Wednesday, August 27, 2014

ভুল বেভুল শৈশব (১৯৭৭-১৯৭৯)

আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি নাই বললেই চলে। বার্ষিক পরীক্ষার মাত্র ছদিন আগে ভর্তি হয়েছিলাম স্কুলে। স্কুলে যেতে চরম অনিচ্ছুক (তার চেয়ে বড় সমস্যা ক্লাসে বসতে অনিচ্ছুক)। তাই ক্লাস টুতে উঠেও কোন ক্লাস করিনি। পড়াশোনা যা হয়েছে বাসাতেই। টুতে যে কদিন স্কুলে গিয়েছি পাশের ক্লাসে কাজিনের সাথে ক্লাস থ্রীর বেঞ্চে বসে থাকতাম। ও ছিল আমার শহুরে গুরু। ওয়ান টু এভাবে ফাঁকিবাজিতে পার যাবার পর থ্রিতে উঠে গেলাম একসময়। দুয়েকজন বন্ধু হয়ে গেছে ততদিনে। ফাঁকিজুকি শিখতে শুরু করেছি। 

থ্রী থেকে ফোরে উঠার পর মোটামুটি জবরদস্ত কজন বন্ধু হয়ে গেল। ওই পাড়াটায় যে ধরণের বন্ধু সহজলভ্য ছিল সেই ধরনের বন্ধুর সাথেই মার্বেল, লাঠিম, ডাংগুলি, গোল্লাছুট, হাডুডু, দাড়িয়াবান্ধা, কড়ি খেলা, ডাগ্গি খেলা, সিগারেটের প্যাকেট ছিড়ে তাস খেলা থেকে হেন খেলা নেই আমাদের খেলা হয়নি। ওই বন্ধুগুলার সবাই স্কুলে পড়তো না। কেউ হয়তো দোকানে কাজ করতো, কেউ অন্য স্কুলে দুয়েক ক্লাস পড়েছে, কেউ টোকাই, নানান কিসিমের ছেলেপেলে। তবে সেই দলের মধ্যেও দুয়েকজন অন্যরকম ছেলে ছিল। মারুফ তাদের একজন। মার্বেল ডাংগুলির চেয়েও মারুফের আগ্রহ বিজ্ঞানের দিকে।

আমরা দুজন আলাদা বসে প্ল্যান করতাম কি কি আবিষ্কার করা যায়। মারুফের স্বপ্ন ছিল একটা সিনেমা মেশিন বানাবে। যেটার ভেতর রিল ঢুকালে দেয়ালে চলন্ত ছবি নাচবে গাইবে। আমার পছন্দ হলো আইডিয়াটা। আমরা খুঁজতে শুরু করলাম। রাস্তায়, মাঠে, কলোনীর গেটের কাছে ডাম্পিং গ্রাউণ্ডে কোথায় কি পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতি মেলে সব যোগাড় করি। প্রথমে যোগাড় হলো পাইপ। মোটা কাগজের পাইপ। ওটা হলো প্রজেক্টরের প্রধান অঙ্গ। এক ইঞ্চি ব্যাসের সেই পাইপের দুই পাশে দুটো আতসী কাঁচ লাগবে। তার পর লাগবে ছোট্ট একটা টর্চের বালব। দুটো পেন্সিল ব্যাটারি। চিকন তার। ইত্যাদি যোগাড় হয়ে যাবার পর আমাদের জিনিসটা একটা পর্যায়ে দাড় করানো গেল। এবার পরীক্ষার পালা। অন্য বন্ধুরা মারুফের এসব পাগলামিকে ব্যাঙ্গ করতো।

কিন্তু আমরা জিনিসটা তৈরী করার পর একটু সমীহ যেন। আমরা রিল খুজতে লাগলাম। কে যেন একটা রিলের টুকরো খুজে পেল কাছের কোন সিনেমা হলের কাছ থেকে। সেটা যন্ত্রের সামনে ধরে অন্ধকার ঘরে ওই প্রজেক্টর চালু করলে দেয়ালজুড়ে কিসব ঝাপসা ঝিলিমিলি। ঐ তো সিনেমা চলছে, হ্যাঁ আরেকটু উপরনীচ করলেই তো চলবে। রীল ঘুরায় কেমনে? একেকজন একেক উপদেশ দিতে লাগলো। কিন্তু সব উপদেশ বিফলে গেল যখন নাড়াচাড়া করেও ছবিগুলোকে চলন্ত ফর্মে আনা গেল না। বেজার হয়ে গেল মারুফ। আমিও হতাশ। জীবনের প্রথম প্রজেক্টটা ফেল করলো। কিন্তু একটা ভক্তি অর্জন করে ফেললাম দুজনেই।

ক্লাস ফাইভে উঠে একদিন সিদ্ধান্ত হলো আমরা একটা ক্লাব করবো। কলোনীতে বড়দের তখন বেশ কটা ক্লাব। সোনালী সংঘ, রূপালী সংঘ, প্রভাতী সংঘ ইত্যাদি। আমাদের ক্লাবের কী নাম দেয়া যায়? আমরা তো ওদের তুলনায় অনেক পুচকা। আমি আন্দাজে বলে উঠলাম, কচি সংঘ! হ্যাঁ সবাই রাজী। হয়ে গেল ক্লাব। এরপর নির্বাচন। কে হবে ক্যাপটেন। গোপন ব্যালটে ভোট হলো ছোট ছোট চিরকুটে। অবাক হয়ে দেখলাম আমি ক্যাপটেন হয়ে গেছি। কিন্তু ক্যাপটেনের কাজ কি তাই তো জানি না।

একটা ফুটবল টুর্নামেন্টে যোগ দিলাম। গোহারা হারলাম। ক্যাপটেনের মাথা নীচু। তবু হাল ছাড়ি না। এবার ক্রিকেট খেলবো। তখন বাঁশের কঞ্চি অথবা থান ইট ছিল আমাদের উইকেট। আর তক্তা কেটে বানানো হতো ব্যাট। তাই নিয়ে খেলতে শুরু করলাম টেনিস বল দিয়ে। হারলাম জিতলাম এভাবে চললো।  পরের বছর চাঁদা তুলে মিস্ত্রী লাগিয়ে বড়দের মতো উইকেট আর ব্যাট তৈরি করে আনলো রজব আলী। সাইজে আমাদের মধ্যে সে সবার বড়। তার পড়াশোনা মনে হয় শেষ, ফাইভ থেকে আর সিক্সে পড়া হয়নি। তাদের মুদী দোকানের ব্যবসা ছিল।

কিন্তু সিক্সে এসেই আমার বন্ধু সার্কেল বদলাতে থাকলো। নতুন বন্ধুরা কেউ ডাংগুলি মার্বেল ইত্যাদি খেলে না। তারা ব্যাডমিন্টন খেলে, তীর ধনুক ইত্যাদি নিয়ে এডভেঞ্চার করে। টারজান রবিনহুড হাতছানি দিতে থাকে আমাকে। বাসাও বদলে গেলে আগের বন্ধুগুলোর সাথে বিচ্ছিন্ন হতে থাকি। তখনই মারুফের সাথে আমার আবিষ্কার ইত্যাদির স্বপ্নেরও ছেদ ঘটে গেল। ওই ডানপিঠে শৈশবের ডাংগুলি বন্ধুগুলোর সাথে আর কখনো দেখা হয়নি। বখে যাওয়া বন্ধুগুলোর পরিণতির খবর জানলেও মারুফ বড় হয়ে কি হয়েছে জানতে পারিনি। কেউ কি একবার বলেছিল কোন সরকারী অফিসের কেরানী হয়েছে? মনে নেই। এতদিনে নিশ্চয়ই বুড়ো হয়ে গেছে, দেখলেও চিনবো না।

আমি শৈশবের সব খেলা ভুলে গেছি। মার্বেল কেমনে খেলতাম, লাটিম কি কায়দায় ঘুরাতাম, ডাংগুলি কিভাবে ওড়াতাম সব ভুলে গেছি। কিন্তু একটা জিনিস ভুলি নাই- "এরি দুরি তেরি চুরি জিবুক চম্পা......." ডাংগুলি বচন। এটা দিয়ে ডাংগুলি কত দূরে ছুড়লাম তার মাপ দেয়া হতো। এটার মানে কি? কোন দেশী ভাষা ছিল এটা? এখন খুঁজতে যাওয়া বৃথা।


[অসমাপ্ত]



No comments: