Wednesday, December 19, 2012

ডিসি হিল

শেষ বিকেলে পাহাড় আর বনের মধ্যে কেমন একটা অপার্থিব সৌন্দর্যের বান ডাকে। অস্তায়মান সূর্যের সোনালী আলোটা যখন সবুজ বৃক্ষের চুড়াগুলো স্পর্শ করে, তখন একেকটি বৃক্ষকে মনে হয় গর্বিত ক্লিওপেট্রা। আমার শহরে যে পাহাড়গুলো আছে সেগুলোর উচ্চতা শখানেক ফুটের মতো। বড় পাহাড়ের সাথে তুলনা করলে ওগুলো বড়জোর টিলা। সেই অনুচ্চ পাহাড়গুলি আড়াল করে রেখেছে প্রাচীন কিছু বৃক্ষ। একসময় এই সব পাহাড় হিংস্র জীব জন্তুর আখড়া ছিল। মাত্র দুশো বছর আগেও এখানে আদিম জঙ্গল ছিল। শহরের ইতিহাস হাজার বছর হলেও এই পাহাড়গুলোতে মানব সভ্যতার বয়স খুব বেশী না। বৃটিশশাসনের আগে পাহাড়গুলো মানুষের হাতের নাগালে ছিল না। যে বিশাল গাছগুলো মাথা উচু করে দাড়ানো, তাদের বয়স দুশো বছরের কম হবে। মানুষের বয়স হিসেবে সেটা ছয় পুরুষের বেশী। আমি এখন সে পাহাড়ের সামনে দাড়ানো, সেটার নাম ডিসি হিল। এটার চুড়ায় একটা বিশাল বাড়ি আছে তাতে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের বাসভবন। এটি একসময় চাকমা রাজার পাহাড় হিসেবে পরিচিত ছিল। তারো আগে এটা কোন এক জমিদারের মালিকানায় ছিল। তারও আগে কি ছিল সেটা এখন বলা মুশকিল। তবে পাহাড়ের একটা অংশে গোলাকার টাইলসের একটা কারুকার্যময় ঘরের অস্তিত্ব ছিল, যেটা জমিদারের নৃত্যশালা হতে পারে।

পাহাড়ে উঠে গেছে পিচঢালা পথ। গাড়ি নিয়ে যে কেউ পাহাড়ের চুড়ায় উঠে যেতে পারে। এই পাহাড়ের চুড়ায় ওটার রাস্তা এখন জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। কৈশোরে আর তারুণ্যে আমরা এখানে ঘুরে বেড়াতাম। এখন পাহাড়ে পাদদেশে নজরুল চত্বর, চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক আসর বসে এখানে। মঞ্চের সামনেই ধাপে ধাপে উঠে গেছে পাহাড়। পাহাড়ের খাজগুলো লাল ইটের ছোট ছোট বেঞ্চে সাজানো। ওখানে বসে দর্শককুল। এখানে ওখানে বেঞ্চ বানানো আছে আরো অনেক। গাছের ছায়ায় ঘেরা একটা একটা সাংস্কৃতিক পার্কও বলা চলে। পার্কের একাংশে ফুলের বাগান, আসলে নার্সারি। শহরের সবচেয়ে বড় ফুলের সংগ্রহ। ফুলের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে বাধানো সরু পথ। সেই পথে প্রাতঃভ্রমণকারীদের ভিড়, মাঝে মাঝে সান্ধ্যভ্রমণেও কেউ কেউ। আমি তাদের কেউ নই।

সেই কখন থেকে বসে আছি এই পার্কে। একটার পর একটা সিগারেট নিঃশেষ হয়েছে। সর্বশেষ সিগারেটটা ছুড়ে ফেলার পর মনে হলো তুমি আর আসবে না। তুমি হয়তো ভুলে গেছ। অথবা ইচ্ছে করেনি। তোমার বাসা এখান থেকে দশ মিনিটের পথ। পায়ে হেটে গেলে বিশ পঁচিশ মিনিট। যদি জ্যাম থাকে বড়জোর এক ঘন্টা। তার বেশি কিছু হতে পারে না। কিন্তু আমি এখানে বসে আছি প্রায় আড়াই ঘন্টা। তোমার আসার আর কোন সম্ভাবনা দেখি না। আমি উঠলাম। ফোন করতে পারি কোথাও থেকে। নিউমার্কেটের ফোন বুথে এখন খুব বেশী ভিড় থাকবে না। কিন্তু ফোনটা তুমি না ধরে যদি অন্য কেউ ধরে, সেই ভয়ে করতে ইচ্ছে করছে না।

রাস্তার পাশের দোকানগুলিতে বাতি জ্বলছে। আমি খানিক এগিয়ে বোস ব্রাদার্সের সামনে দাড়ালাম। এই দোকানের রসগোল্লা শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত। কতোবার ভেবেছি এখান থেকে রসগোল্লা কিনে তোমাদের বাসায় যাবো। কিন্তু তুমি রাজী না। মিষ্টি হাতে আমাকে কোথাও যাওয়া মানায় না। আমিও জানি। এটা আমারো খুব অপছন্দের কাজ। রসগোল্লার হাড়ি নিয়ে বেড়াতে যাওয়াটাকে শ্বশুরবাড়ির সাথে তুলনা করা হয়। তোমাদের বাড়িটা আমার জন্য কোনদিনও শ্বশুরবাড়ি হবে না। তুমি কখনো মুখ ফুটে বলোনি, কিন্তু আমরা দুজনেই জানি। এবং মানি এই চরম আর পরম সত্যটাকে। সত্যটা তোমাকে খুব আহত করে তাই না? ওটা ভাবলে আমার কিছুই ভালো লাগে না। আমার তখন পৃথিবী ভালো লাগে না, চাঁদ ভালো লাগে না, ফুল পাখি সমুদ্র পাহাড় কিছুই ভালো লাগে না। গোটা মানব সভ্যতাকে অসহ্য লাগে। তোমাকে ছাড়া আমার আর আছে কি?

আছে কি? সব আছে। গাড়ি আছে, বাড়ি আছে, এক গন্ডা ভাইবোন আছে, বাবা মা চাচা ফুপু খালা মামা আছে। হৈ হৈ একটা পরিবার আছে, ডজনখানেকের একদল ফাজিল বন্ধু আছে, আর কি চাই? এত এত মানুষ আছে চারপাশে। তবু আমি একা বলি কেন? আমি তোমার মায়ার লোভেই কি একটা? কি আছে তোমার মায়ায়? কেন জড়াও তুমি? আসলেই কি জড়াও? নাকি বোঝার ভুল। তুমি জানো এ হবার নয়, তবু ডেকেছিলে কেন? যখন ডেকেছিলে তখন কি জানতে না এ হবার নয়? তুমি কি না হবার জন্যই ডেকেছিলে? না হবার জন্য কেউ কি ডাকে? তুমি যখন ডাকোনি আমি তখন কারো অপেক্ষায় ছিলাম না। আমি জানতাম না কেউ আমাকে ডাকবে। ক্যাম্পাস জুড়ে তখন তুমুল উত্তেজনা। ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। তুমি হলো থাকো। তোমার ফেরার সমস্যা নেই। সমস্যা আমারই ছিল। ক্যাম্পাস থেকে বাসায় যেতে ট্রেন কিংবা বাস দুটোর একটাও ছিল না সেদিন। গণ্ডগোলে সব পালিয়েছিল। অথচ শহরে ফেরার জন্য আমার কোন বিকল্প ছিল না। বন্ধুরা কে কোথায় ছিটিয়ে গেছে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ঠিক তখনই তুমি শহরে যাবার লোক খুঁজছিলে। একটা জরুরী নোট পাঠাতে হবে শহরের বান্ধবীর বাসায়। আমি তখন বিকল্প রাস্তার সন্ধানে তোমাদের হলের সামনের রাস্তা পেরুচ্ছিলাম।

আমাকে দেখে এমন চিৎকার দিলে তুমি!! যেন আকাশের চাঁদ পেয়েছো। আমাদের চেনা ছিল মুখটা। খানিকটা কথাও ছিল। কিন্তু অমন চিৎকার দিয়ে ডাকার মতো কিছু ছিল না। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সাথে সাথে বুকের ভেতর কেমন অচেনা শিহরণ। তুমি ছুটে এলে। তোমাকে ছুটে আসতে দেখে আমি ভাবছিলাম তুমি কি ছুটে এসে আমার হাত ধরবে নাটকের মতো করে? নাকি সিনেমার মতো জড়িয়ে ধরবে, এতদিন কোথায় ছিলেন বলে। তুমি কিছুই করলে না। বললে-

-ঠিক যা ভেবেছি
-আপনারা হারবেন, এবং পালাবেন
-হেরেছি ঠিক, কিন্তু পালাচ্ছি কে বললো
-নয়তো এদিক দিয়ে কোথায়।
-গ্রামের রাস্তা খুঁজছি শহরে ফেরার জন্য
-বাহ চমৎকার বললেন তো গ্রামের রাস্তায় শহরে ফেরা?
-এই তো আমিও আপনাকেই খুঁজছিলাম।
-কেন?
-বাসার জন্য মন কেমন করছে, বাসায় যাবো
-সর্বনাশ এখন বেরুনো বিপদজনক। কোথাও কিছু নেই।
-আপনি কিভাবে ফিরবেন
-আমি হেটে যাবো কিছুদুর, তারপর রাস্তায় উঠে বাসটাস একটা কিছুতে ঝুলে পড়বো।
-আমিও হাঁটবো। তারপর আপনার সাথে ঝুলে পড়বো
-পাগল তুমি?

এই ছিল আমাদের শুরু। তারপর অনেকটা সময় গড়িয়ে গেছে। একসময় আমিই ঝুলে গেলাম তোমার সাথে। বছরের পর বছর কেটে গেল। যাত্রপথ শেষ হয়ে এলো আমাদের। কিছুদিন পর টের পেলাম তুমি আমার ঝুলে থাকা পছন্দ করছো না। আবার ঝেড়েও ফেলছো না। আমি ঝুলে আছি অনিশ্চয়তার দোলনায়। আশা নিরাশার দোল একই সাথে। তুমি আমাকে ডেকে ভুল করেছিলে। ভুল করে ডেকেছিলে হয়তো। অথব আমি ভুল করে সাড়া দিয়েছিলাম। কিন্তু ওটা ছিল অনিবার্যতা। আসলে সময়ের ডাকেই সাড়া দিয়েছিলাম আমি। সময় বলেছিল ওই মুহুর্তে তোমার হাত ধরতে। আমি কখনো সত্যিকারের হাত ধরিনি তোমার। তবে মনে মনে কতোবার ধরা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।

তখুনি তোমাকে দেখা গেল একটা রিকশায় হুড ফেলে রাজরানীর মতো এগিয়ে আসছো। পরনে তোমার লাল টকটকে একটা কামিজ কি ফতুয়া। আমি তোমাকে দেখে রাস্তা পেরুবার জন্য ছুটে গেলাম। উল্টোদিক থেকে ছুটে আসা ট্রাকটা খেয়াল করা হয়নি।

দুই পা হারিয়েও জানে বেঁচে গেছি। বেঁচেছে দুটো হাত। দুটো চোখ আর অমলিন স্মৃতিগুলো। হিসেব চুকে গিয়েছিল সেদিনই। তোমারও করার কিছু ছিল না। তুমি না থাকলেও স্মৃতিগুলো আমাকে পাহারা দিয়ে রাখে। প্রতিদিন আমি ডুব দেই স্মৃতির কুয়াশায়।


(অসমাপ্ত খসড়া)

No comments: