আমি জানি আমার শরীরের কয়েকটা ফাংশন ঠিকভাবে কাজ করছে না। অচল হয়ে যাবার সময় আসেনি এখনো। কিন্তু এটুকু সচলত্ব নিয়ে বাকী জীবন পার করা মুশকিল হয়ে দাড়াবে। বিশেষতঃ পকেটের টাকা যখন ফুরোবার দিকে থাকে। এত দীর্ঘায়ুর কোন সম্ভাবনা ছিল না। তাই সঞ্চয়কে নিরুৎসাহিত করেছি সারাজীবন। যা কামিয়েছি দেদারসে না হলেও সমানে সমান খরচ করেছি। ভেবেছিলাম চাকরী ফুরোবার আগেই ঠেসে যাবো। পরকালে গিয়ে টাকাকড়ির চিন্তা নাই। সন্তানদের জন্য কিছু তৈরি করে যাবার কথা বলে সবাই। কিন্তু তৈরী করে দিলেও লাভ নেই। আমার ভাই তৈরী করে দিয়ে গিয়েছিল। গাড়ি বাড়ি টাকা কড়ি ব্যবসা। দেখা গেল ভাইয়ার কবরের মাটি শুকাতে না শুকাতে সম্পত্তি নিয়ে কামড়া কামড়ি লেগে গেছে। লোকে এটা নিয়ে ব্যাপক হাসাহাসি করেছে। আমি ঠিক করেছিলাম পৈত্রিক এই বাড়িটা ছাড়া আর বছরখানেকের খোরাকী রেখে মরবো। বাকীটা ছেলেরা করে খেতে পারবে।
কিন্তু কিছুই হলো না। আমি সময়মতো মরলাম না। চাকরীর মেয়াদ শেষ হয়েছে পাঁচ বছর আগে, কিন্তু জীবনের মেয়াদ কতোদিন বাকী বুঝতে পারছি না। দিন দিন খরচ বাড়ন্ত। সংসারের উপর আমি একটা বোঝা হয়ে আছি। বোঝা হতাম না যদি শরীরের সবগুলো ফাংশন ঠিকঠাক কাজ করতো। এখন যেসব ফাংশন কাজ করে না তার মেরামতির জন্য ডাক্তার বৈদ্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ছোটাছুটি করতে হয়। সেই ছোটাছুটি করতে গিয়ে সংসার খরচে টান পড়ে যাচ্ছে। বউ ছেলেমেয়ে মৃদু অসন্তুষ্ট দেখে বোঝা যায়। ৬০ বছর পর্যন্ত ঠিক ছিলাম। চাকরীর মেয়াদ শেষ হলো ৬১ তে এসে। তারপর থেকে সমস্যার শুরু। ভাগ্য ভালো যে চাকরীর শেষ ভাগে সততা ঝেড়ে ফেলে বাড়তি কিছু কামাই করতে মন দিয়েছিলাম। নইলে এই অবসর জীবন কুকুরের চেয়ে অধম হতো।
শরীর একটু বেশী খারাপ লাগলে সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে যায়। চেহারায় মেঘের ছায়া ভাসে। কিন্তু মেঘের আড়ালে কি তা আমি জানি। ওদের চেহারা দেখে আমি দিব্যি অনুবাদ করতে পারি মনের ভাষা। ওরা চায় মরার আগে আমি সবকিছু ভাগ করে দেই। তারপর সময়মতো মরি। বউ চায় আমি যেন আমার ব্যাংক ব্যালেন্সের সমস্ত খবর ওকে জানাই। কিন্তু সেই যে ইনকামট্যাক্সের ভয়ে চোরাই একাউন্ট করেছিলাম কয়েকটা। সেগুলো এমনকি বউকে জানাতে ভরসা পাই না। মরার আগে ট্যাক্সের লোক এসে গ্যাঁক করে ধরুক তা চাই না। মরে যাবার পর তোরাই তো মালিক হবি সবকিছুর। এত চিন্তা কিসের। তখন তোদের এই টাকা ভোগ করতে সমস্যা হবে না। উত্তরাধিকারী সম্পদের উপর কোন ট্যাক্স নাই। নিজের মতো করে ভোগ করবি। আমি সবগুলো একাউন্টের খোঁজ খবর একটা দলিলে লিখে তালা মেরে রেখেছি। মরার পর তো সবই খুলে খুলে খুবলে খুবলে দেখবি।
কিন্তু আজকাল কলকব্জাগুলো যেভাবে নষ্ট হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে বেঁচে থাকতেই ওদেরকে আমার ব্যাংকের খবর জানিয়ে দিতে হবে। এখন একটা চেক সই করতে দশটা খসড়া করতে হয়। খালি হাত কাঁপে। কদিন পর ব্যাংক আর এই চেক গ্রহন করবে না। এটা নিয়ে চিন্তায় পড়লাম। উকিল সাহেবকে ডাকিয়েছিলাম সেদিন পরামর্শ করার জন্য।
উকিলের সাথে অনেক বুদ্ধি পরামর্শ করার পর দুপুরে খাওয়া দাওয়া করা হলো। খেয়ে দুজনে আমার ঘরে গল্প করছি এমন সময় উকিল ব্যাগ থেকে একটা স্ট্যাম্প বের করলো। লাল সবুজ দুই পাতা স্ট্যাম্প। আমি চশমা চোখে দিতেই চোখের সামনে যে বাক্যগুলো ভেসে এলো তাতে আমার মাথা চক্কর দেয়া শুরু করলো। উকিল সহজ করে জানালো এটা আমার স্ত্রী ছেলেমেয়ের সম্মতিতেই করা হয়েছে। পড়তে পড়তে দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় যাবার সাথে সাথে আমি চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করি। তারপর কিছু মনে নেই।
হাসপাতালের ধবধবে বিছানায় চোখ মেলার পর নার্স বাদে আর কাউকে দেখলাম না। মনে পড়লো সমস্ত পরিবার মিলে এমন একটা দলিল ড্রাফট করিয়েছে যে আমি স্বেচ্ছায় সকল সম্পত্তি টাকা পয়সা পরিবারের সদস্যদের দান করে বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাচ্ছি। এত বছরের সংসারের জোয়াল টানার পুরস্কার। আমি মোটামুটি বুঝে গেলাম আমার প্রতি পরিবারের কি মনোভাব। কিছুদিন আগেই খানিক আঁচ করেছিলাম। এখন নিশ্চিত হলাম। আরো জানা গেল ওরা একটা ডেভেলাপার কোম্পানী থেকে এক কোটি টাকা আগাম নেবার কথাবার্তা পাকা করে ফেলেছিল। এই অবস্থায় আমি আর ঘরে ফিরতে ভরসা পাচ্ছি না। খুন টুন হয়ে যাওয়া বিচিত্র না। কিংবা খাবারে বিষ। আমার তিন ছেলে দুই মেয়ে। সবচেয়ে ছোট ছেলে ভার্সিটিতে পড়ে। এতদিন ভাবতাম সেই আমাকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে। কিন্তু এখন নিশ্চিত না।
কিছু আত্মীয় স্বজন এলো বিকেলে। তার কিছুক্ষণ পর আমার স্ত্রী। সাথে বড় ছেলে। সে মাকে নামিয়ে দিয়েই চলে গেল কাজে। বউ প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে সবাইকে জানালো কিরকম দুশ্চিন্তায় ওদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে ওদের। আমি চশমা ছাড়া ভালো দেখি না। চশমাটা লাগিয়ে বউয়ের মুখে উদ্বেগের ছায়া খুঁজলাম। আমার জন্য শেষ করে উদ্বিগ্ন হয়েছে সেটা ভুলে গেছি। আরো বিশ বছর আগে হলে বিশ্বাস করতাম। আত্মীয়রা যাবার পর আমাকে পেছন দিয়ে বসলো বউ। আমার সাথে আর কোন কথা নেই। রাগ হয়েছে বুঝেছি। ভেবেছিল এ যাত্রা টিকবো না। টিকে গেছি বলে চরম অসন্তুষ্টি। আমার শরীরের চেয়েও ওকে নেবার জন্য কেউ আসছে না কেন সেটার জন্য বেশী চিন্তিত।
আমি বললাম, "রাতে এখানেই থেকে যাও"।
শুনে শিউরে উঠলো সে। "মাথা ঠিক আছে তোমার? আমি না থাকলে সংসার কি করে চলবে? ছেলে বউরা এখনো কি বোঝে? আমাকেই সব দেখতে হয়। সংসার যন্ত্রনায় অতিষ্ট হয়ে গেলাম। একটু যদি শান্তি পেতাম। মরলে তবু বেঁচে যেতাম"। শেষ বাক্যটা শুনে বুঝলাম না আমার কথা বললো নাকি তার কথা।
কনিষ্ঠ সন্তানটা এসে নিয়ে গেল ওর মাকে। আমি এখন থেকে একা। চোখ বন্ধ করে ভাবলাম এক জীবনের কথা। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছি, হঠাৎ একটা স্বপ্ন দেখে ধড়ফড় করে জেগে উঠলাম মাঝরাতে। বুঝতে পারছিলাম না এটা কোন জায়গা। আমি একা কেন? কিছুক্ষণ পর বুঝলাম একা থাকার রহস্য। বাতি জ্বালালাম। বাথরুমে গেলাম। শরীরটা অনেক হালকা এখন। বারান্দায় গিয়ে দেখি চারদিক চুপচাপ। সবাই ঘুমিয়ে। কে একজন হাসপাতালের গেটে দাড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। অন্ধকারে তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। আমি স্বপ্নটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলাম।
পরদিন ভিজিটিং আওয়ার শেষে ডাক্তার এলে তা কাছে একটা আবদার পাড়লাম। পরিচিত ডাক্তার। আবদারে কান দিল।
প্রায় এক সপ্তাহ পর রিলিজ করার দিন সবাই দল বেধে নিতে এল আমাকে। ঢং এর ফুলটুলও নিয়ে এসেছে কে জানি। ব্যাপক হৈ চৈ বাধিয়ে দিল। আমি হৈ চৈ থামতে বলে সবাইকে গোল হয়ে দাড়াতে বললাম আমার চারপাশে। তারপর বলতে শুরু করলাম......
"আমার প্রিয় পরিবার। আমি জানি তোমরা আমাকে কত ভালোবাসো, আমিও তোমাদের অনেক ভালোবাসি। ভালোবাসতে বাসতে আমরা সবাই একটু ক্লান্ত তাই আমাকে বিশ্রামের জন্য হাসপাতালে আসতে হলো। আমার এত বয়সে এই প্রথম হাসপাতালে আসলাম তার সমস্ত কৃতিত্ব তোমাদের(এখানে একটু গুঞ্জন উঠতে শুরু করলে আমি থামিয়ে দিলাম)। বুঝতে ভুল কোরো না। আমি এত বছর হাসপাতালে আসিনি তোমাদের যথাযথ নজরদারির জন্য। তোমরা সবসময়ই আমাকে অনেক যত্ন করেছো, গুরত্ব দিয়েছো আমার মতামতের। সেদিন আমি তোমাদের উপর নাখোশ হয়েছিলাম ভুল বুঝে, তাই অঘটন ঘটতে যাচ্ছিল। আমি হাসপাতালে কদিন একা একাই ঘুমিয়েছি। আমাকে সেই সুযোগ করে দেবার জন্য তোমাদের ধন্যবাদ আবারো। খুব বেশী মানুষ হাসপাতালে একা ঘুমাবার সুযোগ পায় না। এই কদিন একা একা শুয়ে আমার যা উপলব্ধি হলো তা তোমাদের সেদিনকার দলিলের বক্তব্যকে সমর্থন করে। অর্থাৎ আমি এখন হংস মাঝে বক। বাড়িতে থাকার যোগ্যতা আমার শেষ হয়ে গেছে। আমি তোমাদের ইচ্ছেমতো বৃদ্ধাশ্রমকেই থাকার জন্য বেছে নিলাম। (আবারো হৈ চৈ উঠে গেছে)। চুপ করো সবাই। সময় শেষ হয়ে আসছে। আমি গতকাল সমস্ত আইনী কার্যক্রম সম্পাদন করে রেখেছি। এখন আমাকে নেবার জন্য বৃদ্ধাশ্রম থেকে গাড়ি পাঠানো হয়েছে। আমি বাড়িতে না গিয়ে সেখানেই যাচ্ছি। আমি যতদিন বাঁচবো বাকীদিন ওই বৃদ্ধাশ্রমেই থাকবো, ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিটের আয় থেকে বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানায় মাসিক দশ হাজার টাকা পাঠানো হবে। বিশ হাজার টাকা পাঠানো হবে বাড়িতে। মৃত্যুর পর দাফনকাফন সবকিছু করার জন্য বৃদ্ধাশ্রমকে দায়িত্ব দেয়া গেল। আর সমস্ত সম্পত্তি আমার মৃত্যুর পর ভাগ ভাটোয়ারা হবে ইসলামী শরীয়ত মতে। ব্যাংকের কাছে একটা সার্টিফায়েড কপি পাঠিয়ে দিয়েছি। তোমাদের সবার জন্য একটা করে কপি করা আছে। আমার কথা শেষ। যারা আমাকে বিদায় জানাতে চাও আশ্রমের গাড়িকে অনুসরন করে আসো"
আমি নীচে নেমে 'সময়াক্রান্ত' নামক আশ্রমের গাড়িতে উঠে বসলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম না কেউ আসছে কিনা।
No comments:
Post a Comment