নিয়তির উপর আগ্রাসন চালালাম। খোদাতালা মাওলা যা রেখেছে রাখুক। আমার পেটে খিদে, পকেটে পয়সা নেই, উপোষ থাকাই নিয়তি। দুম করে পড়ে গেলাম ফুটপাতে।
লোকটাকে দেখে মনে হয়েছে এরকম পড়ে যাওয়া লোক দেখে অভ্যস্ত না সে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুয়ে আছি চুপচাপ। পা দুটো টান টান। জুতোর শব্দ পেরিয়ে যাচ্ছে, থামার লক্ষণ নেই। না, জুতোর শব্দ ফিরে আসছে। আবারো যাচ্ছে। আবারো কাছে আসছে। লোকটা মনে হলো অস্থির, কাউকে ডাকার চিন্তা করছে। ভালো লক্ষণ। একটা রিকশা এসে দাড়ালো মনে হয়। লোকটা কথা বলে উঠলো-
-দেখো তো এই লোকটাকে, হঠাৎ কি হলো?
-কি হইছে তার, কি হইছে
-কেমন করে পড়ে গেল
-এমনে এমনেই পড়ে গেল?
-আপনা আপনি, বোধহয় অসুস্থ।
-মাওলার ইচ্ছা, আমি আপনি কি করুম, আমার ভাড়া মারতে হবে, যাই
-আরে লোকটা তো মরে যাবে, তুমি একটু দেখো তো, কি হইছে, নাকি হাসপাতালে নিবা
-কাজ নাই, বেহুদা ঝামেলা
-আরে শোনো, এই টাকাটা রাখো, কোন হাসপাতালে নিয়ে যাও
-আরে সাহেব আমি কি এম্বুলেন্স নাকি, আমার এসব ঝামেলার টাইম নাই
-তবু একটু দেখো না ভাই
রিকশাওয়ার প্রতি মেজাজটা চড়ে যাচ্ছে। উঠে হারামজাদাকে একটা চড় দিতে ইচ্ছে করছে। ভদ্রলোক তারে ভাই ডাকছে তবু দিল নরম হয় না। তোর বাবা টাকা দিচ্ছে আগে নিয়ে নে, তারপর কথা। তবু সে কুতর্ক করে। আমি চোখ খুলতে পারবো না জুতোর শব্দটা চলে না যাওয়া পর্যন্ত। হঠাৎ বাজে গন্ধ নাকে এল। শালার শালা আমাকে মৃগী রোগী মনে করছে, স্যান্ডেল ধরছে নাকের গোড়ায়। পুরান গুয়ের গন্ধ। মানুষের গু না। কুত্তার গু হবে। আরে দম বন্ধ হয়ে মরে যাবো তো। বাধ্য হয়ে নড়ে উঠলাম।
-এই তো নড়ছে
-হ আমি ঠিকই ধরছিলাম, মিরকি ব্যারাইম্মা।
-ঠিকাছে তুমি ওকে দেখো, আমি গেলাম।
জুতার শব্দ মিলিয়ে যেতেই তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠলাম। রিকশওয়ালাকে দেখলাম। বয়স বেশী না। ধুর্ত চেহারা। আমাকে উঠতে দেখেই হাত মুঠ করে ফেলছে। টাকাটা লুকানোর চেষ্টা।
-ওই তোর জুতার গুষ্টি মারি, শালার গন্ধে মরে যাই, টেকা দে?
-কিসের টেকা
-সাহেব টেকা দিছে না হাসপাতালে নেবার জন্য
-কে কইছে
-আমি নিজ কানে শুনলাম
-ওই মিয়া, তুমি তো অজ্ঞান ছিলা, শুনলা কেমনে?
-অজ্ঞান বলে কান বন্ধ নাকি, দে টেকা দে কইলাম
-মিয়া তুমি দেখি ধান্ধাবাজ, অসুস্থ হও নাই
-সেটা দিয়ে তোর কাজ কি, ওই টাকা আমার চিকিৎসার, আমি হাসপাতালে যামু
-টেকার কথা বলছে দেয় নাই।
-তোর হাত দেখি
-হাতে কিছু নাই
-ওই হাতের মুঠের ভিত্রে কি
-ওটা আমার টেকা না। একজনে পাইবে তারে দিতে যাই
-মুঠ খোল বলতেছি
-কসম, সাহেবের টেকা না ওটা
আমি খপ করে ওর হাতটা ধরে মুঠ থেকে একশো টাকার নোটটা কেড়ে নিলাম। রিকশাওয়ালা চিৎকার শুরু করছে
-তুই ব্যাটা চিটিং, বাটপার, সাহেবের সাথে চিটিংবাজি করে টাকা নিছস।
-আমি সাহেবের সাথে চিটিং করছি, তোরে ডাকি নাই
-সাহেব আমাকে ডাকছে
-ডাকলে তার কাছ থেকে ভিজিট নিয়া আয়
-আমার স্যান্ডেলের গন্ধে তুই উঠছিস
-স্যান্ডেল না, উঠছি তোর গুয়ের গন্ধে, শালা বিষ্ঠা একটা
-ওই গালি দিবি না
-চোপ!
টাকাটা পকেটে পুরে আমি হাসপাতালের বদলে হোটেলের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। হোটেলে একটা টেবিলে বসে অর্ডার দিয়ে হাতমুখ ধুতে গেলাম। সাবান দিয়ে হাত ঘসছি এমন সময় পাশ থেকে একজন সাবানটা চাইল। সাবান দিতে গিয়ে দেখি লোকটা আমার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে আছি। আমি টেবিলে খেতে বসলাম, গোগ্রাসে খাচ্ছি লোকটা তখনো পাশের টেবিল থেকে তাকিয়ে আছে। আমি খাওয়া শেষ করে একশো টাকার নোটটা বের করে বিল দিলাম। লোকটার দৃষ্টি সেই টাকাটার দিকে। তার সামনে রাখা ধোয়া ওঠা কাপটার চা জুড়িয়ে জল, তবু তার তাকানো শেষ হয় না।
এই লোকটাই কি টাকাটা দিয়েছিল? হাত বদল হলেই টাকার মালিকানা বদল হয়ে যায়। লোকটার এত অবাক হওয়ার কি কারণ তাকতে পারে আমার মাথায় আসলো না। আমি আজকে নিয়তিকে মার দিয়ে পেটপুরে খেয়ে নিলাম। এটাই সবচেয়ে বড় কথা। আর কিছু ভাবতে চাই না।
No comments:
Post a Comment