চিঠিসাহিত্য বিষয়টা উঠেই গেছে আজকাল। গত শতকে আমরা যেমন চিঠিসাহিত্য নিয়ে বেশ কয়টা বই পেয়েছি এই শতকে তেমন আর হবে না। এখন আর কেউ কাউকে চিঠি লেখে না। বড়জোর ইমেইল করে। শোনা যায় রবীন্দ্রনাথ নাকি সবচেয়ে বেশী অবদান রেখেছেন চিঠিসাহিত্যে। তিনি সারাজীবন সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি প্রচুর চিঠি লিখেছেন বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে। সেই চিঠিগুলো আজ বাংলা সাহিত্যে অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। ফরাসীদের মধ্যে সর্বোচ্চ চিঠি লেখা রেকর্ড নাকি শার্ল বোদলেয়ারের। তিনি প্রতি ঘন্টায় একখানা চিঠি লিখেছেন তেমন নজীরও আছে। এই যুগে কেউ চাইলে অবশ্য প্রতি মিনিটে একটা চিঠি লেখা সম্ভব। হতে পারে সেটা চিরকুট। কেউ দুপাশের কম্পিউটারে অনলাইনে বসে চিরকুট বিনিময় করলে ঘন্টায় ৬০টি চিরকুট লেখা সম্ভব। তার মানে এক ঘন্টায় ৬০ খানা চিঠি!! আবার চ্যাটের হিসেব করলে মিনিট ভেঙ্গে সেকেণ্ডও চলে আসে। গড়ে ১০ সেকেণ্ডে একটা বাক্য বিনিময় করলে মিনিটে ১০টি বার্তা বিনিময় করা যায়। এক ঘন্টায় হবে ৬০০ বার্তা। ভাবা যায়? কিন্তু দুঃখের বিষয় যে আজকাল প্রযুক্তি অনেক উন্নতি লাভ করলেও সেই প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহনকারী কবিসাহিত্যিকের সংখ্যা খুব নগণ্য। নইলে এই বঙ্গদেশে যে পরিমান আবেগ শিল্প সৃষ্টি হয় তাতে প্রযুক্তি নির্ভর চিঠি সাহিত্যের বিরাট সম্ভাবনা ছিল।
কম্পিউটারে চিঠি লিখতেও আলসেমী অনেকের। ল্যাপি খোলো, ইন্টারনেটে ঢোকো, মেইলে লগ ইন করো, তারপর চিঠি লিখতে শুরু করো। কিন্তু এই প্রক্রিয়াগুলো করতে করতে চিঠি লেখার মুডই হারিয়ে যায়। পাতা খুলে বসে থাকে, কি লিখি? তারচেয়ে মোবাইলে টিপ দিয়ে দুই শব্দ এসএমএস পাঠিয়ে দাও, ব্যস ওই হয়ে গেল বার্তা বিনিময়। এসএমএস যুগে এসে ইমেইলও মার খেয়ে গেছে। এখন বিশেষ দিবসে লোকজন শুভেচ্ছা পাঠায় এসএমএসে। ঈদ পরব নববর্ষ সবকিছুতেই কপিপেষ্ট শুভেচ্ছা শুভেচ্ছা শুভেচ্ছা। আমি নিশ্চিত ৯৯% মেসেজ কপিপেষ্ট। নিজ থেকে কষ্ট করে দুটো লাইন কেউ লেখে না। আমি খুব বেশী মোবাইলবান্ধব মানুষ নই। তাই এসএমএস বান্ধবও হতে পারিনি। আমি কখনো বিশেষ দিবসে শুভেচ্ছা বিনিময় করি না এসএমএস দিয়ে। আমার কাছে যেসব এসএমএস আসে, তাও পড়ি না। যে কোন বিশেষ দিবসের পরদিন আমাকে মেসেজবক্স ঝাড়ু দিতে হয় মুছে মুছে। অবশ্য তরুণদের ক্ষেত্রে এরকম নাও হতে পারে। তাদের কাছে হয়তো সত্যিকারের আন্তরিক এসএমএস আসে। কিন্তু সেটা কি চিঠির সমতূল্য হতে পারে? অথবা ইমেইল? কে জানে কিছুদিন পর হয়তো এসএমএস সাহিত্য বলে কিছু একটার জন্ম হলেও হতে পারে।
আমি এক তরুণ গবেষককে চিনি যিনি ইলেকট্রনিক মাধ্যমে 'বাংলা ভাষায় ভাব ও বার্তা বিনিময় প্রবণতা' বিষয়ে গবেষণা করছেন। তার গবেষণার কিছু অংশ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আমি বিস্মিত হয়ে দেখেছি এই যুগেও কী অসাধারণ চিঠি বিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে এই ইলেকট্রনিক মাধ্যমে। গবেষণায় অংশগ্রহন কারী ৩৫ জনের মধ্যে শীর্ষস্থান অধিকার করেছে ভিন্ন দেশে বসবাসকারী দুই ঘনিষ্ট বন্ধু যারা ৯০ দিনে প্রায় দশ হাজার চিঠি বিনিময় করেছিল। যদিও কোন কোন চিঠি মাত্র দুয়েক লাইনের। তবু আমার জানামতে কোন বাংলাদেশীর মধ্যে এত দ্রুত গতির চিঠিপত্র বিনিময় আর কখনো হয়নি। তাদের গিনেস বুকে নাম তোলার সুযোগ ছিল। কিন্তু গবেষককে বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করে জানিয়েছে তারা কোন রেকর্ডের লোভে চিঠি লেখেননি। এত বেশী চিঠি লেখার প্রেরণা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তরুণ গবেষক বলেন, মানুষ মাত্রই নৈকট্য সন্ধানী। বন্ধুর সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগে থাকার জন্যই এত বেশী পরিমান চিঠি লিখেছে ওরা। চিঠি একটি মানবিক আবেগের বিষয়। দুই বন্ধু সেই আবেগকে ছুঁয়ে থাকতে চায়। আজ অনেক বছর পরও ওরা সেই আবেগ ধরে রেখেছে।
অজ্ঞাতনামা ওই দুজনের চিঠি আমাকে কৌতুহলী করে তুললেও আর বিশেষ কিছু জানতে পারিনি। এটা ঠিক যে এক্ষেত্রে চিঠিগুলো যদি কোন দুই বিখ্যাত ব্যাক্তির মধ্যে চালাচালি হতো, তাহলে নিশ্চিত তা বিশ্বাসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হতো। এখন তো তা হবার নয়।
আজকাল বহির্বিশ্বে অবশ্য এসএমএস, ইমেইল এসবের চেয়েও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে আরো অনেকগুলো সফটওয়ার নির্ভর বার্তাবিনিময় পদ্ধতি। ভাইবার, হোয়াটসআপ,ট্যাঙ্গো ইত্যাদি মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোন স্থান থেকে বিনে পয়সায় কথা বলা যায়। কথা ছাড়াও আছে টেক্সট, চ্যাট, ইনস্ট্যান্ট ছবি ভিডিও বিনিময়, এমনকি নিজের হাতে আঁকা যে কোন ছবি বা ডিজাইন সাথে সাথে অন্যপক্ষকে পাঠিয়ে দেয়া যায়। বাংলাদেশে এখনো এসবের ব্যবহার সীমিত। অনেকেরই এণ্ডরয়েড বা স্মার্টফোন নেই। ওয়াইফাই নেই। এসবের জন্য স্মার্টফোন লাগবেই। এ হলো আমাদের জানা জগতের কথা। আমাদের অজানা প্রযুক্তির তালিকা হয়তো এখনো নাগালে আসেনি। সেখানে থাকতে পারে আরো বিস্ময়কর কিছু। প্রথমবার ভাইবার ব্যবহার করে যে পরিমান বিস্ময় লাভ করেছিলাম, সেটা এখনো অক্ষুন্ন। অবস্থা এমন দাড়িয়েছে আমি নিজে আনস্মার্ট মানুষ হলেও ভাইবারের জন্যই স্মার্টফোন ব্যবহার করি। ভাইবারের আইকনটা আমাকে যেন নিঃশব্দে জানান দেয়, ইউ আর নট এলোন এনিটাইম। কে জানে ভবিষ্যতে ভাইবার সাহিত্য নিয়েও গবেষণা হতে পারে।
কিন্তু সবকিছুর মূল উদ্দেশ্য এক। যোগাযোগ। পত্র বিনিময়ের আদিম সূচনা থেকে এই প্রযুক্তিভরপুর দিন পর্যন্ত সব চিঠিপত্র যোগাযোগের উদ্দেশ্যেই লিখিত। ফরমেট বদলালেও ভাব বিনিময় কিন্তু সেই একই উৎস থেকেই বয়ে আসছে।
No comments:
Post a Comment