Wednesday, December 19, 2012

মিড অফিসের ঝামেলায়

একটা ঝামেলা আছে অফিসে। পুরোনো ঝামেলা নতুন করে লেগেছে। কদিন চলে সেটাই ভাবছি। মেজাজ ঠিক রাখাটা একটা চ্যালেঞ্জ। ঠাণ্ডা মাথায় খেলতে হবে। মাথা গরম করলেই হেরে যাওয়া। সিরিয়াস মুড থেকে খানিকটা ফান মুডে চলে যেতে হবে। গতবার মাথা গরম করে বিগ বসের সাথেই ক্যাচাল লাগিয়েছিলাম। চাকরী ছেড়ে দেবো ভেবেছিলাম সেদিন। বিকল্প খুঁজতে লেগেছিলাম। বিকল্প পাওয়া সহজ নয় যদি সার্টিফিকেটে দুর্বলতা থাকে। ওটা না থাকলে এতদিনে আকাশ না ছুঁলেও কোন একটা পর্বতচুড়ার আশেপাশে থাকতাম। ডামি পাহাড় হয়ে এখানে পড়ে থাকতাম না।

সিরাজ আমাকে প্রথমে ঝামেলাটার কথা জানায়। আমাদের অফিসের পিয়ন। পিয়ন হলেও তার ক্ষমতার দৌড় অনেকের চেয়ে বেশী। কব্জা ঘুরিয়ে বিগ বসের রুমে যখন তখন ঢুকে যাবার সাহস একমাত্র তারই আছে। ওই্ বাঘের গুহায় ঢুকতে আমাদের যেখানে দশবার ঢোক গিলতে হয়, সেখানে সিরাজ দিব্যি হাসিখুশী মুখে আসা যাওয়া করে। সিরাজের উপর বিগ বসের ভরসা এত বেশী একদিন কার উপর যেন হুংকার দিয়ে বলেছে, তার কাউকে লাগবে না, এক সিরাজকে দিয়েই চলবে অফিস। সে পারে না এমন কোন কাজ নেই। সে যেতে পারে না এমন কোন গন্তব্য ঢাকা শহরে নেই। সেক্রেটারিয়েট থেকে বিদেশী দুতাবাস সবখানেই তার যাতায়াত। বঙ্গভবন আর সংসদ ভবনই তার যেতে বাকী আছে এখনো। ওদিকে তার কোন কাজ পড়েনি। মোদ্দাকথা সিরাজ হলো সেই হরফুন মওলা যাকে দিয়ে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবকিছুই সম্ভব।

বসের সেই হুংকারের পর আমরা এমনিতেই তটস্থ ছিলাম আমরা মিড অফিসের পাঁচজন। মিড অফিসের রেঞ্জ জেনারেল ম্যানেজার থেকে ম্যানেজার পর্যন্ত। বাকী অফিসার, সহকারী অফিসার সব লোয়ার অফিসে নীচতলায় বসে। ওখানে আবার হৈ হুল্লোড় আনন্দ ফুর্তি। দোতলার মতো তটস্থ হয়ে থাকতে হয় না কখনো। মাঝে মাঝে হিংসাই হয় ওদের। দুটো পয়সা বেশী পাই বলে বুকের ভেতরটা সারাক্ষণ কেমন চুন হয়ে থাকে। টক খাওয়া গলা আর জিহবার তালু। আমার চেয়ে বেশী খারাপ বেলাল সাহেবের। উনি ঘন ঘন চা খাচ্ছেন আর বাথরুমে ছোটাছুটি করছেন। কলিং বেল বাজলেই ওনার রীতিমত কাশি শুরু হয়ে যায়। বেলাল সাহেব আমার পাঁচ বছরের সিনিয়র। যার গর্দান যত এগিয়ে তার ভয় তত বেশী। ভয়ের সিজনেও আমি মুখ ফসকে হেসে ফেলি।

-হাসেন কেন? ফূর্তি লাগে?
-না স্যার, ফুর্তি লাগে না। ভয়ে হাসি
-ভয়ে হাসেন মানে? ফাজলামি করেন? আমি বুঝি না ভেবেছেন? সিরাজকে দিয়ে বসকে কি বলেছেন আমি জানি। আমি সত্য কথাই প্রকাশ করবো। আমার ভয় নেই।

আবার কাশি শুরু হয়। বয়স্ক মানুষ। ষাটের কাছাকাছি। কদিন বাদে এমনিতেই রিটায়ার্ড হবেন। চোখের সামনেই দেদারসে কামিয়েছেন। ঢাকার অভিজাত এলাকায় তিনটা ফ্ল্যাট। প্লট আছে কয়েকটা। ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট আছে কোটি টাকার উপর। তবু চাকরীকে এত ভয়। আমি ভয় করি সঙ্গত কারণে। আমার চাকরীর মেয়াদ আরো দশ বছর আছে বলা যায়। কিন্তু গত বিশ বছরের ইতিহাস ধরলে চুরিধারিতে আমি একেবারে অযোগ্য। একটা গাড়িও কিনতে পারিনি। আগামী দশ বছর কি গতিতে কামাতে পারবো বুঝতে পারছি না। এই বুড়োটা সরে না গেলে কামাবার রাস্তা পরিষ্কার হবে না। যত বড় বড় দান তার হাতেই খতম হয়। সে যদি বোয়াল মাছ ধরে আমি ধরি পুটি মাছ। সে যদি গলদা চিংড়ি কব্জা করে, আমি হাতড়াই কুঁচো চিংড়ি।

আর চলছে না। এবার বদলাতেই হবে। নিজে না বদলালে দেশ বদলাবে না। নিজের উন্নতি মানে দেশের উন্নতি। এরকম মহান একটা চিন্তা আমার মাথায় কাজ করে সবসময়। আমি যেন আমার সাথে বাংলাদেশের একটা মিল খুঁজে পাই। বাংলাদেশও প্রচুর সম্ভাবনাময় দেশ। কিন্তু কোথায় যেন উন্নতিটা আটকে আছে। আমিও প্রচুর সম্ভাবনাময় মানুষ। কিন্তু উন্নতিটা আটকে আছে বেলাল সাহেবের জন্য। তাহলে বাংলাদেশের বেলাল সাহেবটা কে? ওটা আর খুঁজে পাই না। তবে এটা বুঝি যে আমার রাস্তা পরিষ্কার হলে বাংলাদেশটা অনেক উন্নতি করবে। আমার উন্নতি, বাংলাদেশের উন্নতি। বাংলাদেশের গাড়ি হবে, বাড়ি হবে, জমি হবে, বিদেশভ্রমন হবে, বাংলাদেশ হবে ইন্টারন্যাশনাল। আমি হবো..........ডিং ডিং কলিং বেলের শব্দ শুনে দার্শনিক ভাবনা বাধা পেল। স্বপ্ন মুছে গিয়ে সেখানে ধড়ফড় ধড়ফড় শব্দ জায়গা নিল।

সিরাজ বসের রুমে ঢুকে কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই ফিরে এল। সোজা আমার চেয়ারের দিকে আসছে। হাসি হাসি মুখ তার। এবার কি আমাকে যেতে হবে ভেতরে? আমি বেলাল সাহেবের দিকে তাকালাম। আজকে ওনার কোন কাশি নেই। এটা আমাকে আরো বেশী চিন্তায় ফেলে দিল।

কিন্তু না, সিরাজ আমার দিকে হাসিমুখে এগিয়ে এসেও শেষ মুহূর্তে গন্তব্য পাল্টে বেলাল সাহেবের টেবিলে গিয়ে দাঁড়ালো। বেলাল সাহেব একসময়  বিগ বসের খাস লোক ছিল। বাংলাদেশে তেল ঘিয়ের দামের উর্ধ্বগতি ও বাজার সংকটের জন্য বেলাল সাহেবকে কিছুটা দায়ী করা চলে। বিগবস আসলে তাঁর হাতদুটো পরস্পরকে ঘষতে এত বেশি তেল ঘি ব্যবহার করে, সেটা মাঝে মাঝে চুঁইয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে এবং একদিন আমি তাতে প্রায় পা পিছলে পড়েই যাচ্ছিলাম। কিন্তু দিন বদলেছে। পিয়ন সিরাজ এখন নতুন তেলের আড়তদার। শোনা যাচ্ছে তেলের বাজারে সে এত আলোড়ন তুলেছে যে বড়সাহেব তাকে অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বেলাল সাহেব সেই থেকে চিন্তিত। তিনিই সিরাজকে চাকরীতে ঢুকিয়েছেন এবং তার প্রশংসার গুনেই বড়সাহেবের খাসলোক হতে পেরেছে সিরাজ। সেই সিরাজই তাঁর শেকড়ে কাঁচি বসাবে কে জানতো আগে। এখন জেনেও লাভ নেই। বড়সাহেব বেলাল সাহেবের বদলে সিরাজের সাথেই সব পরামর্শ করেন আজকাল। আড়ালে বেলাল সাহেব এখন গালি দেয়  - 'শালা বেনিয়া বানচোত বিদেশী, তুই কি বুঝবি এই দেশে মানুষের স্ট্যাটাস।'

এই সব দেখেশুনে বেলাল সাহেব ছেড়ে দিচ্ছিলেন আজকাল। তবু সেদিন এই অবস্থাতেও তিনি বড়সড় একটা ঘাপলা করে ফেলেছেন। ঘাপলাটা আমি জানি, আরো বেশী জানি আমাকে ভাগ না দেয়াতে। বড় সাহেবকে আমি কিছু বলিনি। এমনকি সিরাজকেও না। কিন্তু বেনামিতে একটা মেইল দিয়েছি বড়সাহেবকে, বলেছি সিরাজকে দিয়ে বেলাল সাহেবের নতুন বাড়ির নির্মান সামগ্রীগুলোর একটু খোঁজ নিতে। বড় সাহেব খোঁজ নিয়ে দেখলেন ওই বাড়ির সিমেন্টের বস্তা, ইটের কোম্পানী, রডের কোম্পানী সবগুলো আমাদের নতুন কারখানার।

নতুন কারখানা তত্ত্বাবধানের প্রধান দায়িত্ব ছিল বেলাল সাহেবের উপর। কথা ছিল তিনি ওখানে যা কামাবেন তা থেকে আমাকে ২০% ভাগ দেবেন। কিন্তু বেলাল সাহেব ধূর্ত লোক। তিনি পুরোটা মেরে দেবার জন্য নগদ না নিয়ে মাল নিলেন। মালের ভাগ আমাকে দেবেন কী করে। আমার তো বাড়ি তৈরী হচ্ছে না কোথাও। সেই অজুহাতে তিনি নিজেই পুরোটা গিলে ফেললেন। গিলে ফেললেও কি হজম করা এত সহজ? দিলাম জায়গামত গিট্টু লাগিয়ে। এই কদিন আমার ফূর্তি যাচ্ছে তাই। আমার রাস্তা পরিষ্কার। এখন সিরাজ এসে নিশ্চয়ই ফাইনাল খবরটা জানাচ্ছে বেলাল সাহেবকে।

আবারো বড় সাহেবের বেল বাজলো ডিং ডং। সিরাজ দৌড়ে গেল ভেতরে। মিনিটখানেকের মধ্যেই বের হয়ে এসে জানালো বিগবস দুজনকেই ডেকেছে। আমি এবার চিন্তায় পড়লাম। ভেতরে গিয়ে দেখি বসের মুড খারাপ। সামনে একটা ফাইল রাখা। সেখানে স্ট্যাম্পে সই সাবুদ করা কিছু কাগজ। তার একটা  আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন পড়ো। আমি পাতা উল্টে যা দেখলাম তাতে আমার অন্ন হজম হয়ে গেল। বেলাল সাহেব আর আমার যৌথ বাড়ি প্রকল্পের চুক্তি। আমার নাম সাক্ষর সবই আছে। হুবহু। আমি বেলাল সাহেবের দিকে তাকালাম। তিনি হেসে বললেন, বুঝলেন না ব্যাপারখান? আমরা সেদিন যে চুক্তিটা করছিলাম আমাদের বাড়ির পরিকল্পনা নিয়ে, সেটা বস দেখতে চাইছিলেন। আমি দেখালাম।

আমাদের?

দুজনেরই চাকরী চলে গেল একসাথে।

No comments: