড়তে থাকবে, বুকে ব্যথা করবে, ভাগ্য ভালো হলে সেটা হবে গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা, ভাগ্য খারাপ হলে সেটা হার্টের ব্যথা। ইসিজি, ইকো, ইটিটি পার হয়ে এনজিওগ্রামের দিকে ছুটবে, দেখা যাবে দুয়েকটা ধমনী ৮০ থেকে ৯০ ভাগ বন্ধ হয়ে আছে। এবার করো এনজিওপ্লাষ্ট, লাগাও বেলজিয়াম কি আমেরিকার রিং। এতদিন উত্তম মধ্যম খেয়ে খেয়ে শরীরে চর্বি জমানোর জন্য খরচ করেছো, এখন ডাক্তার হাসপাতালের পেছনে খরচ করো। মোটামুটি এরকমই হলো স্বচ্ছল বাঙালীর গড়পড়তা অবস্থান।

আমি একসময় চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতাম মানুষকে। শ্রীকান্ত পড়ার পর 'মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকাও ভালো' দর্শনে বিশ্বাসী হয়েছিলাম। একসময় তার বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে শুরু করি। বিশ্বাসের স্তম্ভগুলোর মধ্যে ফাটল ধরতে শুরু করলো। আমার ভিত নড়ে যাবার যোগাড় হলো। তখন বিশ্বাস অবিশ্বাস দুটোর মাঝামাঝি দর্শনে আসলাম। মানুষকে অবিশ্বাস করা একটা কষ্টকর কাজ। তাই প্রথম দেখায় যে কোন মানুষকে বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝামাঝি সংশয় অবস্থানে রাখি। সময় নিয়ে বিশ্বাস করি। ১০০% বিশ্বাস ব্যাপারটাই ভুল। খুব বিশ্বাসী মানুষও বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারে প্রতিকূল সময়ে। তাই পূর্ন বিশ্বাসেও ফাঁক রেখে দেই। ঠকলেও যেন একটা শান্ত্বনা থাকে। ১০০% বিশ্বাস করে ঠকার পর একটা গাধানুভুতি হয়। অন্ততঃ গাধার মতো ঠকতে চাইনা।

চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতাম ডাক্তার আর হাসপাতালের রিপোর্টকেও। একদিন সেই বিশ্বাসেও ফাটল দেখা দিল। সব ডাক্তার সঠিক কথা বলে না। সব ডাক্তারের পড়াশোনা আপডেট না। গুগলের সাথে বন্ধুতা হবার পর থেকে আমি ডাক্তারের অনেক প্রেসক্রিপশানে ভুল পেয়েছি। ডায়গনস্টিক সেন্টারের রিপোর্টে প্রচুর ঘাপলা। একই রক্তের একই টেষ্টের রিপোর্ট দুটো ল্যাবে দুরকম আসে। কারটা সঠিক বিশ্বাস করা মুশকিল। এখানেও আমি সংশয়ে থাকি। আমার ডাক্তার বললেন আমার জন্য ডিম মাংস চিংড়ি মাছ খাওয়া হারাম। কিন্তু বৃটিশ হার্ট ফাউন্ডেশান আর আমেরিকান হার্ট ফাউন্ডেশান(নাকি এসোসিয়েশান) সুত্রে জানা গেল আগে ডিম হারাম ছিল ঠিকই, কিন্তু এখন আর হারাম নয়, কারণ ডিমের কোলেস্টেরল সরাসরি রক্তে মেশে না। সুতরাং ওটা সপ্তাহে কয়েকটা খাওয়া যেতে পারে। আমার চিংড়ির ব্যাপারে আমেরিকানরা বলছে ওটা খেলে ভালো কোলেষ্টেরল বাড়ে। সুতরাং ওটা খাওয়া জায়েজ। আমার মূল সমস্যা আসলে কোলেষ্টেরলে না, আমার সমস্যা ট্রাইগ্লিসারাইড বা টিজি। টিজি বেশী হয় কার্বোহাইড্রেট বা মিষ্টি জাতীয় খাবার বেশী খেলে। এটা আমি জেনেছি ইন্টারনেট ঘেটে দুনিয়ার বড় বড় সব হাসপাতাল ডাক্তারের চেম্বার ঘুরে। কিন্তু আমার ডাক্তার বিন্দুমাত্রও ইঙ্গিত দেননি যে কার্বোহাইড্রেট বর্জন করা উচিত। এরকম উদাহরন আরো দেয়া যায়। আমরা ডাক্তারের কাছ থেকে সঠিক তথ্য পাই না। আমাদের ডাক্তারগন রোগীর সাথে খোলামেলা আলাপে আগ্রহী না। রোগীর এত জেনে কাজ কি, ওষুধ দেবো সেই মতে খাবে ব্যস।


কদিন থেকে বুকের বামপাশটা ব্যথা করছে। ঠিক যেখানে ব্যথা করলে হার্টের সমস্যা সেখানে। কিন্তু আমি ডাক্তারের কাছে যেতে ভরসা পাচ্ছি না। চট্টগ্রামে এই বিষয়ে যে ডাক্তার আছে তাদের উপর আমার বিশ্বাস নষ্ট হয়েছে। ঢাকা হার্ট ফাউন্ডেশানে যেতে পারি। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। আমাদের যে খাদ্যাভ্যাস সবারই একসময় হার্ট কিডনী লিভার এসবের সমস্যা হবে। আমার আশপাশের অনেকের হয়েছে আমার বয়সেই। আগে যে সমস্যা হতো ৬০ পার হবার পর, এখন তা ৪০ পার হবার পরেই দেখা যায়। দেশ অনেক এগিয়েছে, দেশের মানুষও। ডায়গনস্টিক সেন্টারগুলোকে রোগীর ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়।

আজকাল কোনরকম চাপ সহ্য হয় না। সেদিন একটা বইতে পড়ছিলাম অধিকাংশ হার্টের সমস্যা হয় কোন না কোন মানসিক চাপের কারণে। খাদ্যের চেয়েও টেনশানের প্রতিক্রিয়া অনেক বেশী ক্ষতিকারক। আমার তেমন কোন টেনশান নেই। তবে কিছু চাপ আছে। মানসিক চাপগুলো এড়িয়ে থাকতে চাইলেও পারা যায় না। কাজের চেয়ে অকাজের চাপই বেশী।

নন্দলালের মতো কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবছি - চাপা চাপা ব্যথা, ঔষধ দিব কোথা!
করার কিছু নাই। যখন যা হবার হবে। হলে হোক, চলে যাবার হলে যাবো চলে। অবশিষ্ট পৃথিবী ফেলে।


No comments: