সিজিএস কলোনী আমার কাছে প্রিয় একটি গ্রামের নাম। যদিও আমি এই গ্রামের লাইসেন্সপ্রাপ্ত নাগরিক ছিলাম না। বেসরকারী চাকুরে বাবা এই কলোনীতে ভাড়া থাকতেন পাকিস্তান আমল থেকেই। সেই সুত্রে আমরাও বাবার সাথে যুক্ত হই দেশ স্বাধীন হবার পর। যদিও ভাড়াটে ছিলাম কিন্তু নিজেদের কখনোই বহিরাগত মনে হয়নি। আমার স্কুল ও কলেজ জীবনের সম্পূর্ণটাই কলোনীর নিরিবিলি গণ্ডীতের ভেতরে কেটে গেছে।
যে বয়সের স্মৃতি মানুষের সবচেয়ে প্রিয়, যে শৈশব কৈশোরের আনন্দ জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জীবনের সেই অংশটুকু আমি কলোনীতে কাটিয়েছি বলে নিজের গ্রামের বাড়ির চেয়ে আগ্রাবাদকে অনেক বেশী চিনি, বেশী জানি। নিজের গ্রামের চেয়েও কলোনীতে অনেক বেশী সহজ, স্বচ্ছন্দ, পরিচিত। কলোনী ছাড়ার প্রায় তিন দশক পার হয়ে গেলেও এখনো বছরে দুয়েকবার কলোনীতে যাই পুরোনো ঘ্রাণ শুঁকতে। চোখ বুজে কল্পনা করার চেষ্টা করি সত্তর আর আশির দশকের সেই নয় নম্বর মাঠ, হাসপাতাল মাঠ, মসজিদ মার্কেট, পাওয়ার হাউস, আগ্রাবাদ স্কুল এমনকি স্কুলের সামনে দাড়ানো কুলফি মালাই বিক্রেতার মুখ।
অনেক কিছু বদলে গেছে সময়ে। কিন্তু সেই রাস্তাগুলো, তিন চারতলা পুরোনো দালানগুলো এখনো টিকে আছে। এখনো তাই পুরোনো দিনের কিছু গন্ধ রয়ে গেছে কলোনীর ইঠ সিমেন্ট সুরকির দেয়ালে। নিঃশ্বাস ভরে নেয়া ওই গন্ধটা আমার ভীষণ আপন।
মাঠের কথা বলি সবার আগে। সিজিএস কলোনীর মতো এত বেশী মাঠসমৃদ্ধ কলোনী বাংলাদেশে আর কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই। আজকাল বাচ্চাদের খেলার জন্য মাঠ দূরে থাক, খালি পায়ে হাঁটার কোন উঠোনও পাই না দমবন্ধ ফ্ল্যাটবাড়িতে। অথচ আমাদের সময়ে আমরা কয়েকজন মিলে একেকটা মাঠের দখল নিয়ে ফুটবল ক্রিকেট ব্যাডমিন্টন, দাড়িয়াবান্ধা ডাংগুলি যা খুশী তা খেলতাম। মাঠে মাঠে ছিল আমাদের অবারিত রাজত্ব। মাঠের জগতে আমরা যেন ধনীশ্রেষ্ঠ। সকল মাঠের রাজধানী ছিল সেই বিখ্যাত ৯ নম্বর মাঠ। এই মাঠে অনেক বিখ্যাত খেলোয়াড় ক্রিকেটে ব্যাট-বল লাগিয়েছেন, ফুটবলে লাথি মেরে গোল হেঁকেছেন। প্রধান এই মাঠ ছাড়াও ছিল মসজিদের মাঠ, স্কুলের মাঠ, হাসপাতাল মাঠ। ছিল সামনের মাঠ, পেছনের মাঠ, এমনকি প্রতিটা বিল্ডিং এর পেছনেই একেকটি সবুজ মাঠ। ওইসব মাঠের এত কাহিনী, এত ঘটনা যে, শুধু কলোনীর মাঠের কাহিনী নিয়েই আস্ত একটা বই লিখে ফেলা যাবে। তবে মাঠের ইতিহাস লেখার জন্য সেই সব বড় ভাইদের উপর নির্ভর করবো যারা ওই মাঠগুলোতে ইতিহাস গড়েছিলেন একদিন।
মসজিদ মার্কেটের সিঙ্গাড়া
এটা কি একটা লেখার বিষয়? তবু লিখছি। মসজিদে নামাজ পড়ার চেয়ে মসজিদ মার্কেটে আড্ডার সংখ্যা অন্তত কয়েকশোগুন বেশী হবে। কি ছিল মসজিদ মার্কেটে? কয়েকটা মুদি দোকান একটা টেইলার্স, দুটো সেলুন, একটা ফার্মেসি, দুটো চায়ের দোকান, দুটো পানসিগারেট কলামুলার দোকান, ছোট্ট একটা তরকারী কর্নার, এই তো। কিন্তু এই কখানা দোকানের মধ্যেই আমরা কি বিপুল আনন্দ পেতাম। কলোনীর চা দোকানে বানানো সেই নরোম ডালপুরি আর সিঙ্গাড়া এখনো তুলনাবিহীন। ওরকম সিঙ্গাড়া আমি আর কোথাও খাইনি। মাঠে ময়দানে দৌড়ঝাপ করে যখন ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে পড়তাম তখন টিফিনের পয়সা বাঁচানো চারআনা-আটআনা দিয়ে মসজিদ মার্কেটের ডালপুরি সিঙ্গাড়া। সেই সিঙাড়া কারিগরকে খুঁজে পেলে আমি তার সুদক্ষ হাত দুটোকে বিশেষ কোন পুরস্কার দিতাম। সিঙ্গাড়ার মধ্যে মাত্রা ও স্বাদ অক্ষুন্ন রেখে আলু আর মটর ডালের এত সুন্দর কম্বিনেশান আর কেউ পারতো না।
কলোনীতে একটা সরকারী ক্লিনিক ছিল। এখনো আছে হয়তো। তখন দিবাভাগেই চিকিৎসা দিত সেটি। রাতে বন্ধ থাকতো যদি কোন রোগী ভর্তি না থাকতো। লোকে হাসপাতালে যায় চিকিৎসা নিতে। আমরা হাসপাতালে যেতাম আড্ডা দিতে। বিকেলের দিকে যখন হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যেতো তখন হাসপাতালের প্রবেশমুখের সিড়ি আর লাগোয়া চাতাল হয়ে উঠতো আমাদের আড্ডাখানা। এই আড্ডাখানা এত নিয়মিত ছিল যে দুপাশের সিড়িতে কোন গ্রুপ কখন বসবে তা প্রায় স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল। এটা নিয়ে কোন দ্বন্দ্বও ছিল না। এখানে আড্ডা বসতো সূর্যাস্তের পর।
পাওয়ার হাউসের দিনভর আড্ডা
কলোনীর দক্ষিণ সীমানা দেয়ালের পাশে একতলা দালানটি ছিল পাওয়ার হাউস। ওটার সামনে টানা বারান্দা। সিমেন্টের চকচকে মেঝে। জাম্বুরী মাঠ থেকে উড়ে আসা বাতাসের কারণে ওই বারান্দাটি সবসময় ধুলোবালি মুক্ত থাকতো। ওই বারান্দাটি ছিল সারাদিনের আড্ডাবাজির প্রিয় জায়গা। হাসপাতালের সিড়িতে সন্ধ্যের আগে বসতে না পারলেও, এই চত্বরটি ছিল সারা দিন রাতের জন্য উন্মুক্ত। এখানে দিনরাতের যে কোন সময় আসলে কাউকে না কাউকে পাওয়া যেত। গভীর রাতে কেউ থাকার কথা না, কিন্তু কখনো কখনো এমনও হয়েছে বাসায় ঝগড়াঝাটি করে কেউ বেরিয়ে এসে এখানে বসে বিড়ি ফুঁকছে একলা বসে।
নয় নম্বর মাঠের দক্ষিণ-পূর্ব কোনার আছর
এই জায়গাটা আমরা কবে লীজ নিয়েছিলাম জানি না। কিন্তু বহুবছর এই জায়গাটা দখলে রাখাতে মনে হতো সরকার আমাদেরকে জায়গাটা দিয়ে দিয়েছে। আমরা যতগুলো জায়গায় আড্ডা দিয়েছি তার সবগুলো সময়ের সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল নানান প্রতিবন্ধকতায়। কিন্তু এই কোনাটা দীর্ঘকাল আমাদের হয়ে ছিল। এমনকি আমি কলোনী ছাড়ার পরে আরো দশ বছর এই কোনাটায় আড্ডা দিতে চলে আসতাম দূর থেকে। এমনকি কলোনী ছাড়ার ৩ দশক পরে এখনো যদি কলোনীতে ঢুকি ওই জায়গাটা ছুঁয়ে আসি।
কী ছিল ওখানে? তেমন কিছু না। কিছু দুর্বাঘাসের সবুজ চাঙর, ডজনখানেক সান্ধ্যকালীন মশা, কিছু লোডশেডিংএর অন্ধকার, কয়েকটি প্রজ্জ্বলিত জোনাকী, এই তো। আমাদের আড্ডাবাজির কারণে ওখানে ঘাসও বেশী বড় হতে পারতাম না। সেই ঘাসগুলোর উপর আমরা হাত পা ছড়িয়ে বসতাম। কখনো কখনো শুয়ে পড়তাম। মাথার উপরে নক্ষত্র মাখানো আকাশ দেখতাম। রাজা উজির মারতাম, হেড়ে গলায় গান গাইতাম দল বেধে, তর্ক ঝগড়া খুনসুটি, আরো কত কি পাগলামো হতো। এখানে হাজির হবার সময় ছিল সূর্যাস্তের পর। এখান থেকে হাসপাতাল মাঠ এবং পাওয়ার হাউস দুটোর দূরত্ব একই। আমরা ঘুরে ফিরে এই তিনজায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতাম। আড্ডাড়ুদের কোন সংখ্যার সীমা ছিল না। কখনো পাঁচসাতজন, কখনো দশ বিশজন, যখন যে কাজ শেষ করতো চলে আসতো। হ্যাঁ চাকরী জীবনেও এখানে আড্ডা দিয়েছি কিছুকাল।
এখন আমার খুব খারাপ লাগে যখন ভাবি আমাদের আড্ডার এক মধ্যমণি এখন খ্যাতির মধ্যগগন থেকে ছিটকে কোথায় হারিয়ে গেছে। আড্ডাটা হারিয়ে গেছে, আড্ডার মানুষগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে সময়ের আবর্তে। কিন্তু বেঁচে থাকার শেষদিন পর্যন্ত সেই আড্ডাস্মৃতি তাজা ফুলের সুবাস ছড়াবে বুকের ভেতর।