১.
মানুষের জীবনে ধারাবাহিকতা থাকাটা কি আবশ্যক? অথবা ধারাবাহিকতা কি স্বাভাবিক বিষয়? সিনেমায় দেখা নায়কের চরিত্রগুলো সম্পর্কে আমরা জানি ছেলেবেলা থেকেই যে ছেলেটা সুবোধ মানবিক দর্শনীয়, বড় হয়ে সেই ছেলেটিই সিনেমার মধ্যমনি। আর যে দুষ্ট ছেলেটি ছেলেবেলায় স্কুলের বন্ধুদের মেরে রক্তাক্ত করতো, বড় হয়ে সে ভিলেনই হয়। উপন্যাসেও একই জিনিস দেখি। নায়কের মধ্যে শুধুই সাধুতা, ভিলেনের মধ্যে কেবলই মন্দতা। ফরমূলাতে সীমাবদ্ধ। জীবন কি তেমন ধারাবাহিক নিয়ম মানে? কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে জীবনে ধারাবাহিকতার স্থান নেই। জীবন হলো একটা ওলট পালট সিনেমার স্ক্রিপ্ট। যেখানে একই মানুষের জীবনে অনেক মানুষের গল্প। যেখানে একই মানুষকে ঘিরে রচনা হতে পারে একাধিক উপন্যাস। একই মানুষ কখনো নায়ক, কখনো ভিলেন, কখনো চরম অকাল কুষ্মাণ্ড। যে মানুষটা বাজারে গিয়ে স্মার্ট, সে মানুষ অফিসে ভোদাই। যে মানুষ বন্ধুদের সাথে ধূর্ত শেয়াল, সেই মানুষ বউয়ের কাছে ভেজা বেড়াল। এমনকি একই সময়েই একটা মানুষ কয়েক রকমের জীবন যাপন করে।
মিনহাজকে তো চিনেছেন। সেই যে ঘর পালানো ছেলেটি। মায়ের সাথে ঝগড়া করে বন্ধুর বাড়িতে তিনদিন লুকিয়ে থেকে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। ঘুষখোর বাবার থেকে ২০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায় করে তারপর ঘরে ফিরেছিল সে। সেই ছিল তার শুরু। বাবার উপর প্রতিশোধ নেয়া। বাবা লোকটা ভালো ছিল না। সবার বাবা ভালো হয় না। তার বাবা তাস খেলে, মদ খায়, ক্লাবে গিয়ে টাকা ওড়ায়, বাড়িতে এসে মাকে পেটায়, এরকম আরো নানান কুকীর্তির সাথে জড়িত। বড় হতে হতে সব জেনে গেছে মিনহাজ। ছেলেবেলায় যে বাবাকে মিনহাজের নায়ক মনে হতো, বড় হতে হতে লোকটা হয়ে গেল ভিলেন। বাবার এই পরিবর্তন মিনহাজকেও পরিবর্তিত করতে শুরু করে।
ছেলেবেলায় মিনহাজ খুব দুষ্টামি করলে মা প্রচণ্ড রাগ করে বলতো, "তোর বাবার মতো হচ্ছিস? খবরদার সেরকম দেখলে আমি তোকে লাথি দিয়ে বের করে দেবো! শুয়োরের ঘরে শুয়োরের বাচ্চা হয়েছে!" মায়ের মুখ খুব খারাপ হয়ে যায় রেগে গেলে।
মিনহাজের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল বাবার মতো হওয়া যাবে না। তাই সে ভালো হবার চেষ্টা করে। নলিনী স্যারের কাছে প্রাইভেটে বীজগণিত পাটিগণিত বাংলা ইংরেজী গ্রামার মুখস্ত করে যখন মেট্রিকে হায়ার সেকেন্ড ডিভিশন পেল তখন সত্যি সত্যি মনে হলো সে বাবার চেয়ে ভালো কিছু হতে যাচ্ছে। সে ইংরেজি শেখার জন্য TOEFL বই কিনে পড়তে শুরু করে, ভর্তি হয় YMCA স্পিকিং কোর্সে। কলেজে পড়ার সময় শিক্ষার গতিবেগ যতটা হওয়া দরকার তার চেয়ে বেশীই ছিল।
কিন্তু একদিন বাসায় ফিরে দেখলো বাবা স্যাণ্ডেল দিয়ে মাকে বেধড়ক পেটাচ্ছে আর অকথ্য গালি বিনিময় হচ্ছে দুই পক্ষ থেকে। মায়ের মুখেও এসব শব্দ সে কল্পনা করেনি। সে গিয়ে থামাতে চাইলে কোন পক্ষই থামলো না। তারপর সে ডাইনিং টেবিল থেকে কাঁচের জগটা তুলে দেয়ালে ছুঁড়ে দিয়ে কিচেন থেকে দা নিয়ে ডাইনিং টেবিলে কোপাতে শুরু করলো তীব্র চীৎকার দিয়ে। খুন চেপে গেছে তার মাথায়। এবং সাথে সাথে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলো। বাবা ওর দিকে রক্তচক্ষু মেলে তাকিয়ে দরোজা খুলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। মা অনিশ্চিত দৃষ্টিতে মিনহাজের দিকে তাকিয়ে নিরুপন করার চেষ্টা করলো সে কোন পক্ষের হয়ে হুংকার দিল। কিন্তু মিনহাজ আজ কারো পক্ষে না। গোটা দুনিয়ার উপরই তার বিরক্তি চলে এসেছে।
সেদিন থেকে বাবার মতো হবে না, এই প্রতিজ্ঞার বিপরীত দিকে যাত্রা শুরু হলো তার। ফেন্সিডিল বন্ধুর অভাব ছিলনা, ছিল না গাজা চরস হেরোইন বন্ধুরও। সাথে যোগ হলো খারাপ পাড়ায় যাতায়াত। ইন্টার পরীক্ষার আগে বই খুলে লেখা যায় তেমন একটা কলেজে গিয়ে ভর্তি হলো। কোনমতে পাশ করলো। আর পড়ার ইচ্ছে নেই তার। পড়াশোনার ইতি সেখানেই। তারপর বছরের পর বছর আরো গভীর অন্ধকারে ঢুকে যেতে থাকলো ক্রমশঃ। সেই অন্ধকারের একজনের হাত ধরে সে একদিন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। শুধু ঘর নয়, তার পরিচিত সমাজের গণ্ডী ছেড়েও অনেক দূরে কোথাও চলে গেল। তাকে আর কখনো দেখা যায়নি এলাকায়। হালিশহরের মিনহাজ অধ্যায় ওখানেই শেষ হলো। কিন্তু তার নষ্ট হবার কাহিনীটা আরো কয়েক মাস মুখে মুখে থাকলো। একসময় তাও মিলিয়ে গেল।
২.
রিভারসাইড ক্লাবটা খুব সুন্দর। পদ্মা অয়েল কোম্পানীর গুপ্তখাল ডিপোর পাশে যে অফিসার্স কলোনী, সেখানেই ক্লাবটির অবস্থান। সবুজে ছাওয়া এলাকা। পতেঙ্গা রোডের তেলের গন্ধ পেরিয়ে ডানদিকের লোহার গেটের মধ্যে ঢুকলেই হঠাৎ একটুকরো স্বর্গের মতো মনে হয় এলাকাটিকে। বামদিকে টাইলসের সারিবদ্ধ বাংলো, ডানদিকে ছোটখাট একটা লেক বা পুকুর, লেকের ওপাশেই ক্লাবঘর, একটা সুন্দর কাঠের সেতু পেরিয়ে ওপাশে যেতে হয়। ছায়াময় কাঠের সেতুটাতে দাড়ালে নদীর বাতাসে জুড়িয়ে যায় শরীর মন। লেকের মধ্যে ফুটে আছে সাদা গোলাপী শাপলা। ছোটাছুটি করছে মাছের দল, লেকের চারপাশে ঘন গাছে ছাওয়া। পুরো এলাকাটাই যেন একটা পার্ক। সেতু পেরিয়ে ক্লাবের প্রবেশপথ। ডানদিকে দুটো দোলনা, তার একটু পর ভলিবল ব্যাডমিন্টন খেলার জায়গা, তার বায়ে গোলাকার জায়গা মাঝে একটা সিমেন্টের গোলাকার বেদী। আরো বায়ে বিশাল সবুজ একটা মাঠ। এত ঘন ঘাসে ছাওয়া মাঠ শহরে দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ।
এই ডিপোর ম্যানেজারের বাংলোতে কাজ করে নাসিমা। ঠিক বুয়া না হলেও ঘরের সব কাজ সে করে, পাশাপাশি বাচ্চা দুটো দেখাশোনা। ম্যানেজারের বউ নাসিমাকে বলেছে চাইলে তাদের বাগানের কাজ করতে সে তার স্বামীকে লাগাতে পারে। নাসিমার স্বামী পাশের একটা ডিপোতে সিকিউরিটির চাকরী করতো, তাকে ছাঁটাই করেছে কোম্পানীর মন্দার কারণে। এখানে চাকরীর জন্য নাসিমা বলে রেখেছিল। কিন্তু ক্যাজুয়াল বাদে স্থায়ী চাকরী দেবার ক্ষমতা ম্যানেজারেরও নেই। তাই ম্যানেজারের বউ নাসিমাকে এই প্রস্তাব দিল। নাসিমা খোদার কাছে বড় ধরনের শোকর করলো দ্বিতীয়বার। প্রথমবার করেছিল যেদিন মিনহাজ তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল।
দেবতা বলতে যা বোঝায় মিনহাজ তার চেয়েও বেশী কিছু। নাসিমাকে কি অবস্থা থেকে উদ্ধার করে এখনো পর্যন্ত আগলে রেখেছে সেটা কেবল উপরঅলা জানে আর জানে সে। মিনহাজ কেন এই কাজটা করলো সেটা আজো রহস্য। সে চাইলেই অন্যদের মতো কাজ সেরে চলে যেতে পারতো। কিন্তু কি একটা কারণে সে তার কাছেই ফিরে এসেছে। তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে, ঘর বেধেছে, ঘর ছেড়েছে, সেই সাথে ছেড়েছে সকল ধন সম্পদের হানছানি, ভবিষ্যত সম্ভাবনা, এমনকি নিজের পরিবারও। নাসিমার মধ্যে এমন কি আছে যে সে এত ভালোবাসার যোগ্য? যদি কেবল শরীরের আকর্ষণ থাকতো, সেটা মিনহাজ বিয়ে ছাড়াই পেতে পারতো। এমনকি যখন মিনহাজ তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় তখন সে রীতিমত অসুস্থ। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে নিজের হাতে সেবা করে সুস্থ করে তুলে, তারপর বিয়ে করা, এটা তার পেশার কেউ কখনো কল্পনা করেনি। এই মানুষকে দেবতা বললেও কম বলা হয়। বড়লোক বাবার সম্পদের মোহ ছেড়ে সে এখন বস্তি জীবনযাপন করছে গত দশ বছর ধরে। তাদের ঘরে দুটো সন্তান। স্কুলে ভর্তি করিয়েছে তাদের।
মিনহাজকে মাঝে মাঝে তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখতে বলে নাসিমা। তাদের বিয়ে মেনে না নিলেও তারা তো বাবা মা। যত রাগই থাকুক, সেই মায়ের গর্ভের তো জন্ম। তাকে বছরে অন্তত কয়েকবার গিয়ে দেখে আসুক। কিছুদিন গিয়ে সাথে থাকুক। অনেকটা নাসিমার পীড়াপিড়িতে কেবল মায়ের কাছে যায় বছরে দুয়েকবার। মা তার হাতে কিছু টাকাপয়সা তুলে দেয়। কয়েক বছর আগে ফরিদপুরের ওদের গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল মায়ের সাথে। মা গ্রামে বাড়ি করছে। ওখানে গিয়ে কাটাবে শেষ বয়সটা। মা বললো কিছুদিন গিয়ে বাড়ির কাজ দেখাশোনা করতে। নাসিমাকে জিজ্ঞেস করতে নাসিমা রাজী। তোমার তো এখন কাজকর্ম নেই, কিছুদিন থেকে আসো। নাসিমার হাতে কিছু টাকাপয়সা তুলে দিয়ে সে ফরিদপুরে চলে যায় তিন মাসের জন্য।
৩.
ফুফুরা আজ চলে যাবে। মন খারাপ লীনার। তাই কলেজে যায়নি সে। ফুফুরা আর কখনো তাদের বাড়িতে এতদিন থাকেনি। এবার থেকেছে বাধ্য হয়ে। ওরা তো গ্রামের কথা ভুলেই গিয়েছিল। তবু এতকাল পর কি মনে করে গ্রামে ফিরে আসার চিন্তা করছে কে জানে। একবার যারা গ্রাম ছেড়ে যায় তারা কখনো ফেরে না আর। অনেক দেখেছে সে। শহরে কি যাদু আছে, মানুষকে আটকে রাখে। পতঙ্গ যেমন আলোর চারপাশ ঘিরে উড়তে থাকে কোন এক বিভ্রান্তিময় কারণে, অথচ আলো পতঙ্গকে মৃত্যু ছাড়া আর কোন উপহার দিতে পারে না। শহরের মানুষগুলোকেও তার সেরকম লাগে। প্রত্যেকবার শহর থেকে যখন লাশ হয়ে একেকজন ফিরে আসে তখন তাই মনে হয়। গত তিন বছরে চারজনকে দেখলো সে। মৃত্যুর পরই যেন গ্রামের ঠিকানায় ফিরে আসা। একমাত্র মেজ ফুপুই ব্যতিক্রম। উনি বাড়ি করছেন এখানে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্যই। ফুফু শ্বশুরবাড়িতে না গিয়ে এখানে কেন বাড়ি করছে সেটা নিয়ে অবশ্য তার কোন মাথাব্যথা নেই। ফুফু এখানে থাকবে, সে ফুপুর সাথে সারাক্ষণ ঘুরঘুর করবে, এটা সেটা এগিয়ে দেবে, আর বকুল ভাইয়ের চটকানা খাবে যখন তখন এটাতেই আনন্দ তার। বকুল ভাইয়া একটা কেমন যেন। সে এখন বড় হয়েছে না? তবু তাকে ছেলেবেলার মতো গাধিনী বলে ডাকবে।
আচ্ছা এত বছরেও বকুলভাই বিয়ে থা করেনি কেন? এটা নিয়ে তার একটা গোপন কৌতুহল আছে। কিন্তু কাকে জিজ্ঞেস করে? বকুলভাইয়ের বয়স কমসে কম ত্রিশ হবে। ও মা! এত বুড়ো হয়ে গেছে বকুল ভাই? কি একটা ভেবে আপন মনে লজ্জা পায় সে। ভাবনাটা কাউকে বলার মতো না, কাউকেই না। এটা সে নিজে নিজে ভেবে সুখ পায়। এমন করে আর কাউকে ভাবেনি সে। তারা তো আত্মীয়ই। এমন করে ভাবা কি ঠিক? তার চেয়ে বকুলভাই ১২ বছরের বড়। এত পিচ্চি একটা মেয়েকে পাত্তা দেবে না বকুলভাই। সেরকম দেয়ও না। এই বয়সী মেয়েদের দেখলে পুরুষরা অন্য চোখে দেখে, কিন্তু বকুলভাই কেমন অন্যরকম। তাকে যেন দেখেও দেখে না। আচ্ছা, শহরে বকুলভাইয়ের কেউ নেই তো? শহরের ছেলেরা অনেক সহজে প্রেমট্রেম করে। ধুরো বকুলভাই সেরকম না। ফুপুর সাথে বাড়ির কাজ তদারকি করার পাশাপাশি কেবল রেডিও ঘুরায়, গান শোনে। এদিক সেদিক নজর দেয় না। সেরকম কেউ থাকলে বকুলভাই নির্ঘাত উদাস হয়ে যেতো মাঝে মাঝে। এখানে আছে আজ দুমাসের বেশী। একবারও সেরকম মনে হয়নি।
আজ ফুপুরা নিজের বাড়িতে উঠবে। বাড়িটা ওদের ১০০ গজের মধ্যেই। তবু মনে হচ্ছে ওখানে গেলে বকুলভাইকে আর পাবে না। এখানে এই কদিনের যে খুনসুটি, মায়া গড়ে উঠেছিল, সেসব কি আর থাকবে? বকুলভাই নিশ্চয়ই এরপর শহরে ফিরে যাবে। আবার কবে দেখা হবে। ততদিনে যদি ওর কিংবা বকুলভাইয়ে বিয়ে হয়ে যায় তখন কি আর......ভাবতে পারে না লীনা। তার দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসে। রান্নাঘর থেকে মা ডাকছে। আজকে ওদের জন্য বিশেষ বিদায়ী খানাপিনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাবা বলেছে আরো কদিন ওদের জন্য এ বাড়ি থেকে খাওয়া যাবে। ফুপুর যেন কষ্ট না হয়। বাবা তার এই বোনটাকে বেশী পছন্দ করে।
বিকেলটা মেঘলা। বৃষ্টি হবে আজ রাতে। আকাশের সাথে লীনার মনটাও একই সুরে কাঁদছে। প্রতিদিন রাতে শোবার আগে সে বকুলভাইয়ের ঘরে এক গ্লাস পানি রেখে আসে। ওটা একটা অজুহাত। আসলে বকুলভাইকে শেষবার দেখে ঘুমোতে যাওয়া। গত দুমাস ধরে এই রুটিনে আজকে ব্যাঘাত ঘটলো। আজকে কি দেখে ঘুমাবে সে? রাতে পানি খাবার অভ্যেস বকুলভাইয়ের। এখন কে দেবে পানি? তার চিন্তার বহর দেখলে বাচ্চাছেলেও হাসবে। তবু সে পাগলামি চিন্তা করে। হাতে চিড়াভাজা নিয়ে মা আসে। হঠাৎ করে বলে বসে-
-আচ্ছা বকুলকে তোর পছন্দ হয়?
-মানে?
-বয়সটা একটু বেশী হয়ে যায়। কিন্তু এত ভালো ছেলে তো আর হয় না।
-মা তুমি কি বলছো বুঝতে পারছি না।
-কদিন আগে কথায় কথায় আপা তোর প্রশংসা করছিল। তারপর তোকে চেয়েছে বকুলের জন্য অবশ্য তুই রাজী থাকলে।
মাথাটা কেমন ঘুরে ওঠে লীনার। এসব কি শুনছে সে। নিশ্চয়ই এটা সত্যি না। এটা স্বপ্ন। সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। তাদের বাগানের সবজিতে মুখ দিয়ে কচকচ করে খাচ্ছে পাশের বাড়ির ছাগলটা। অন্যসময় হলে চিৎকার করে উঠতো সে। এখন মা এসব কি বলছে। ছাগলটাও কি স্বপ্নের অংশ?
-কি রে চুপ রইলি কেন? তোর বাবাকে বলেছি, তুই রাজী না থাকলে আমি না করে দেবো।
-না মা, আমি এসব কি জানি, আমি বুঝি না
-তবু তোর যদি খারাপ লাগে আমি মানা করে দেবো। আমি জানি তুই ওকে বড় ভাইয়ের মতো দেখিস।
-না মা সেজন্য না, আমি আসলে....
-তোর আপত্তিটা কোথায় তাইলে?
-আ....আমার... আমার আপত্তি নাই। তোমাদের যা ভালো মনে হয় করো
অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে আর কোন সমস্যা নেই। খুব বেশী ধুমধাম না। বাইরের কাউকে দাওয়াত দেয়া হলো না। শুধু এ গ্রামের আত্মীয় স্বজনকে নিয়েই বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে গেল। এমনকি ফুপাও আসতে পারেনি। ফুফু বললো তার অফিসের কি ঝামেলায় সে আসতে পারছে না। লীনার তাতে কোন সমস্যা নেই তার শুধু বকুল ভাইকে পেলেই হয়। আচ্ছা, এখন তো বকুল ভাই ডাকা যাবে না। কি ডাকবে সে? মিনহাজ সাহেব? বাসরঘরে হিহি করে হেসে উঠলো মনে মনে। একটু পরেই তিনি আসবেন। এই ঘর থেকে নতুন বাড়ির চুনকাম করা গন্ধটা এখনো যায়নি। বাসরঘরের ফুলের গন্ধ ছাপিয়েও সেই গন্ধটা নাকে এসে লাগছে।
৪.
ঢাকায় এসে মিনহাজ ট্রেন বদলে তুর্না নিশীথায় উঠলো। সে একাই ফিরছে। মা ওখানেই থাকবে। সাথে লীনা। মাকে কথা দিয়েছিল অন্ততঃ একটা কথা রাখবে তার। কেউ জানে না বাবার সাথে মার সেপারেশান হয়ে গেছে বছরখানেক আগে। মা গ্রামে একা থাকবে। কিন্তু এই বয়সে একজন সঙ্গী দরকার তার। মা একটা বউ চেয়েছিল তার কাছে। চেয়েছল মায়ের পছন্দের একটা মেয়েকে বিয়ে করুক সে। অনেক ঠান্ডা যুদ্ধের পর রাজী হয়েছে লীনাকে বিয়ে করতে। গ্রামের কেউ জানে না মিনহাজের শহরের অধ্যায়। তাই বিয়েটা নিয়ে কোন ঝামেলা হয়নি। যদি সব জানাজানি হয় একদিন? মিনহাজ ওসব নিয়ে ভাবতে চায় না। সে আর কখনো গ্রামে ফিরবে কিনা সন্দেহ আছে। নাসিমার কাছেই তার সব। তার দুটো সন্তান নাসিমার গর্ভেই। ওদের ছেড়ে অন্য কিছু ভাবতে পারবে না সে। লীনাকে নিয়ে তার কোন আবেগ নেই। সে ওকে বিয়ে করেছে মায়ের ইচ্ছে পুরন করতেই। বাকী জীবন লীনা কি করে কাটাবে সেটা নিয়ে তার কোন ভাবনা নেই। ওটা মায়ের বিষয়। মা নাসিমাকে কোনদিন মেনে নেবে না। সুতরাং মায়ের জন্য আর কিছু করার নেই তার। তার দুটো সন্তানকে মা একবারও দেখতে চায়নি। কত নিষ্ঠুর। নাসিমা খারাপ বলে তার সন্তানও খারাপ হয়ে যাবে? সারারাত মিনহাজের ঘুম আসে না এসব ভেবে। অনেকদিন আগে সে একটা জীবনকে রক্ষা করেছিল। এখন আরেকটা জীবন নষ্ট করলো।
৫.
মিনহাজ অনেক শুকিয়ে গেছে। গ্রামের পরিশ্রমে কালো হয়ে গেছে সে। কি খেয়েছে, কোথায় খেয়েছে কে জানে। চিন্তিত নাসিমা দেখে তার চেহারার মধ্যে কি একটা পরিবর্তন। কেমন একটা বিষন্নতা। আগের মতো ছেলেমেয়েদের নিয়ে আহলাদ করছে না। মাকে নিয়ে চিন্তা করছে হয়তো। মা গ্রামে একা আছে সেজন্যই। হাজার হলেও আপন মা তো। নাসিমা কি করবে বুঝতে পারে না।
৬.
আরো আট মাস পর মিনহাজ খবর পায় লীনা একটা ছেলের মা হয়েছে। এই সংবাদে তার ভ্রু কুঁচকে ওঠা ছাড়া তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। মা তার কাছে একটা নাতিও চেয়েছিল। তাও পূরন হলো। এই সংবাদ পাবার পর ওদিকের সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করে দেয়। মাকে দরকার নেই তার। লীনাকেও না। জীবনের ওই অংশটাকে সে মুছে ফেলতে পারলে এই অংশে কিছুটা সুখী হতে পারে। নইলে এপার ওপার করে তার জীবনটা অতিষ্ট হয়ে যাবে।
৭.
বাগানের কাজটা নিল মিনহাজ। নাসিমা খুব খুশী। এখন স্বামী স্ত্রী দুজনেই এক জায়গায় কাজ করতে পারবে। এই ম্যানেজার যতদিন আছে চাকরী নিয়ে ততদিন চিন্তা নাই। কোন একদিন স্বামীর চাকরীটা পার্মেন্ট হয়েও যেতে পারে।
৮.
লীনা জানে না তার অপরাধ কি। পছন্দ না হলে কেন বিয়ে করতে গেল তাকে। তাকে তো জোর করেনি। বিয়ে করে তার একটা সন্তান হলো, চার বছরে তার মুখ দেখতেও একবার এলো না। কেমন মানুষ সে? ফুফু মানে শাশুড়িও এখন তার কোন খোঁজ জানে না। গত চার বছর কোথায় মিলিয়ে গেছে সে। বেঁচে আছে না মরে গেছে জানে না লীনা। কেউ কোন খবর দিতে পারে না। লীনার এখন নিজেকেই ঘেন্না লাগে। ইচ্ছে করে পালিয়ে গিয়ে নিজেকে নষ্ট করে প্রতিশোধ নেয়। শুধু ছেলেটার দিকে তাকিয়ে এখনো টিকে আছে সে।
৯.
অতএব মিনহাজ বৃত্তান্ত অসম্পূর্ন হয়েই থাকে। প্রতিটি জীবিত মানুষের বৃত্তান্তই অসমাপ্ত। বাকী জীবনে মিনহাজ কোন পথে হাঁটবে আমরা জানি না। কিন্তু বৃত্ত সম্পূর্ন হবার আগে মিনহাজকে কোন সংজ্ঞায় ফেলা যায়?
No comments:
Post a Comment