================
এক: মর্মান্তিক এক ফিকশন
================
এক: মর্মান্তিক এক ফিকশন
================
১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ : রাত ২.৪৫মিনিট - ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট
---------------------------------------------------------------
ডিজিএফআই(প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা) প্রধান ব্রিগেডিয়ার রউফের কাছে একটা বিশেষ খবর নিয়ে এলেন ডিএমআই(সেনা গোয়েন্দা) প্রধান কর্নেল সালাহউদ্দিন।
খবরটা খুব খারাপ। আজ ভোরে মারাত্মক কিছু একটা হতে যাচ্ছে দেশে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্রাকে ট্রাকে সৈন্য আর আর্টিলারী ট্যাংক বহর বেরিয়ে গেছে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর প্রেসিডেন্টের বাড়ির দিকে। ভয়ংকর ব্যাপার। খবরটা সেনাপ্রধানকে জানানো উচিত।
খবরটা শুনে ব্রিগেডিয়ার রউফ ভয়ে কাঁপতে শুরু করলেন। তারপর একটু ভাবলেন কি করা যায়। প্রেসিডেন্টকে ঘুম ভাঙিয়ে ব্যাপারটা জানাবেন? কিন্তু তিনি তার সাম্প্রতিক বদলির সিদ্ধান্তে প্রেসিডেন্টের উপর অসন্তুষ্ট। তাকে অন্যত্র বদলি করে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কর্নেল জামিলকে। এসব ফ্যাকড়া সেই সামলাক এখন। ১৫ আগষ্ট থেকে তো তারই দায়িত্ব নেবার কথা। রাত বারোটার পর তারিখটা ১৫ হয়ে গেছে। সে যাই হোক, প্রেসিডেন্টের আগে নিজের জান বাঁচানোই দরকার। এদিকেও আক্রমন হতে পারে, বলা যায় না। তিনি পরে দেখা যাবে বলে বিদায় করে দিলেন কর্নেল সালাহউদ্দিনকে। এরকম একটা ভয়ংকর খবরে ডিজিএফআই প্রধানের নিরাসক্ত ভাব দেখে কর্নেল সালাহউদ্দিন কেমন একটু বিভ্রান্ত, হতাশ। অতঃপর তিনিও আর কাউকে কিছু না বলে বাসায় চলে গেলেন।
কর্নেল সালাহউদ্দিন যাবার পর আর কাউকে কিছু না জানিয়ে চুপি চুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরিবার নিয়ে পেছন দিকের মাঠ পেরিয়ে দূরের একটা গাছতলায় গিয়ে আশ্রয় নিলেন তিনি।
১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ : ভোর ৪.৩০- ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট
---------------------------------------------------------------
বাসায় ফিরেও ঘুম আসছে না কর্নেল সালাহউদ্দিনের। কি ঘটতে যাচ্ছে আজ। এই ঘটনায় প্রেসিডেন্ট মারা গেলে কে হবে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। যারা ঘটাচ্ছে তাদের সবাই জুনিয়র। কেন কি ঘটছে কিছু বুঝতে পারছেন না তিনি। সিনিয়রদের কেউ কি আছে পরিকল্পনায়? জানেন না তিনি।
নিজেকে কেমন অপরাধী লাগছে। উঠে পড়লেন। এবার রওনা দিলেন চীফের বাসায়। চীফকে জাগিয়ে খবরটা দিতেই চীফ বললেন কর্নেল শাফায়াতকে জানাতে সে যেন তিনটা ব্যাটেলিয়ন নিয়ে পাল্টা অ্যাকশানে যায়। কিন্তু দূরে গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এখন শাফায়াতকে অ্যাকশানে যাবার খবর দিলে আবার কী গোলাগুলি লাগে। তার চেয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে থাকি। দৃশ্যপট থেকে সরে গেলেন কর্নেল সালাহউদ্দিন।
নিজেকে কেমন অপরাধী লাগছে। উঠে পড়লেন। এবার রওনা দিলেন চীফের বাসায়। চীফকে জাগিয়ে খবরটা দিতেই চীফ বললেন কর্নেল শাফায়াতকে জানাতে সে যেন তিনটা ব্যাটেলিয়ন নিয়ে পাল্টা অ্যাকশানে যায়। কিন্তু দূরে গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এখন শাফায়াতকে অ্যাকশানে যাবার খবর দিলে আবার কী গোলাগুলি লাগে। তার চেয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে থাকি। দৃশ্যপট থেকে সরে গেলেন কর্নেল সালাহউদ্দিন।
১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ : ভোর ৪.৩০ - ধানমণ্ডি সেরনিয়াবতের বাড়ি
-------------------------------------------------------------------------
সেরনিয়াবতের বাড়ি আক্রমন শুরু করেছে মেজর ডালিমের দল। বাড়ি থেকে ফোন করে আক্রমনের খবর জানানো হলো প্রেসিডেন্টের কাছে। সাহায্য চলে আসবে শীঘ্রি। কিন্তু না। কোন সাহায্য আসার সুযোগ নেই। সৈন্যরা তার আগেই নারীপুরুষ শিশু নির্বিশেষে বাড়ির সকল বাসিন্দাকে নির্বিচারে নিষ্ঠুরতার সাথে হত্যা করলো।
১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ : ভোর ৪.৪৫ - ধানমণ্ডি শেখ মনির বাড়ি
---------------------------------------------------------------
-------------------------------------------------------------------------
সেরনিয়াবতের বাড়ি আক্রমন শুরু করেছে মেজর ডালিমের দল। বাড়ি থেকে ফোন করে আক্রমনের খবর জানানো হলো প্রেসিডেন্টের কাছে। সাহায্য চলে আসবে শীঘ্রি। কিন্তু না। কোন সাহায্য আসার সুযোগ নেই। সৈন্যরা তার আগেই নারীপুরুষ শিশু নির্বিশেষে বাড়ির সকল বাসিন্দাকে নির্বিচারে নিষ্ঠুরতার সাথে হত্যা করলো।
১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ : ভোর ৪.৪৫ - ধানমণ্ডি শেখ মনির বাড়ি
---------------------------------------------------------------
রিসালদার মোসলেমের নেতৃত্বে আরেকটা দল তখন শেখ মনির বাড়ির বাসিন্দাদেরও নির্বিচারে চরম নির্দয়ভাবে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। দুদিকে দুই দলের রক্তাক্ত অপারেশান সাকসেসফুল। একটাকেও বাঁচতে দেবে না বলেই কালো পোষাকের সৈন্যদের নিয়ে বেরিয়েছিল হায়েনা অফিসার। ১০০ভাগ সফল।
১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ : ভোর ৫.০০- ধানমণ্ডি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি
---------------------------------------------------------------
মেজর হুদা এবং মেজর মহিউদ্দিন এই বাড়ির হত্যাকাণ্ডের দায়িত্বে। বাড়ি ঘেরাও করার সাথে সাথে গোলাগুলি শুরু করে দিয়েছে সৈন্যরা। বিনা প্রতিরোধে বাড়ির সব গার্ড আত্মসমর্পন করলো। কর্নেল জামিল খবর পেয়ে ছুটে আসছিল, কিন্তু কর্নেল জামিলকে রাস্তায়ই গুলি করে মেরে ফেলা হয়। বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছে সৈন্যরা। মেজর হুদা আর মেজর মহিউদ্দিনের সাথে বঙ্গবন্ধুর উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলছিল ভেতরে। বাড়িতে ঢোকার পনের বিশ মিনিট কেটে গেছে। শেখ কামাল সহ কয়েকজনকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে ইতিমধ্যে। প্রেসিডেন্ট কয়েক জায়গায় ফোনও করেছেন সাহায্যের জন্য। দেরী হলে ঝামেলা লেগে যেতে পারে। রক্ষীবাহিনী চলে আসতে পারে।
মেজর হুদা ও মহিউদ্দিনের সাথে বাকবিতণ্ডা চলার মাঝখানে মেজর নূরও চলে আসলো কোথাও থেকে। এই বাড়ির উপর বিশেষভাবে ক্ষিপ্ত সে। সিড়িতে দাড়ানো পাঞ্জাবী পড়া লোকটা তার চাকরী খেয়েছে। তাকে আর সময় দেয়া যাবে না। হুদা মহিউদ্দিন ভুদাই পাবলিক, খামাকা টাইম পাস করছে। মেজর নূর দেরী না করে "দিস বাসটার্ড হ্যাভ নো রাইট টু লিভ.....গেট এসাইড" বলে বিকট চিৎকার করে সামনে এগিয়ে ব্রাশ ফায়ার করতে শুরু করলো। ১৮টা বুলেটের সরাসরি ধাক্কায় বঙ্গবন্ধু সিড়িতে পড়ে গেলেন। চশমা পাইপ গড়িয়ে পড়লো পাশেই। বাংলাদেশের ঘড়িতে সময় তখন ৫.৫০মিনিট(আনুমানিক)।
মেজর হুদা ও মহিউদ্দিনের সাথে বাকবিতণ্ডা চলার মাঝখানে মেজর নূরও চলে আসলো কোথাও থেকে। এই বাড়ির উপর বিশেষভাবে ক্ষিপ্ত সে। সিড়িতে দাড়ানো পাঞ্জাবী পড়া লোকটা তার চাকরী খেয়েছে। তাকে আর সময় দেয়া যাবে না। হুদা মহিউদ্দিন ভুদাই পাবলিক, খামাকা টাইম পাস করছে। মেজর নূর দেরী না করে "দিস বাসটার্ড হ্যাভ নো রাইট টু লিভ.....গেট এসাইড" বলে বিকট চিৎকার করে সামনে এগিয়ে ব্রাশ ফায়ার করতে শুরু করলো। ১৮টা বুলেটের সরাসরি ধাক্কায় বঙ্গবন্ধু সিড়িতে পড়ে গেলেন। চশমা পাইপ গড়িয়ে পড়লো পাশেই। বাংলাদেশের ঘড়িতে সময় তখন ৫.৫০মিনিট(আনুমানিক)।
============
সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে দিয়ে শুরু করি। জেনারেল শফিউল্লাহ সবার আগে খবর পান পরিচালক সামরিক গোয়েন্দা লেফটেন্যান্ট কর্ণেল সালাউদ্দিনের কাছ থেকে। সময়টা সাড়ে চারটা থেকে পাঁচটা। কর্নেল সালাহউদ্দিন তাঁর কাছে এসে বলেন "স্যার আপনি কি আরমার আর আর্টিলারি ব্যাটেলিয়নকে শহরের দিকে যেতে বলেছেন? তারা তো রেডিও স্টেশান, গণভবন আর ৩২ নম্বরের দিকে যাচ্ছে।"
শফিউল্লাহ আঁতকে উঠে সাথে সাথে কর্নেল সালাহউদ্দিনকে বলেন, "না আমি কাউকে সেরকম কিছু বলিনি। তুমি শীঘ্রই শাফায়াতের কাছে যাও এবং তিনটা পদাতিক বাহিনী দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বলো। আমি ফোনে নির্দেশ দিয়ে দিচ্ছি"(ধরা যাক সময় তখন ভোর ৫.০০টা)
তারপর শফিউল্লাহ বঙ্গবন্ধুকে ফোন করতে শুরু করেন কিন্তু লাইন পাচ্ছিলেন না। তাঁকে ফোনে না পেয়ে তিনি শাফায়েত, জিয়া, খালেদ এবং তিনবাহিনী প্রধানের সাথে কথা বলে ঘটনা জানান। সাফায়েতকে তিনটা পদাতিক বাহিনী দিয়ে প্রতিরোধ করার নির্দেশ দেন। ধরা যাক তখন ভোর ৫.১৫মিনিট)
তার কিছু পরেই আবার বঙ্গবন্ধুকে ফোনে পেয়ে যান তিনি। তখনি বঙ্গবন্ধু জানান তার বাড়ি আক্রান্ত। জলদি ফোর্স পাঠাতে। শফিউল্লাহ বলেছিলেন, I am doing something sir, can you get out of the house?(ধরা যাক তখন ভোর ৫.৪৫মিনিট)
তখন আবারো শাফায়েতকে ফোন করেন তিনি। কিন্তু ফোনের রিসিভার নাকি তুলে রাখা হয়েছিল। এটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। এখানে কিছু একটা গণ্ডগোল আছে। এবার শাফায়াত জামিলের বক্তব্য শুনি।
কর্নেল শাফায়েত জামিল বলছেন তিনি সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর কোন ফোন পাননি। এই খবরটা প্রথম শুনেন মেজর রশিদের কাছ থেকে। সোয়া ছটার দিকে স্টেনগান হাতে মেজর রশীদ তাকে ঘুম ভাঙ্গিয়ে যা জানায় তার সারমর্ম এরকম - আমরা শেখ মুজিবকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেছি, আমাদের বিরুদ্ধে কোন অ্যাকশানে গেলে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা আছে।
মেজর রশীদের উপস্থিতিতেই শাফায়াতের ফোনটা বেজে ওঠে ঘরের ভেতর। ওটা ছিল সেনাপ্রধান শফিউল্লার ফোন। "শাফায়েত তুমি কি জানো কারা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ফায়ার করেছে? তিনি তো আমার কথা বিশ্বাস করলেন না"। শফিউল্লার সাথে কথা চলার সময় রশীদ চলে যায়। সময়টা তখন ভোর ৬টা পার হবারই কথা। কেননা বঙ্গবন্ধুকে ততক্ষণে সপরিবারে শেষ করে ফেলা হয়েছে। তার পরেই রশীদ কর্নেল শাফায়াতের কাছে আসে।
মেজর রশীদের উপস্থিতিতেই শাফায়াতের ফোনটা বেজে ওঠে ঘরের ভেতর। ওটা ছিল সেনাপ্রধান শফিউল্লার ফোন। "শাফায়েত তুমি কি জানো কারা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ফায়ার করেছে? তিনি তো আমার কথা বিশ্বাস করলেন না"। শফিউল্লার সাথে কথা চলার সময় রশীদ চলে যায়। সময়টা তখন ভোর ৬টা পার হবারই কথা। কেননা বঙ্গবন্ধুকে ততক্ষণে সপরিবারে শেষ করে ফেলা হয়েছে। তার পরেই রশীদ কর্নেল শাফায়াতের কাছে আসে।
জেনারেল শফিউল্লাহর কথা সঠিক ধরলে ফোনটা এসেছিল ৫-১৫মিনিটে। কর্নেল শাফায়াতের কথা সঠিক ধরলে ফোনটা এসেছিল ৬.০০টার পর। দুজনের মধ্যে কার কথা সঠিক? কে মিথ্যা বলছে?
পরবর্তীকালে অনেক সাক্ষাতকারে শফিউল্লাহ বলেছে শাফায়াত চাইলে ঠেকাতে পারতো।
আবার শাফায়েত বলেছেন, জেনারেল শফিউল্লাহ চাইলে ঠেকাতে পারতো ওই হত্যাকাণ্ড।
শেখ মুজিব গুলিবিদ্ধ হন আনুমানিক ভোর পৌনে ছটায়। শফিউল্লাহ আর শাফায়াতের সময়ের তথ্যে প্রচুর গড়মিল। সময়ে গড়মিল ৪৫মিনিট প্রায়। ফোনের কথায় গড়মিল। শফিউল্লাহ বলছেন তিনি দুবার ফোন করেছেন শাফায়েতকে। প্রথমবার সোয়া পাঁচটায় পরেরবার পৌনে ছটায়। ওই সময়ে ফোর্স মুভ করালে বঙ্গবন্ধু বেঁচে যেতো হয়তো। শাফায়েত বলেছেন শফিউল্লাহ ফোন করেছেন ছটার পরে। হত্যাকাণ্ডের প্রথম খবর পান রশীদের কাছ থেকে ছটার পরপর। তারপরেই শফিউল্লাহর কাছ থেকে খবর পান। এসব গোলমেলে তথ্যে একটা জিনিস নিশ্চিত হয় দুজনের যে কোন একজন মিথ্যা বলছেন।
পরবর্তীকালে অনেক সাক্ষাতকারে শফিউল্লাহ বলেছে শাফায়াত চাইলে ঠেকাতে পারতো।
আবার শাফায়েত বলেছেন, জেনারেল শফিউল্লাহ চাইলে ঠেকাতে পারতো ওই হত্যাকাণ্ড।
শেখ মুজিব গুলিবিদ্ধ হন আনুমানিক ভোর পৌনে ছটায়। শফিউল্লাহ আর শাফায়াতের সময়ের তথ্যে প্রচুর গড়মিল। সময়ে গড়মিল ৪৫মিনিট প্রায়। ফোনের কথায় গড়মিল। শফিউল্লাহ বলছেন তিনি দুবার ফোন করেছেন শাফায়েতকে। প্রথমবার সোয়া পাঁচটায় পরেরবার পৌনে ছটায়। ওই সময়ে ফোর্স মুভ করালে বঙ্গবন্ধু বেঁচে যেতো হয়তো। শাফায়েত বলেছেন শফিউল্লাহ ফোন করেছেন ছটার পরে। হত্যাকাণ্ডের প্রথম খবর পান রশীদের কাছ থেকে ছটার পরপর। তারপরেই শফিউল্লাহর কাছ থেকে খবর পান। এসব গোলমেলে তথ্যে একটা জিনিস নিশ্চিত হয় দুজনের যে কোন একজন মিথ্যা বলছেন।
=================================================
তিন :কর্নেল হামিদের "তিনটি সেনা অভ্যূত্থান ও কিছু না বলা কথা"র প্রশ্নবিদ্ধ অংশ
==================================================
অসঙ্গতি-১৬২ পৃষ্ঠার ১ নং পয়েন্টে কর্নেল হামিদ লিখেছেন জনৈক গোয়েন্দা ডিরেক্টর রাত আড়াইটা থেকে তিনটার মধ্যে ঘটনা সম্পর্কে ডিজিএফআই প্রধান ব্রিগেডিয়ার রউফকে জানান। ব্রিগেডিয়ার রউফ খবরটি রাষ্ট্রপতি বা সেনাপ্রধান কাউকে জানাননি।
কে সেই গোয়েন্দা ডিরেক্টর? কর্নেল সালাহউদ্দিন? তখন ডিএমআই প্রধান ছিলেন কর্নেল সালাহউদ্দিন।
আবার ৬২ পৃষ্ঠার ৩ নং পয়েন্টে কর্নেল হামিদ বলেন সাড়ে চারটা থেকে পাচটার মধ্যে কর্নেল সালাহউদ্দিন সৈন্য ও ট্যাংক চলাচলের খবর পান এবং সোয়া পাঁচটার দিকে জেনারেল শফিউল্লাহকে গিয়ে খবরটা জানান।
কোনটা সত্যি?
==================================================
অসঙ্গতি-১৬২ পৃষ্ঠার ১ নং পয়েন্টে কর্নেল হামিদ লিখেছেন জনৈক গোয়েন্দা ডিরেক্টর রাত আড়াইটা থেকে তিনটার মধ্যে ঘটনা সম্পর্কে ডিজিএফআই প্রধান ব্রিগেডিয়ার রউফকে জানান। ব্রিগেডিয়ার রউফ খবরটি রাষ্ট্রপতি বা সেনাপ্রধান কাউকে জানাননি।
কে সেই গোয়েন্দা ডিরেক্টর? কর্নেল সালাহউদ্দিন? তখন ডিএমআই প্রধান ছিলেন কর্নেল সালাহউদ্দিন।
আবার ৬২ পৃষ্ঠার ৩ নং পয়েন্টে কর্নেল হামিদ বলেন সাড়ে চারটা থেকে পাচটার মধ্যে কর্নেল সালাহউদ্দিন সৈন্য ও ট্যাংক চলাচলের খবর পান এবং সোয়া পাঁচটার দিকে জেনারেল শফিউল্লাহকে গিয়ে খবরটা জানান।
কোনটা সত্যি?
এবার একটু দেখি কে কাকে দায়ী করেছে-
১) কর্নেল হামিদের মতে সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে জিয়া, শাফায়েত জামিল ও খালেদ মোশাররফ এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আগ থেকে কিছুটা অবহিত ছিল।
২) কর্নেল শাফায়েত জামিল আবার জেনারেল জিয়াকে জড়িত না করে শফিউল্লাহর দিকে আঙুল তুলেছেন। পাশাপাশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলেছেন কর্নেল হামিদের বিরুদ্ধেও। কেননা তিনি তখন ঢাকার স্টেশান কমাণ্ডার। বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা দলটির নিয়ন্ত্রণ হামিদের উপর বর্তায় তেমন ইঙ্গিত দিয়েছেন।
৩) ওদিকে জেনারেল শফিউল্লাহ কিন্তু প্রায় সরাসরি সাফায়াতের দিকেই তুলেছেন অভিযোগের আঙুল। শাফায়েত কেন ফোর্স মুভ করাননি সময়মতো। তাকে তো সময়মতো খবর দেয়া হয়েছিল।
এখানে এসে আমি কর্নেল সালাউদ্দিনকে মিস করি। একমাত্র তিনিই বলতে পারতেন কে মিথ্যা বলছেন। কিন্তু কর্নেল সালাহউদ্দিনের কোন বইপুস্তক পাইনি। পরবর্তীকালে তিনি কোন পথে গেলেন তার কোন খোঁজ পাই না। এই কর্নেল সালাউদ্দিন কি কি কোন বইপত্র লিখেছেন অথবা সাক্ষ্য দিয়েছেন কোথাও? যদি সেরকম কিছু থাকে তাহলে ১৫ আগষ্টের প্রধান মিথ্যাবাদীকে সনাক্ত করার ব্যাপারে আরেকটু স্পষ্ট সুত্র পাওয়া যেতো। অসঙ্গতি-২বঙ্গবন্ধুর পাশের বাড়ির ডাঃ ফয়সাল নামে শেখ জামালের এক বন্ধু কর্নেল হামিদকে বলেছে সে রাতে শেখ জামাল তার সাথে ছিল সারারাত আড্ডাবাজি করেছে তার সাথে। ওরা চাঁদা তুলে মুরগী কিনেছে এবং প্ল্যান করেছিল বন্ধুরা মিলে মুরগীর রোস্ট খাবে। কিন্তু ভোর ৪টার দিকে বাড়িতে গোলাগুলির শব্দ শুনে জামাল দেয়াল টপকে নিজ বাড়িতে চলে যায়। ফয়সাল আরো বলেন যে বাড়ির জানালায় দাড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির হত্যাকাণ্ডের কিছু অংশ তিনি দেখেন। এমনকি মেজর নূরের চিৎকারটিও শোনেন।
কিন্তু ডাঃ ফয়সাল সত্য কথা বলছেন মনে হচ্ছে না। প্রথমতঃ বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমন শুরু হয়েছে ৫টার পরে। ৪টায় কি করে গোলাগুলি শুনে জামাল বেরিয়ে গেল। তাছাড়া একটা প্রেসিডেন্টের ছেলে চাঁদা তুলে মুরগী খাবার প্ল্যান করে বন্ধুদের সাথে এটাও কেমন লাগে শুনতে। তাও পূর্নবয়স্ক এক তরুণ। যে নতুন বিয়ে করেছে। নতুন বউ ফেলে পাশের বাড়িতে সারারাত আড্ডা দেয় এবং গোলাগুলি শুরু হলে পেছনের দরোজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকে। কেমন গোলমেলে লাগে।
এবার অন্য পাশের বাড়ির আরেকজনের কথা শুনি। তাঁর নাম নেওয়াজ আহমেদ গর্জন। একটা বাড়ির দুটো পাশই থাকতে পারে। ইনি কোন পাশের না জানলেও এনার বাড়ির নাম্বার ৬৭৮ এবং বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নম্বর ৬৭৭ এটা জানা গেছে। ইনি আদলতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেছেন ১৫ আগষ্ট খুব ভোরবেলা তার ঘুম ভাঙ্গে বিউগলের শব্দে। জানালার পাশে দাড়িয়ে তিনি দেখতে পান বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হচ্ছে। এর অল্পক্ষণ পরেই কিছু কালো পোশাকধারী কিছু সৈন্য বঙ্গবন্ধুর বাড়ি লক্ষ্য করে গোলাগুলি শুরু করে। তারপরের ঘটনা তো সবার জানা।
এবার বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ভেতরে অবস্থান করা একজনকে নিয়ে আসি। রমাকে চেনেন? বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাজের লোক। রমা তার সাক্ষ্যে বলেছে ওইদিন শেখ জামাল ও রোজী দোতালায় তাদের ঘরে ঘুমিয়েছিল। কামাল ওর সুলতানা তিনতলায়। জামাল রোজী দোতলায়। গোলাগুলি শুরু হলে প্রথমে বেগম মুজিব তাকে জাগায়। সে কামালকে জাগায়। কামাল শার্টপ্যান্ট পরে নীচতলায় নেমে যায়। তারপর রমা শেখ জামালকেও দোতালায় গিয়ে জাগায়। সে শার্টপ্যান্ট পরে বউকে নিয়ে মায়ের ঘরে যায়। তারপর তো যা ঘটার ঘটলো। আধঘন্টার মধ্যে সব শেষ।
রমা ও নেওয়াজ সাহেবের বর্ননা পড়ে ডাঃ ফয়সাল সাহেবকে মিথ্যেবাদী মনে হচ্ছে না? কিন্তু কর্ণেল হামিদ কি সেটা জানেন না? তাহলে এই রেফারেন্সটা কেন দিলেন তাঁর বইতে?
===========
============
আবার ফিরি কর্নেল শাফায়েত জামিল ও মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর কাছে। আমি বিশ্বাস করি এই দুজনের একজনও হত্যায় জড়িত ছিল না। কিন্তু তাঁরা পরস্পর পরস্পরের ঘাড়ে কিছুটা হলেও হত্যার দায় চাপাতে চেয়েছেন অবহেলা করেছেন বলে। এক্ষেত্রে কর্নেল শাফায়েত জামিলের একটা ঘটনার কথা বলি।
হত্যাকাণ্ডের কয়েকদিন পর ১৯শে আগষ্ট আর্মি হেডকোয়াটারে সিনিয়র অফিসারদের একটা শৃংখলা সভায় শাফায়েত জামিল হঠাৎ করে গর্জে উঠেছিলেন। ফারুক রশীদের উদ্দেশ্যে দাত খিঁচিয়েছিলেন এবং এই হত্যাকারীদের বিচার করার হুমকি দিয়েছিলেন প্রকাশ্যেই। এই সাহস আর কেউ দেখাতে পারেনি। এত সাহস দেখাবার পেছনে কোন শক্তি কাজ করেছে? তবে এটা জেনে ভরসা জাগতে পারে শাফায়েত হয়তো এই ঘটনায় জড়িত ছিল না। কিন্তু জিয়ার সাথে তার খাতির বা জিয়ার প্রতি তার পক্ষপাতিত্ব আমাদেরকে দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়।
আবার মাত্র ৯ দিনের মাথায় ২৪ আগষ্ট জেনারেল শফিউল্লাহকে যখন জোর করে সেনাপ্রধান থেকে সরিয়ে দিয়ে জেনারেল জিয়াকে প্রধান বানানো হয় তখন শফিউল্লাহকেও সন্দেহমুক্ত তালিকায় নিয়ে আসা যায়। হত্যায় জড়িত থাকলে তাঁকে সেনাপ্রধানের পদ ছাড়তে হতো না।
অতএব এই দুজনই আপাততঃ সন্দেহমুক্ত। কিন্তু হত্যার দায় থেকে সন্দেহমুক্ত করেও মিথ্যাবাদীর দায় থেকে মুক্তি দিতে পারছি না শাফায়াত বা শফিউল্লাহকে।। দুজনের মধ্যে অবশ্যই কেউ একজন মিথ্যে বলছেন। কেন বলেছেন সেটা তারাই বলতে পারবেন। এতসব মিথ্যার কারণে আমি কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ব্যর্থ হই, আসলে কে মিথ্যে বলেছেন। কিন্তু মিথ্যেটা এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনার মাঝখানে একটা কাঁটা হয়ে বিদ্ধ করতে থাকে।হত্যাকাণ্ডের কয়েকদিন পর ১৯শে আগষ্ট আর্মি হেডকোয়াটারে সিনিয়র অফিসারদের একটা শৃংখলা সভায় শাফায়েত জামিল হঠাৎ করে গর্জে উঠেছিলেন। ফারুক রশীদের উদ্দেশ্যে দাত খিঁচিয়েছিলেন এবং এই হত্যাকারীদের বিচার করার হুমকি দিয়েছিলেন প্রকাশ্যেই। এই সাহস আর কেউ দেখাতে পারেনি। এত সাহস দেখাবার পেছনে কোন শক্তি কাজ করেছে? তবে এটা জেনে ভরসা জাগতে পারে শাফায়েত হয়তো এই ঘটনায় জড়িত ছিল না। কিন্তু জিয়ার সাথে তার খাতির বা জিয়ার প্রতি তার পক্ষপাতিত্ব আমাদেরকে দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়।
আবার মাত্র ৯ দিনের মাথায় ২৪ আগষ্ট জেনারেল শফিউল্লাহকে যখন জোর করে সেনাপ্রধান থেকে সরিয়ে দিয়ে জেনারেল জিয়াকে প্রধান বানানো হয় তখন শফিউল্লাহকেও সন্দেহমুক্ত তালিকায় নিয়ে আসা যায়। হত্যায় জড়িত থাকলে তাঁকে সেনাপ্রধানের পদ ছাড়তে হতো না।
১. একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগষ্ট, ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, কর্নেল(অব) শাফায়াত জামিল
[কৈফিয়তঃ আমাদের জীবদ্দশায় একাত্তরের পর পঁচাত্তর একটি মর্মান্তিক অধ্যায়। পঁচাত্তরকে নিয়ে যারা উল্লসিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তাদের আমি জানোয়ার বলতেও দ্বিধা করি। কেননা এই ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কলংকিত ঘটনা। শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরের শাসনামলকে দুঃশাসন আখ্যায়িত করে যারা এই হত্যাকাণ্ডকে যৌক্তিক আখ্যা দেন তাদের সাথে কোনরকম তর্কে যাওয়াও মানুষ হিসেবে অপমানজনক। বাংলাদেশের ৪৩ বছরের ইতিহাসে ওই সাড়ে তিন বছর সময়টা কত ক্ষুদ্র এখন আমরা সবাই জানি। আমরা চল্লিশ বছরেও যা অর্জন করতে পারিনি অনেকে সাড়ে তিন বছরেই তা আশা করে বসেছিল। আমরা জানি অনেক ভুল হয়েছে সেই সময়কালে। কিন্তু সেই ভুলের পরিণতি ওই হত্যাকাণ্ড, এটা মেনে নেয়া যায় না। বাস্তবতা হলো, অপরাজনীতির কিছু উপাদান শেখ মুজিবের সেই ভুলগুলোকে সম্প্রসারিত করেছে এবং বাংলাদেশ বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতকে শক্তিশালী করেছে। আমার এই লেখাটা তাদের উদ্দেশ্যে লেখা যাদের কাছে পঁচাত্তরের ওই তিন মাস এখনো একটা ধোঁয়াশা। এই লেখাটা আমার নিজের ধোঁয়াশা দূর করার জন্য লেখা। যদি আর কারো ধোঁয়াশাও দূর হয় তাতে, সেটা বাড়তি পাওনা হয়েই থাকবে।]
No comments:
Post a Comment