Tuesday, August 12, 2014

নাগরিক পরাধীন পরিবহন যন্ত্রণা এবং যানবাহনের স্বাধীনতা-গনতন্ত্র @চট্টগ্রাম

নাগরিক বাহন হিসেবে রিক্সা এবং টেক্সির অবস্থান অন্যতম সেরা। পাবলিক গাড়িতে যারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না তাদের জন্য রিক্সা বা টেক্সির বিকল্প নেই। আমার নিজের গাড়ি নেই, পাবলিক গাড়িতে স্বচ্ছন্দবোধ করি না। তাই আমাকে রিক্সা টেক্সি ভাড়া খাতে চড়ামূল্য দিতে হয় প্রতিমাসে। গত দশ বছরে এর পেছনে যা খরচ করেছি তাতে দুটো জাপানী রিকণ্ডিশনড গাড়ি কেনা যেতো অনায়াসে। ড্রাইভিং জানলে কিনেই ফেলতাম হয়তো। আলসেমির কারণে ড্রাইভিং শেখা হয়নি আজো। কথা হলো, রিকশা টেক্সি ভাড়া বৃদ্ধির হার বাংলাদেশে যে কোন দ্রব্যের চেয়ে কয়েকগুন বেশী।

আজ থেকে আটাশ বছর আগে আমাদের আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের বাড়িটা তৈরী হয়। সেখান থেকে স্মৃতিচারণ করে বলতে পারি তখন বাসা থেকে রিকশায় চৌমুহনী যাবার ভাড়া ছিল ২ টাকা। দূরত্ব এক মাইল। সাধারণত এক মাইলের ভাড়াকে ন্যূনতম ধরা হয়। কথ্য ভাষায় 'ওঠানামা দুই টাকা'। সেই ভাড়া এখন দাঁড়িয়েছে ২০ টাকা। পচিশ বছরে এই বৃদ্ধি খুব বেশী মনে হবে না যদি চালের দামের সাথে তুলনা করি। চালের দামও দশগুন হয়েছে পচিশ বছরে। কিন্তু যদি পাঁচ ছয় বছর আগের কথা ধরি তাহলে চমকে উঠতে হয়। ২০০৮ সালেও রিকশাভাড়া ওঠানামা ছিল ৫ টাকা। বেপারী পাড়া টু চৌমুহনী। এই কবছরে তা চারগুন হয়ে গেছে! ভাবা যায়? চালের দাম ২০০৮ সালেও যে চালের দাম ৪০ টাকার মতো ছিল এখন তা ৫০ টাকা। অর্থাৎ চালের দাম বেড়েছে ২৫% কিন্তু রিকশাভাড়া বেড়েছে ৪০০%। এটা রীতিমত ডাকাতি। কথাটা শুধু রিকশা না টেক্সির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সিএনজি টেক্সির ওঠানামা ভাড়া ছিল ২০ টাকা। আগ্রাবাদ থেকে ইপিজেড ভাড়া ছিল ৫০ টাকা। এখন তা হয়ে গেছে যথাক্রমে ৫০ ও ১০০ টাকা। টেক্সি ভাড়া বেড়েছে ২০০% এরও বেশী। এই দামগুলো কেউ নিয়ন্ত্রণ করে না। যে যার খুশীমতো বসিয়ে নেয়। সরকার বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব আমরা অনুভব করি না এই খাতে। সম্ভবতঃ বাংলাদেশে পরিবহন খাতটা সর্বাধিক গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা উপভোগ করে। তাদেরকে ধরা ছোঁয়ার কেউ নেই। এমনকি রাস্তায় কোন গাড়ি চলবে সেটা সরকারও জানে না। যে কেউ কয়টা চাকা লাগিয়ে তার উপর যেনতেন তোবড়ানো টিনের কাঠামো বানিয়ে তাকে নসিমন সলিমন কোন একটা নামে ডেকে চালানো শুরু করতে পারে। কোন লাইসেন্স ইত্যাদির বালাই নেই। ট্রাফিক পুলিশের সাথে সমঝোতা করেই শহর দাপিয়ে বেড়াতে পারে।

আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। এরকম স্বাধীন জাতের গাড়ির মধ্যে প্রথম চালু হয় টেম্পু। চট্টগ্রামের উদাহরনই দেবো এখানে যেহেতু আমার অভিজ্ঞতা চট্টগ্রামেই। আগ্রাবাদ থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত শেয়ার টেক্সি চালু হলো প্রথমে। কিছুদিন পর টেক্সির সাইজ একটু বদলে যেতে দেখলাম। কোন গ্যারেজে স্থানীয় ভাবে টেক্সিকে একটু মডিফাই করে একটা সিটের বদলে দুটো মুখোমুখি সিট করে দেয়া হয়। তার কিছুদিন পর সিটের দৈর্ঘ বাড়তে থাকে। এরকম গাড়ি একটা দুটো বাড়তে থাকে। প্রথমদিকে খুব আরামদায়ক লাগে। প্রায় বাসের ভাড়া দিয়ে টেক্সিতে চড়ার মজা। সিট ক্যাপাসিটি বলে কথা। তখন আশির দশকের শেষভাগ। শহরে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ছিল দুরকম। লম্বা নাকের মুড়ির টিন নামক কাঠের বাস। আর স্টিল বডির কোস্টার। দুই গাড়ির ভাড়াও দুরকম ছিল। কোস্টারের ভাড়া বেশী। বসার সিট বেশী। মুড়ির টিনের ভাড়া কম, বসার সিটও কম। অধিকাংশ যাত্রী দাড়িয়ে। একদিন সেই মুড়ির টিনগুলো সিট সংখ্যা বাড়িয়ে নিজেদেরকে কোস্টার বলে ডাকতে শুরু করে এবং ভাড়া নির্ধারণ করে কোস্টারের মতো। এটা কিন্তু সরকার করে নি। নিজেরা নিজেরাই সব করেছে। সরকার হয়তো ভেবেছে স্বাধীন দেশ, ওদের যা ভালো লাগে করুক।

কিছুদিন পর লম্বু সাইজের টেক্সিগুলো নিজেদের আলাদা সত্ত্বা গড়ে নেয়। তখন ভারত থেকে চেসিস এনে তেরপলের ছাউনি দিয়ে এখানেই বানানো শুরু হলো নতুন ধরনের যান। আদর করে নাম দেয়া হলো টেম্পু। আনঅফিশিয়াল নাম। লোকের মুখে মুখে চালু হতে হতে নামটা থেকে গেল। টেম্পু জিনিসটা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে গেল। আমার মতো পাবলিক ট্রান্সপোর্টে অনাগ্রহীরা টেম্পু দিয়ে চলাচল শুরু করলো। মাইল প্রতি প্রথম ভাড়া সম্ভবতঃ ৫০ পয়সা। তখন বাসভাড়া মাইল প্রতি ২৫ পয়সা। টেম্পুর জনপ্রিয়তা এবং একচেটিয়াত্ব এক দশকের কম নয়। তারপর একদিন শহর আরেকটু স্মার্ট হলো যেদিন নাভানা ম্যাক্সি নামের কিছু ভ্যান নামায়। টয়োটা ভ্যানের পেছনে তিন সারি সিট দিয়ে চমৎকার সার্ভিস দিয়ে যাত্রা শুরু ম্যাক্সির। দ্রুতগতির বাহন হিসেবে পরিচিতি পায়। ভাড়া মাইলপ্রতি এক টাকা। টেম্পুর দ্বিগুন হলেও মানুষ পছন্দ করে গাড়িটা। কেননা এটি টেম্পুর মতো ধীরগতি না, এক টানে গন্তব্যে পৌছে দেয়। মনে আছে ইপিজেড থেকে না থেমে এক টানে আগ্রাবাদ চলে যেতাম আমরা। নাভানা ম্যাক্সির জনপ্রিয়তায় উত্তরা মোটরস নিয়ে আসে টাটা ম্যাক্সি। একই ভাড়া একই সার্ভিস। কিন্তু এক বছরের মাথায় টাটা জবরজং লোহা। নাভানার সাথে পাল্লা দিতে পারে না। এর পাশাপাশি চালু হয়ে যায় রাইডার, রেঞ্জার নামে দুই রকমের গাড়ি। ম্যাক্সির চেয়ে একটু বড়। কিন্তু একই সার্ভিস প্রায়। এদের জনপ্রিয়তা দেখে বাস মালিকেরা কিছু স্পেশাল বাস নামাতে শুরু করে। বাসগুলো স্পেশাল সিটি সার্ভিস নাম দিয়ে চালু হয়। সিট ক্যাপাসিটি। ভাড়া মাইলপ্রতি ১ টাকা। যেখানে সেখানে দাড়ায় না। টাইম মেনে চলে। চট্টগ্রামে যানবাহনের ক্ষেত্রে সেই এক স্বর্নযুগ এসেছিল। কিন্তু বছর দুয়েক পরে সবগুলো গাড়ি জবরজং হয়ে যায়। কেউ নিয়ম মানে না, যেখানে খুশী দাড়ায, মুড়ির টিনের চেয়ে আরো খারাপ অবস্থা। ভাড়া বাড়াতে থাকে। কিন্তু যাত্রী নেয় বোঝাই করে। এমনকি রাইডারের মধ্যেও দাড়িয়ে প্যাসেঞ্জার নিতে শুরু করে। নগর পরিবহনে নেমে আসে চরম দুর্যোগ। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সরকার নীরব দর্শক। সরকারের কিছুই বলার নেই। গাড়িওয়ালাদের কাছে জিম্মি হয়ে যায় সাধারণ মানুষ।

গত পাচ বছরের বেশী সময় ধরে এই অরাজকতা চলছে চট্টগ্রামের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমে। কিন্তু কোথাও কারো কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। আগে বিআরটিসির কিছু বাস চলতো শহরে, এখন সেই বাসগুলোকে দেখি সকাল বিকাল গার্মেন্টস শ্রমিক টানছে। সিটি সার্ভিস নামের চিটিং সার্ভিসের কাছে এরাও আত্মসমর্পন করে নিজেদেরকে বিলীন করেছে স্রোতে।

পাবলিক ট্রান্সপোর্টের এই দুরাবস্থায় আমাকে কয়েকগুন বেশী ভাড়া দিয়ে টেক্সি রিকশায় চড়তে হয়। আমি প্রতিমাসে মাছের বাজারে যে পরিমান খরচ করি, তার দ্বিগুন খরচ করি এসব যানবাহনে। করতে বাধ্য হই। আমি জানি পরিবহন খাতে এত বেশী খরচ করতে না হলে আমাদের জীবনটা আরেকটু স্বচ্ছন্দ হতো। স্বচ্ছলতা একটু হলেও বাড়তো।

এসব ব্যাপারে সরকার নজর দেবে না এটা প্রায় নিশ্চিত। আমাদের দুর্ভোগ যুগের পর যুগ চলে যাচ্ছে। তবু কোথাও নড়ন চড়ন নেই। মানুষও মেনে নিয়েছে অবধারিত দুর্ভাগ্য। অতএব এইসব অনিয়মকে ভালোবেসেই আমাদের দেশপ্রেমের নজির রাখতে হবে।


No comments: